বৈষম্য এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তোড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় শাসনে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলেও এক বছরের বেশি সময়ে দেশের সর্বত্র চলছে অরাজক পরিস্থিতি। শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, আইন, বিচার, জনপ্রশাসন কোথাও সংস্কার হয়নি। সুশাসনের অভাবে সর্বত্র চলছে অরাজকতা। অর্থনীতি নাজুক, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকটে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বেকার সমস্যা প্রকট রূপ ধারণ করছে। চাঁদাবাজি, দখলদারী, মব সন্ত্রাস জনজীবন অতিষ্ঠ্য করে তুলছে। ছাত্র-জনতার নিরীহ আন্দোলনকে পুঁজি করে আঁধারের শক্তি মেটিকুলাস পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে নুন আনতে পান্তা ফুরোনো সীমিত আয়ের মানুষদের জীবন এখন অতিষ্ঠ। খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরেই এখন পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যাচ্ছে। দেশ-বিদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাড়ছে। সরকারপ্রধান ফেব্রুয়ারি ২০২৬ প্রথমার্ধে রোজার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলেও সেই নির্বাচন ঘিরেও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
১৯৭১-২০২৫ যারা বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখেছে। বাম এবং ডান ধারার রাজনীতি বিষয়েও সবার ধারণা আছে। স্বাধীনতার সপক্ষ এবং স্বাধীনতাবিরোধী দুই ধরনের শক্তি আছে বাংলাদেশে। ২০০৮-২০২৪ আওয়ামী লীগ সব রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করে স্বৈরাচারী পন্থায় সরকার চালিয়েছে সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় ২০২৪ সালে সরকার পতনের পর নির্বাচন হলে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবে, সেটি ছিল সর্বজনীন বিশ্বাস। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের পর দেশজুড়ে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ভাঙচুর, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বিএনপি জনগণের আস্থা হারিয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান এখনো লন্ডনে বসে ডিজিটালি দল নিয়ন্ত্রণ করে সংকটের সমাধান করতে পারছে না। সরকার পরিবর্তনের অন্যতম নেপথ্য শক্তি জামায়াত পরিকল্পিতভাবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। সরকারের সমর্থক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ওপর দিকে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো দেশ-বিদেশে সরকারবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়তো সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা সরকারের এখনো সৃষ্টি হয়নি। দুর্বল সরকার মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভর করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পুলিশ এখনো আস্থাহীন হতাশ, আমলাতন্ত্র সুযোগের সন্ধানে, সেনাবাহিনী রাজপথে থাকলেও খুব একটা সক্রিয় বলা যাবে না। প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারত এবং দেশের উন্নয়নে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত চীনের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে সরকার তার নিরপেক্ষ ভূমিকা মসিলিপ্ত করেছে। বাংলাদেশে কখনো শুধু ভারতবিরোধী রাজনীতি হালে পানি পাবে বলে মনে হয় না।
এখনো চার মাস সময় আছে। এখনো সরকার কয়েকজন বিতর্কিত উপদেষ্টাকে পরিবর্তন করে জনস্বার্থে নিরপেক্ষ যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিলে শুভ পরিবর্তন হতে পারে। একমাত্র অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। প্রমাণ হয়েছে অনির্বাচিত খণ্ডকালীন সরকার দেশের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে না। প্রয়োজন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার।