২৫ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ০৪:১৪:৫৯ অপরাহ্ন


নাশকতার আশঙ্কায় ভাসছে দেশ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-১০-২০২৫
নাশকতার আশঙ্কায় ভাসছে দেশ শাহজালাল এয়াপোর্টে আগুন


একের পর এক আশঙ্কাজনক ঘটনা ও পরিস্থিতিতে নানান কানাঘুষা রাজনৈতিক অঙ্গনে। কি হচ্ছে কেনো হচ্ছে? সরকার কি ব্যর্থ? নাকি সামাল দিতে পারছে না তারা। সামনে কি আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে কি-না তা নিয়ে শঙ্কায় দেশবাসি। মোট কথা পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে ভেসে বেড়াচ্ছে নাশকতা আশঙ্কার পাশাপাশি উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। এটা যেমন এখন সরকারের কথা বার্তায়, চলনে বলনে, তেমনি দেশবাসীর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। আবার জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করলেও জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি দল সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে নামার খবরেও বিচলিত দেশবাসী। এমনটাই মনে করা হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে বিশিষ্টজনের পাশাপাশি জনগণের সাথে কথা বলে। 

সংক্ষেপে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা

চলতি সপ্তাহে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে গেছে। সে-ই আগুন ২৬ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নিভেছে। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়েছে গেছে বলে খবর বেরিয়েছে। ২০ অক্টোবর সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী নেতারা এই ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির বিশাল বিবরণ দিয়েছেন। তারা জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ শিল্পের ২৮ কোটি টাকা ও ওষুধশিল্পের ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়েছে। ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পের সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ব্যবসায়ী সমাজ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য এক বড় সতর্কবার্তা। আমরা শঙ্কিত এবং বৈদেশিক ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন।

এদিকে আগুন নিয়ে যখন তোলাপাড় দেশবাসী তখন দেখা যাচ্ছে আরেকটি মারাত্মক আশঙ্কাজনক খবর। সে-টি হচ্ছে দেশে চাঁদাবজিতে অতিষ্ঠ্য হয়ে যাওয়ার খবর। রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকায় চাঁদা দাবি ও ককটেল হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে আধাবেলা গাড়ির শোরুম বন্ধ রেখে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন পুরোনো গাড়ি ব্যবসায়ীরা। ১৯ অক্টোবর রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কর্মসূচি পালন শেষে বাড্ডা এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে করেন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) নেতারা। ৩০ অক্টোবরের মধ্যে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে-নভেম্বর থেকে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা। প্রশ্ন হচ্ছে এমন কর্মসূচির পেছনে কি থাকতে পারে? কেনো এখন ব্যবসায়ীরা এই দাবিতে নামতে বাধ্য হলেন? কারা এর জন্য দায়ী। এটা কি বিএনপি ঘাড়ে পড়ে না?

অসহায় এ. কে. আজাদ

রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি ঘটনাও আতঙ্কিত করে তুলেছে দেশবাসীক। যেখানে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে দলটি সন্ত্রাস চাদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে, সেখানে ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদের গণসংযোগে কি করে হামলার ঘটনা ঘটে? জানা গেছে,কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক নায়াব ইউসুফের পক্ষে শ্লোাগান দিয়ে এই হামলা চালানো হয়। হামলায় আহত হয়েছেন একজন। এমনকি হামলাকারীরা এ. কে. আজাদের বহরের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে। গত ১৯ অক্টৈাবর রোববার বিকেলে ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণ নগর ইউনিয়নের পমানন্দপুর বাজার এলাকায় হামলার ঘটনাটি ঘটে। এমন ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ. কে. আজাদ। তবে আশ্বর্যজনক হলে সত্য যে, পুলিশ এসে যুবদলের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে কোনোভাবেই তাদের দাপট হুমকি ধামকির কাছে আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিতরা টিকতে পারেনি। উল্টো তাদের সাথেই তর্ক-বিতর্ক শুরু করে দেয়। উপায় না পেয়ে পুলিশই এ. কে. আজাদ অনুরোধ করেন ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে। এব্যাপারে এ. কে. আজাদ বলেন, ‘রাজনীতিতে এমন সহিংসতার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। গত নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকও এমন আচরণ করেননি। নায়াব ইউসুফের কাছ থেকে এমন আচরণ এলাকাবাসী প্রত্যাশা করে না। এটি রাজনৈতিক সংকটকে ঘণিভূত করবে।’ 

আর একের পর এমন খবরে যখন জনগণ বিচলিত তখন বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মারধরের ঘটনা ঘটেছে। রোববার বিকেলে সিলেট বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক হেনন্তার শিকার হন। যদিও এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তারপরেও প্রশ্ন এই সময়ে অত্যন্ত সর্তক তখন খোদ বিএনপি’র কার্যালয়ে এমন ঘটনা কি করে ঘটে। জানা গেছে, ঘটনার সময় একজন সাংবাদিক বলেন, আমি ভিডিও করছিলাম। হঠাৎ ৩-৪ জন এসে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। তারা আমার মোবাইল ভেঙে ফেলে, প্রেস কার্ড কেড়ে নেয়। আমি জানাই যে ভিডিও করা নিষেধ হলে আমি মুছে ফেলব, কিন্তু কোনো কথা না শুনেই তারা আমাকে মারধর করে কার্যালয়ের বাইরে বের করে দেয়।’

আগুন চাঁদাবাজিদের উৎপাতের খবরে বিচলিত হতে না হতে ২০ অক্টোবর সোমবার আরেকটি খবরে আতঙ্কিত হয়ে উঠে দেশবাসী । তা হলো বগুড়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের উপস্থিতিতে দলের সমন্বয় সভাস্থলে ককটেল হামলার ঘটনা। পুলিশ বলছে, হামলাকারীরা পরপর দুটি ককটেল ছোঁড়ে। এর মধ্যে একটি বিস্ফোরিত হয়। অবশ্য এনসিপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, হামলাকারীরা তিনটি ককটেল নিক্ষেপ করে। যার মধ্যে দুটি বিস্ফোরিত হয়।

জরুরি নির্দেশনায়ও আতঙ্ক

এদিকে খবর বেরিয়েছে যে, সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিটকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায়থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় টহল ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এমন নির্দেশনায় বলা হয় যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এমন অবস্থায় দেশের আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) লক্ষ্য করে হামলা হতে পারে। এদিকে সারা দেশে সাম্প্রতিক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক হলেও এই সময়ে এমন নির্দেশনা অনেককে আতঙ্কিত করেছে। 

নাশকতার আশঙ্কায় ভাসছে দেশ?

তাহলে কি ধরে নেয়া যায় পুরো দেশটা এখন নাশকতার আশঙ্কায় ভাসছে দেশ? এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় সাধারণ জনমনে নানান ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা বিমান বন্দরে এখন প্রশ্ন উঠেছে আগুন নেভাতে এত দীর্ঘ সময় কেন লাগল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ী ও ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দ্রুতই ঘটনাস্থলে পৌঁছান। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় এক ঘন্টার বেশি সময় তাঁরা বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকতে পারেননি। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো কমপ্লেক্স ভবনে। 

এদিকে তৈরি পোশাকশিল্পকে অস্থিতিশীল করতে নাশকতার সন্দেহ ক্রমেই বাড়ছে বলে খবর বেরিয়েছে। কারো কারো সন্দেহ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবার পোশাকশিল্প কে টার্গেট করা হচ্ছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে গত এক সপ্তাহে অগ্নিকান্ডের ধরন ও প্রেক্ষাপট। এখন ও-ই সন্দেহকে জোরালোই হচ্ছে সামনে আর কি অপেক্ষা করছে। শিল্পমালিকদেরও ধারণা, দেশের অর্থনীতি মেরুদন্ড ভেঙে দিতে টার্গেট করে গার্মেন্টস শিল্পে আগুন লাগানো হচ্ছে, যা এই শিল্পকে ধ্বংসের জন্য ভয়াবহ একটি অপচেষ্টা হতে পারে। ব্যাবসীদের ধারণা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে ধ্বংসে পরিকল্পিতভাবে অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে। কেননা বিমানবন্দরের মতো উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা অস্বাভাবিক। এটা পরিত্যক্ত কোনো গোডাউন বা কারখানায় ঘটলে হয়তো এই প্রশ্ন উঠত না। বলা হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে অশান্ত করতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে, এখনকার পরিবেশ পরিস্থিকি ভিন্ন ধরণের। কারণ মাত্র কিছুদিনে আগে দেশে একটি বড়ো ক্ষমতাধর শক্তির পরতন ঘটেছে। একারণে বলা হচ্ছে পতিত ফ্যাসিআদী সরকারের বিভিন্ন সুবিধাভুগীরা বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে, এসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নসাৎ করা। অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষত পুলিশকে এ ব্যাপারে খুব বেশি সক্রিয় দেখা যায়নি। এখনো পুলিশ পূর্ণোদ্যমে কাজে ফিরতে পেরেছে বলে মনে হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে এমন অবস্থায় জনগণ তাহলে কি করবে।.. জনগণ আতঙ্কিত কি আতঙ্কিত? সরকার কি এসবের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারেন না? যদি পারতেন তাহলে কি বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) নেতারা চাঁদা দাবি ও ককটেল হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে আধাবেলা গাড়ির শোরুম বন্ধ রাখতে পারতেন? 

এদিকে সর্বশেষ আরেক খবর জনমণে নানা ধরণের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাহলো আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে নতুন মতামত দিয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানান গেছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া ঋণের ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড় করবে না। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করবে। এরপর চলমান সংস্কার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় করেই ঋণের অর্থ ছাড় করতে চায়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, একদিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা যেমন দেশবাসিকে আতঙ্কিত করছে, তেমনি ব্যবসায়ি মহলকে নতুন করে ভাবাচ্ছে ...আসলেই তারা এখন কোন দিকে হাঁটবে বা হাঁটছেন?

অস্থিরতা রাজনৈতিক অঙ্গনেও

এদিকে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করলেও জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি দল সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে। যা নিয়ে সন্দেহ দানা বাধছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কেননা দলগুলো আগামী ২০ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায়, ২৫ অক্টোবর সব বিভাগীয় শহরে, ২৭ অক্টোবর জেলা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এনিয়েও রয়েছে নানান কানাঘুষা...। রয়েছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা..।

শেয়ার করুন