৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:৩০:৪৫ অপরাহ্ন


জ্বালানি সংকট নিরসনে আপাতত কোনো ম্যাজিক নেই
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১০-২০২৪
জ্বালানি সংকট নিরসনে আপাতত কোনো ম্যাজিক নেই


অপশাসন এবং দুর্নীতির কবলে থাকা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত জ্বালানি-বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা সফল সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে হলে এখন প্রয়োজন ব্যাবহারে সাশ্রয়ী হওয়া এবং কৃচ্ছ্রতা সাধন। জ্বালানি সংকট থেকে আগামী দুই তিন বছরে মুক্ত হওয়ার কোনো ম্যাজিক কৌশল নেই। ৪২০০-৪৫০০ এমএমসিএফডি গ্যাস চাহিদার বিপরীতে এখন সর্বোচ্চ সরবরাহ ক্ষমতা ৩১০০ এমএমসিএফডি। ১২০০-১৪০০ এমএমসিএফডি ঘাটতি বিদ্যুৎ, সার উৎপাদন থেকে শুরু করে সকল গ্যাস গ্রাহকের জন্য আতঙ্কের সৃষ্টি করে চলেছে। তদুপরি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীর ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি-বিদ্যুৎ সেক্টরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পেট্রোবাংলার সঙ্গে কোম্পানিগুলোর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে।

গ্যাস সরবরাহ বর্তমান পর্যায় থেকে কোনো অবস্থায় ২০২৭’র আগে বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই। বরং দেশীয় ২০০০ এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদনে ৫০ শতাংশ যোগানদানকারী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন হঠাৎ করে দ্রুত কমে গেলে মহাসংকটে পড়বে দেশ। এমতাবস্থায় দ্রুত বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ ২০১০ বিশেষ আইনের অধীনে সামিট এনার্জির সঙ্গে স্বাক্ষরিত তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি বাতিল করা হলে নতুন চুক্তি সম্পাদনে অন্তত ১ বছর পিছিয়ে যেতে হবে. পরিস্থিতির কারণে চুক্তি বহাল চুক্তির শর্তগুলো আরো দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। ২০১৭ নাগাদ টার্মিনালটি অপারেশনে আসার আগেই মাতারবাড়ী থেকে জিটিসিএলকে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে. ভোলার গ্যাস গ্রিডে সঞ্চালনের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গত তিন সপ্তাহ জ্বালানি কোম্পানিগুলোর শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিত হয়েছি কিছুটা সমন্বয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে এখনো গ্যাস সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থা থেকে ১৫০-২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অপব্যাবহার রোধ করা সম্ভব। ১৯৯৩ থেকে গ্যাস সরবরাহ ব্যাবস্থায় শৃঙ্খলা আনার জন্য সৃষ্ট গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানিকে সমুদয় সঞ্চালন পাইপলাইন এবং স্থাপনা হস্তান্তর করা হয়নি।

বেশ কিছু পাইপলাইন পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ কোম্পানিসমূহের আওতায় থাকায় গ্যাস সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব আছে। গ্যাসক্ষেত্রসমূহ এবং এলএনজি সরবরাহব্যবস্থা থেকে গ্যাস সঞ্চালন নেটওয়ার্কে গ্যাস সঞ্চালনের ক্ষেত্রে আধুনিক কাস্টোডি ট্রানফার মিটার সর্বক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আধুনিক ফ্লো কম্পিউটার থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতিতে গ্যাস পরিমাপ করা হচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চালন নেটওয়ার্ক থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে গ্যাস সরবরাহ অনেক ক্ষেত্রেই মিটার ব্যবহার না করে সঞ্চালন লাইন অযাচিতভাবে হট ট্যাপিং করে দেওয়া হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জিটিসিএলএর গ্যাস সঞ্চালন মিটারবিহীন অস্বচ্ছভাবে চালু থাকার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি পেট্রোবাংলা থেকে জিটিসিএলএর ওপর ৩ শতাংশ সিস্টেম লস চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সঠিকভাবে পরিচালিত হলে সঞ্চালন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ১-১.৫ শতাংশ কারিগরি লস হতে পারে। জিটিসিএলের নিয়ন্ত্রণাধীন সঞ্চালন নেটওয়ার্ক থেকে কোনো অযথায় মিটারবিহীন গ্যাস সরবরাহ করা সংগত হয়নি। যত্রতত্র হট ট্যাপিং করে গ্যাসসংযোগ প্রদানের সিদ্ধান্তগুলো ছিল হঠকারিতা।

আমি দেশ-বিদেশে গ্যাস সরবরাহ চেইন ম্যানেজমেন্ট নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে জমা দিয়েছি। একই সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আমার সুপারিশ প্রদান করেছি। সুযোগ পেলে জ্বালানি উপদেষ্টাকেও অবহিত করবো।

আমার মতে, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস উৎপাদন দ্রুত কোমর সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে পেট্রোবাংলা এবং বাপেক্স কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন গ্যাসকূপ খনন প্রকল্প দ্রুত সম্পাদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পটিয়া, জলদি, সীতাপাহাড় অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়টি নিয়ে আর বিলম্বের সুযোগ নেই। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রসহ অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রের গভীরে উচ্চচাপ স্তরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ীতে স্থাপনতব্য ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণকাজ অবিলম্বে শুরু করতে হবে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিহার করে অবিলম্বে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত করতে হবে।

আমি বিতরণ কোম্পানিগুলোর অকারিগরি গ্যাস লস অর্থাৎ গ্যাস চুরি নিবিড় অভিযানের মাধ্যমে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার সুপারিশ করেছি। সেই সঙ্গে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার সর্বক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পেশাদারদের পদায়ন করে আমলা নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার সুপারিশ করেছি। তিতাস গ্যাস, বাপেক্স, জিটিসিএলের মতো কারিগরি ঘন সংস্থাসমূহকে কোম্পানি অ্যাক্ট অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করেছি। জ্বালানি সেক্টরের জন্য বিশেষ বেতন কাঠামো চালু করে কাজে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির সুপারিশ করেছি।

বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গৃহস্থালি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানির সুযোগ থাকায় শিল্প উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহারকে প্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছি।

উপরোক্ত সুপারিশমালা এ মুহূর্তে অপরিহার্য। এখন যেহেতু সরকার সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে, তাই আশা করি দেশের স্বার্থে এগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা হবে। একই সঙ্গে দেশ ও জনগণের স্বার্থে প্রবাসে থাকা অভিজ্ঞরাও অবসরের সময় এড়িয়ে যে কোনো শুভ উদ্যোগের সারথি হবো।

শেয়ার করুন