সুষ্ঠু নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক প্রশাসনিক সর্বক্ষেত্রে সংস্কারে প্রশ্নে হার্ড লাইনেই থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ-প্রশ্নে কোনোভাবেই যেনো সরকারের অবস্থান নড়বড়ে বা দুর্বল না হয় সেজন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সক্রিয় ভূমিকা রাখবে, থাকবে পাশে। এধরনের খবর পাওয়া গেছে, বেশ কয়েকটি দায়িত্বশীল সূত্র থেকে।
কেন হার্ড লাইনে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হলো বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এটা গঠিত হয়। এই কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ছাত্র-জনতার সেই অভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। তবে সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের করে সফল হলেও আসলে তাদের আরো অনেক লক্ষ্য রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে আভাস পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্তরা বিগত ১৭ বছর ছাড়াও অতীতে বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দল, জোটের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের শাসনামল পর্যালোচনায় রেখেছে। তারা মনে করে, দেশের ভবিষ্য প্রজন্মকে শক্ত ভিতরে ওপর দাঁড় করাতে হলে এখন আর বিগত দিনগুলির রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে পক্ষের তা সম্ভব না, মুখে মুখে তারা যতো সুন্দর সুন্দর বয়ান দিক-না কেনো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সর্ম্পৃক্ত একজন ছাত্র-নেতা দেশ প্রতিনিধির সাথে একান্তে কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, তাদের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের ওপর আস্থা নেই। তারা মনে করে, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে গত ১৭বছরের ফ্যাসিবাদি জেকে বসে আছে । এধরনের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা অপসারণে যথেষ্ট সময় এবং ভালো সংস্কার করতে হবে। এবং এর পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সংস্কারের সুপারিশ বা বাস্তবায়ন করবে তা যে ভবিষ্যতে চলমান থাকবে তার নিশ্চয়তায় ভবিষ্যতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ইস্পাত কঠিন শপথ নিতে হবে। কেননা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিচারে বা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেয়া বহু সংস্কার কর্মসূচি বা তাদের সুপারিশ পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে কোনো সরকারই তা গ্রহণ করেনি। তার মতে, এইবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এইবার যেনো কেউই এই সুযোগ না পায় সেব্যাপারে তারা সজাগ এবং ভালো দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের পথে হাটবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্পৃক্তরা।
আওয়ামী ঠেকাতেই সংস্কার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত আরো বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে ভবিষ্যতের বেশ কিছু পরিকল্পনা। জানা গেছে, তারা চায় যেনো কোনে ভাবেই কোনো ধরনের প্রক্রিয়ায় যেনো পতিত আওয়ামী লীগ বা তার সমর্থিত কেউ ক্ষমতার ধারে কাছে ভিড়তে না পারে। তারা মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি শক্তভাবে সংস্কার কর্মসূচি চালিয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যতে শুধু আওয়ামী লীগ না কোনো ধরনের ফ্যাসিবাদই বাংলার জনগনের ওপর জেকে বসবে না বা বসার সুযোগই পাবে না।
রাজনৈতিক দলের ওপর সংস্কার ছেড়ে দিতে চায় না
এদিকে আরো জানা গেছে বৈষ্যম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র নেতারা মনে করেন রাষ্ট্রক্ষমতাকে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক করতে নেয়া সংস্কার কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর তারা ছেড়ে দিতে চায় না। তারা মনে করেন, ক্ষমতায় বসে অতীতের মতোই যে কোনো রাজনৈতিক দলই তার অতীত প্রতিজ্ঞা রাখবে না। তাই যৌক্তিকভাবে সর্বক্ষেত্রে সংস্কার করা না হলে ক্ষমতায় গিয়ে ওই সব রাজনৈতিক দল সব ভুলে গিয়ে গায়ের জোরেই দেশ চালাবে। আর ওই সময় এমন ধরনের কার্যক্রমের প্রতিবাদে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করবে না। এছাড়া বেসরকারি টিভি চ্যানেল এক সাক্ষাৎকারে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও বলেছেন, বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকভাবে মাঠে থাকার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) একটা গণহত্যা করেছে। তাদের সত্যটা স্বীকার করতে হবে। তাদের বিচারে অংশগ্রহণ করতে হবে। বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে মাঠে থাকার কোনো অধিকার ও সুযোগ নেই।
জরিপ যা বলে
এদিকে সম্প্রতি গণমাধ্যমে একটি জরিপ প্রকাশ পেয়েছে। ভয়েস অব আমেরিকার নেতৃত্বে পরিচালিত ওই জরিপে আগামী এক বছরের মধ্যে নির্বাচন চান ৬১.১% মানুষ, সব সংস্কার শেষে নির্বাচনের পক্ষে ৬৫.৯% মত দেয়া হয়ে বলে তথ্য প্রচার করা হয়। গণমাধ্যমে থেকে নেয়া ওই তথ্যে দেখা যায় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, এক বছরের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। তবে এর পাশাপাশি আরেকটি তথ্যে কিন্তু সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছে বেশি সংক্ষক উত্তর দাতা। বেশির ভাগ মানুষ (৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ) বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যা যা সংস্কার করা প্রয়োজন মনে করবে তার সবগুলো করার পরই নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। আর শুধু নির্বাচন সংক্রান্ত জরুরি সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতার।
সংস্কার নিয়ে সরকারের সর্বশেষ তথ্য
এদিকে সংস্কারের পধেই যে সরকার জাটবে তার আরো কিছু নমুনা মিলেছেন। গণমাধ্যমের খবরেই জানা গেলো যে, প্রয়োজনীয় (অ্যাসেন্সিয়াল) সংস্কারের পর নির্বাচন আয়োজন করবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাই এখনই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা জানাতেও চাননি নতুন সিইসি। জাতীয় সংসদ নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হবে সেই বিষয়েও প্রশ্নেরও সরাসরি জবাব দেননি এই ইসি। এদিকে আরেকটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কারে সরকারের হাত চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে কাজও শুরু করেছে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত বেশ কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’। জানা গেছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সংবিধান ও নির্বাচনি সংস্কার। সংবিধান সংস্কার কমিশন পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, আনুপাতিক ভোটিং, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোসহ বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে পাওয়া গেছে। জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়া, প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার বিধান চালু, ইভিএম বাতিল এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে সংশ্লিস্টরা মনে করেন। এদিকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমরা যে সব বিষয় সংস্কারের কাজ শুরু করেছি সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে আগামীতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।
শেষ কথা
সুষ্ঠু নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক প্রশাসনিক সর্বক্ষেত্রে সংস্কারে প্রশ্নে হার্ড লাইনেই যে থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাঁটছে তা-র সর্বশেষ প্রমাণ মিলেছে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে। তিনি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এক সাক্ষাৎকারে একদম পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন সরকার কোনো দলের কাছে নয়, জনগণের আকাঙ্খার কাছে দায়বদ্ধ। তাই দ্রুত নির্বাচনের জন্য যতোই চাপ দিক, সংস্কার কমিশনের কাজের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচনের দিকে এগুবে সরকার। যদিও তিনি তার বক্তব্যটি গণমাধ্যম প্রসঙ্গে বলেছেন, তবে তা সেই বক্তব্যে যে আরো অন্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, গণমাধ্যম সংস্কারে গঠিত কমিশন এমন আইন করবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ গণমাধ্যমে খবরদারি চালাতে না পারে। এদিকে একটি সূত্র জানায় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর মাঠের কোনো রাজনৈতিক দল বা মত যেনো কোনো প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেজন্য অতন্দ্র প্রহরীরর মতো কাজ করবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। হার্ড লাইনে থাকতে সারা দেশে কমিটি গঠনও শুরু করে দিয়েছে। আর একারণ ছাড়া আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সারা দেশে সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তৃতির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১৬৪, শেরপুর জেলায় ১২৬ , কুমিল্লা জেলায় ২৯৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জেলা পর্যায়ে এটি তাদের দশম আহ্বায়ক কমিটি। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল নিশ্চিত যে, সংস্কার প্রশ্নে ও ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ বা খবরদারি রুখতে দেশের প্রতিটি সেক্টরেরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হার্ড লাইনে থাকবে তা স্পষ্ট।