৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:১৫:৫১ অপরাহ্ন


রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন খেদাও আন্দোলন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-১০-২০২৪
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন খেদাও আন্দোলন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ব্যারিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা


রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন খুব বেশিক্ষণ আর থাকতে পারছেন না নিজ পদে। যেভাবে তার পদত্যাগের দাবি চারদিকে, তাতে তার নিজ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবভনের সামনে এ রিপোর্ট লেখাকালীন ২২ অক্টোবর মঙ্গলবার গভীর রাতেও ব্যাপক ছাত্র জনতার উপস্থিতি ছিল। সবার দাবি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু কখন পদত্যাগ করবেন। পুলিশ, র‌্যাব সেনাবাহিনীর বাধা ভেঙ্গে ছাত্র জনতা ঢোকারও চেষ্টা করে বঙ্গভবনে। শেষ পর্যন্ত সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারসেল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। কিন্তু এমন বাধা কতক্ষণ টিকানো যাবে সেটা বলা মুশকিল। 

নিজ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা না দিলে গণভবনের মত বঙ্গভবনও তছনছ হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। এবং পেছনের দরজা দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে হয়তো পালাতেও হতে পারে। তবে আইনশৃংখলাবাহিনী সজাগ সতর্ক। সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি যে শুধু ঢাকায়, তা নয়। দেশের বিভিন্নস্থানেই মঙ্গলবার ব্যাপক মিছিল হয়েছে। 

গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের পর তারই মনোনীত রাষ্ট্রপতি অটুট ছিলেন নিজের স্থানে। এ নিয়ে কম বসচা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার এতে ভ্রুক্ষেপ করেনি। কিন্তু বিতর্কটা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ চুপ্পুই সূচনা করেছেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন ভারতে। মন্ত্রী পরিষদ থেকে আওয়ামী লীগের কেউই নেই জনসমক্ষে। একের পর এক হত্যা মামলায় আটক হচ্ছেন। সীমান্ত দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা খাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও দোসর।

অন্তর্বর্তী সরকারের আড়াই মাসের মাথায় এক সাক্ষাতকারে হঠাৎ করে স্ববিরোধীতা করে নতুন বক্তব্য উপস্থাপনা করেছেন রাষ্ট্রপতি চুপ্পু। তিনি দাবি করেন শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র তার কাছে নেই। অথচ তিনিই টেলিভিশনে এক বক্তব্যে ৫ আগষ্টের পর বলেছিলেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ পত্র দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি সেটা গ্রহণও করেছে। 

চুপ্পুর এমন বক্তব্য যে দেশে একটা হট্টগোল তৈরির সুচনা সেটা তিনি জেনেশুনে বলেছেন। এবং সে হট্টগোল এখন চলছেও। কোন উদ্দেশ্যে তিনি এটা বলেছেন সেটা বোধগম্য না হলেও তার বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে। তাকে সরানোর সব বাবস্থা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।

ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতিকে সরাতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।

মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) দুপুরে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে দেখা করেন আইন উপদেষ্টা ও তথ্য উপদেষ্টা। দীর্ঘ আলোচনায় তেমন কিছু জানা না গেলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর বেড়িয়েছে মূলত রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর স্থানে কাকে বসানো যায় এবং প্রয়োজনে প্রধান বিচারপতির পদেও পরিবর্তন আনতে হলে কি ভাবে কী করতে হবে। একটি সূত্র বলেছে, প্রধান বিচারপতিও রাষ্ট্রপতির পদে বসতে হতে পারে। অন্যান্য স্থান থেকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও বসার সুযোগ করে দেয়ার আলোচনা চলেছে।

সব মিলিয়ে ওই চ্যাপ্টারটা পরে, আগে সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে কিভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা যায় বা সরিয়ে দেয়া যায় সে ইস্যু।

বঙ্গবভনের সামনে রণক্ষেত্র 

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারীরা। হঠাৎ করে রাত ৮টা ২০ মিনিটে মাইকে ঘোষণা দিয়ে একদল বিক্ষোভকারী পুলিশ সেনাবাহিনী, র‌্যাব এর দেয়া ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে সেনাবাহিনী। পরে বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে সাউন্ডগ্রেনেড ছোড়া হয়। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে বিক্ষোভকারী।

তবে বিক্ষোভকারীরা আবারও জড়ো হলেও পুলিশি বাধায় আর দাঁড়াতে পারেনি। তারা রাষ্ট্রপতির এখনই (মঙ্গলবার রাতে) পদত্যাগের দাবি করে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করছে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে গণ-অধিকার পরিষদের তারেক রহমানকে দেখা গেছে। এছাড়া প্রায় ১ হাজার ২০০ বিক্ষোভকারী এতে অংশ নিয়েছে।

এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে এক ভ্যান পুলিশ আসে। তবে আন্দোলনকারীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিয়ে তাদের বঙ্গভবনের ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে অবস্থান নিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাত পৌনে নয়টার দিকে একটি জলকামান এলেও আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভের মুখে তা দৈনিক বাংলা মোড়ের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়।

এর আগে বিকেলে গুলিস্থান মতিঝিল সড়কের পাশের রাস্তা বন্ধ করে দেন বিক্ষোভকারীরা। তারা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। তারা কয়েকটি ব্যানারে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আলাদাভাবে বিক্ষোভ করেন।

‘ইনকিলাব মঞ্চ; ‘রক্তিম জুলাই-২৪’ ‘৩৬ জুলাই পরিষদ’ ‘জিয়াউর রহমান সমাজকল্যাণ পরিষদ’ ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র জনতার মঞ্চ’ প্রভৃতি ব্যানারে অনেককে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে বঙ্গভবনের সামনে। দুপুর ২টার দিকে তারা বঙ্গভবনের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা।

এ সময় বঙ্গভবনসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বিপুল সংখ্যক পুলিশ, সেনাবাহিনীর এপিসি ও জলকামান মোতায়েন করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং দেশত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দেশত্যাগের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। সম্প্রতি মানজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘(পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করার) বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।’ রাষ্ট্রপতির এ মন্তব্যের পর থেকে তার পদত্যাগের দাবি উঠেছে।

বৃহস্পতিবারের মধ্যে চুপ্পুর পদত্যাগের আল্টিমেটাম 

এরআগে মঙ্গলবার বিকেলে এক জনসভা থেকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগ করতে আল্টিমেটাম দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। এসময় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, সংবিধান সংশোধন, বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধসহ মোট পাঁচ দফা নতুন দাবি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) বিকেলে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে এই দাবি জানান তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়ায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে শহিদ মিনারে এই সমাবেশ ডাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, “আপনার সময় শেষ হয়ে গেছে। ছাত্র-জনতা আর আপনাকে রাষ্ট্রপতি পদে দেখতে চায় না। হয় আপনি পদত্যাগ করুন, না হলে ছাত্র-জনতা বঙ্গভবন ঘেরাও করে হাসিনার মতো পালাতে বাধ্য করাবে। সব জায়গা থেকে স্বৈরাচারের দোসরদের বিদায় করতে হবে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।” ছাত্র-জনতার এই স্পিরিট নতুন বাংলাদেশ গঠনের আগ পর্যন্ত থাকবে উল্লেখ করে তারা বলেন, “৭২ এর ফ্যাসিবাদী সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব। এছাড়াও আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন করে সংবিধান রচনার উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।”

যে পাঁচ দাবিতে আল্টিমেটাম

মঙ্গলবার বিকেল সোয়া পাঁচটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। একইসঙ্গে অবিলম্বে এসব দাবি মেনে নেওয়া না হলে শিগগিরই রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

পাঁচ দফা দাবিগুলো হলো-

এক. অনতিবিলম্বে ৭২ এর সংবিধান বাতিল করতে হবে। সে জায়গায় ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ থেকে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে।

দুই. এই সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তাদেরকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে।

তিন. এই সপ্তাহের মধ্যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীনকে পদচ্যুত করতে হবে।

চার. জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের আলোকে ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।

পাঁচ. ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এসব নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। একই সাথে তারা যেন ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক হতে না পারে ও নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

শেয়ার করুন