৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:২৭:৪০ অপরাহ্ন


নন্দিত যখন নিন্দিত হয়
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-১১-২০২৪
নন্দিত যখন নিন্দিত হয়


নন্দিত ও নিন্দিত শব্দ দুটির অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। নন্দিত শব্দটিতে একটা হ্রস্ব ই-কার দিলেই এটা নিন্দিত হয়ে পুরো অর্থটাকেই পাল্টে দেয়। প্রসঙ্গটা টানছি নিউইয়র্কের প্রেক্ষাপটে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির গৌরবগাথা আমাদের বুকটা ভরে দেয়। হৃদয়ে প্রশান্তির পরশ বুলায়।

আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্ক সিটির কিউ ট্রেনে ইহুদি যুবক ওয়াল্টার এবং তার বান্ধবীর উপর একদল উচ্ছৃঙ্খল তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওয়াল্টার যখন মার খাচ্ছিলেন, তখন ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে অনেক লোক থাকলেও কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। তখন প্রাণভয় তুচ্ছ করে ওয়াল্টারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন ঢাকার সন্তান হাসান আসকারী। মারপিটে তিনি আহত হলেও শেষ পর্যন্ত এডলারকে রক্ষা করতে সক্ষম হন তিনি। ঘটনাটি জানাজানি হলে আসকারীকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ায় হুলস্থুল পড়ে যায়। রাতারাতি মিডিয়া আইকনে পরিণত হন তিনি।

তারপর প্রথমে জুইশ কমিউনিটি, পরে বিভিন্ন কাউন্সিলম্যান, স্টেট সিনেটর, নিউইয়র্কের তৎকালীন মেয়র মাইকেল ব্লমবার্গ এবং কংগ্রেসম্যান যোসেফ ক্রাউলিসহ অসংখ্য সংগঠন তার বীরত্বের জন্য সংবর্ধনা দেন। আর সর্বশেষ যে খবরটি ইতিহাস গড়ে তাহলো প্রেসিডেন্ট বুশ তার স্টেট অব ইউনিয়ন অ্যাড্রেস অনুষ্ঠানে তাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। আর তিনিই ছিলেন প্রথম বাংলাদেশি যিনি এই বিরল সম্মান পাওয়ার অধিকারী হয়েছিলেন।

এমনি আরো অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি এ ধরনের গল্পগাথার জন্ম দিয়েছেন বহুবার। তাদের সততার কাহিনি মূলধারার সংবাদপত্রেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়াও ফলাও করে সারা পৃথিবীতে প্রচার করেছে। তাদেরই একজন বাংলাদেশি ক্যাব ড্রাইভার ওসমান চৌধুরী। সততার কারণে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে তিনি কয়েক লাখ ডলারের ডায়মন্ড প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তার সততার জয়গান গেয়েছিল বিশ্ব মিডিয়া।

গত কয়েক বছর যাবৎ এই ওসমান চৌধুরী আবার প্রবাসী মিডিয়ায় খবর হচ্ছেন। তবে নেতিবাচক খবরের জন্ম দিচ্ছেন তিনি প্রতি বার। বাংলাদেশ সোসাইটির বিরুদ্ধে মামলা করে নির্বাচন আটকে দিয়েছিলেন কয়েক বছরের জন্য। এবারও সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনের মাত্র দুদিন আগে নির্বাচন বন্ধ করতে আদালতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে যে কারণেই হোক মামলা নথিভুক্ত না করে আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন।

মামলা না করলেও তার এই মামলা চেষ্টার জন্য অনেকে প্রবাসী তার সমালোচনা করেছেন। অনেককেই বলতে শোনা যায়, এক সময়ের একজন নন্দিত ব্যক্তি যখন জনগণের কাঠগড়ায় এভারে নিন্দিত হতে হয়, তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

হ্যালো, ইউ!

সুপার মার্কেট থেকে বাজার করে বের হচ্ছিলাম। সামনেই একটা গাড়ি পার্ক করা। নম্বর প্লেটে লেখা-হ্যালো, ইউ। মনে হলো, যেন কেউ আমাকে বলছে, হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। থামলাম এবং গাড়িটার পাশে একটু দাঁড়ালাম। ভাবলাম, দেখি এর মালিক কে। একটু পরই একজন তরুণ বেরিয়ে দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ছেলেটির চেহারা সাদা। বয়স ২৫-২৮ এক কোঠায়। হ্যালো ইউ। একেবারেই সাদামাটা দুটি শব্দ। তারপরও মনটা কেমন যেন নাড়া দিয়ে যায়।

প্রসঙ্গটা টানলাম এজন্য যে, গত কয়েক দিন আগেও গাড়ির নম্বর প্লেট নিয়ে লিখেছি। দুটি নম্বর প্লেটই দু’জন বাংলাদেশি তরুণের। একটায় লেখা ছিল-তোর বাপ। অন্যটিতে দূর শালা।

আপনাদের কাছেই প্রশ্ন রাখছি, কোনটা শুনতে ভালো লাগে? হ্যালো, ইউ? না-তোর বাপ বা দূর শালা! আমরা কি আমাদের সন্তানদের, স্বজনদের চলনে-বলনে মানবিকতায় একটু আদর্শ হতে বলতে পারি না?

জনগণ কার খালু রে!

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি।

এক বেকুব লোক মনস্থির করলো তার শ্যালিকার বাড়ি বেড়াতে যাবে। বউ ভাবলো, স্বামী বোকাসোকা মানুষ, যদি তার বোনের বাড়ি চিনতে না পারে। এজন্য বললো, তুমি সোজাপথ ধরে হাঁটবে। কতদূর গিয়ে একটা খাল। নৌকা দিয়ে খাল পার হবে। খালের পাড় দিয়ে সোজা হাঁটতে থাকবে, হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় বাজার দেখবে। বাজারের দক্ষিণ পাশে একটা বড় বটগাছ। সেই বটগাছের সোজা পশ্চিম দিকের বাড়িটা হলো আমার বোনের বাড়ি অথবা বাজারে গিয়ে আমার বোনের ছেলের নাম ‘হামজু মিয়া’র বাড়ি কোথায় বললে, লোকে দেখিয়ে দেবে।

বেকুব লোকটি তার স্ত্রীর কথামতো হাঁটতে শুরু করলো। নৌকা দিয়ে খাল পার হলো, আবার হাঁটলো। হ্যাঁ, একটা বাজার দেখতে পেলো। হাটের পশ্চিম কোণে বটগাছটাও দেখলো। কিন্তু এতো পথ অতিক্রম করতে গিয়ে বেকুব ‘হামজু মিয়া’ নামটা ভুলে বসলো, এর সঙ্গে বটগাছের কোনদিকে বাড়ি সেটাও ভুলে গেল। কোনো রকমেই মনে করতে পারছে না। বাজারের লোকজনকে কীভাবে জিজ্ঞাসা করবে, সেটারও কোনো উপায় খুঁজে পেলো না।

অবশেষে বেকুব বটগাছের ওপর উঠে চিৎকার করতে লাগলো, ‘আমি কার খালু রে, আমি কার খালু রে?’

গল্পটা আরো বড়। আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না। যে কারণে গল্পটা বলা এখন সেদিকে যাই।

আমরা যারা আমজনতা, সাধারণ মানুষ, আমাদের অবস্থাও ওই বেকুবের মতোই। আমাদের কথাও কেউ বোঝে না। আর যদি সাহস করে একবার বোঝাতে চাই, দশবার ভাবতে হয়। কারণ কারো যদি গায়ে লাগে তো প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

যদি আওয়ামী লীগ নিয়ে কিছু বলি তো ছাত্রলীগের হামলার ভয়, যদি বিএনপিকে নিয়ে কিছু বলি তো ছাত্রদলের হামলার ভয় আর জামায়াত-শিবিরের নাম বললে..।

এই হামলা মামলার ভয়ে আমরা আমজনতাকে হাবলা হয়েই থাকতে হয়। আর দিগবিদিক হরিয়ে মাঝেমধ্যে ‘আমি কার খালু রে?’ এটা জিকির করতে হয়।

কথাটা বললাম সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড দেখে। গত ১৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠন জ্যাকসন হাইটসে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। সে সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ দাবি করে বলেন, দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায় শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা আর এটাই জনগণের বিশ্বাস।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ড. সিদ্দিকুর রহমান কি বাংলাদেশের জনগণের ইজারা নিয়েছেন? তিনি বা তার দল যা ভাবে বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণও কি তার সুরে সুর মিলিয়ে একই ভাবনা ভাবেন? এসব দেখে শুনে সেই হাবলা বেকুবের মতো বটগাছের ওপর উঠে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-জনগণ কার খালু রে!

শেয়ার করুন