৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৩৭:৪৩ অপরাহ্ন


ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিয়ে চাকরি হারালেন তিন শিক্ষক
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-১২-২০২৪
ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিয়ে চাকরি হারালেন তিন শিক্ষক বালদি মিডল স্কুলের প্রাক্তন তিন শিক্ষক ক্যারোলিন ইয়ং, এমিলি এনট্রিলি এবং জর্ডান কার্ডাস।


ফিলাডেলফিয়ার বালদি মিডল স্কুলের তিন শিক্ষক ক্যারোলিন ইয়ং, এমিলি এনট্রিলি এবং জর্ডান কার্ডাস ক্লাসে ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি স্কুল প্রশাসনের বৈষম্যর বিরুদ্ধে সহানুভূতি এবং সমর্থন জানিয়ে চাকরি হারিয়েছেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষক হিসেবে তাদের ভূমিকা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। গাজা সংঘাতের প্রেক্ষাপটে, যখন অনেক শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবার সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তখন এই শিক্ষকদের পদক্ষেপের কারণে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া ছিল। এই ঘটনাটি স্কুল প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষতার দাবি ও শিক্ষকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে স্পষ্ট সংঘাতের ইঙ্গিত দেয়।

স্কুলের তিন শিক্ষক সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা দফতরের সিভিল রাইটস অফিসে (ওসিআর) একটি ফেডারেল অভিযোগ দায়ের করেছেন। শিক্ষকরা ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য নিজেদের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ, স্কুল প্রশাসন ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য চালাচ্ছে এবং ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার এবং সহানুভূতি প্রদর্শনকারীদের প্রতি কোনো সহায়তা প্রদান করছে না।

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে বেশ কিছু ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী গাজার ওপর ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাদের সমর্থনে ইয়ং, এনট্রিলি এবং কার্ডাস শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য তাদের স্কুলে পোস্টার তৈরি করতে দেন। পোস্টারগুলোতে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন’ এবং ‘যুদ্ধবিরতি চাই’-এর মতো শান্তির আহ্বান জানানো হয়েছিল। শিক্ষকদের মতে, তারা ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পোস্টারগুলো নিজেদের হাতে স্কুলের কমন্সে ঝুলিয়ে দেন। তবে, দুই ঘণ্টার মধ্যেই স্কুল প্রশাসন পোস্টারগুলো সরিয়ে ফেলেছিল। এর পরবর্তী দিনগুলোতে, প্রধান শিক্ষিকা তাদের জানিয়েছিলেন যে তারা তদন্তের অধীনে আছেন।

শিক্ষকরা শাস্তি হিসেবে পাঁচ দিনের বেতনহীন ছুটি এবং অন্য স্কুলে বদলি হওয়ার শাস্তি পান। তাদেরকে ডাইভারসিটি, ইক্যুইটি এবং ইনক্লুশন অফিস থেকে পরামর্শ নিতে বলা হয় এবং তাদের সতর্ক করা হয় যে আরো কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে আরো কঠোর শাস্তি হতে পারে, এমনকি পদচ্যুতিও হতে পারে। শিক্ষকরা বলেন, আমরা ভেবেছিলাম ফিলিস্তিনি ছাত্রদের সঙ্গে বৈষম্যের বিরুদ্ধেএ স্কুল প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করব, কিন্তু এটি শাস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

শিক্ষক ক্যারোলিন ইয়ং তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রশাসন অভিযোগ করেছিল যে পোস্টারে থাকা লাল হাতের ছাপ এবং ফিলিস্তিনে নিহত শিশুদের নাম হুমকির মতো ছিল, যদিও ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তির পক্ষে কথা বলা। এছাড়াও তিনি অভিযোগ করেছেন যে তাদের ওপর তদন্তচলাকালীন সময়ে তাদের সম্মান ও নিরাপত্তার যথাযথ যত্ন নেওয়া হয়নি। বালদি স্কুলে আরো ঘটনা ঘটেছে, যেমন ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক শিক্ষক এক মুসলিম ছাত্রের হিজাবের জন্য তাকে অপমান করেন। শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরাও অভিযোগ করেছেন যে ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদ বা সমর্থন প্রকাশের জন্য তাদের অবহেলা বা বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।

তিনজন শিক্ষক তাদের অভিযোগে আরও দাবি করেছেন যে, স্কুল জেলায় ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধে একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা এবং ‘স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন’ ক্লাব প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হোক। এছাড়াও শিক্ষকরা জানিয়েছেন যে তাদের শাস্তির পিছনে যে উদ্দেশ্য ছিল তা ছিল ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন দেখানো। শিক্ষকরা যুক্ত করেছেন, ‘আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতার পক্ষে কথা বলেছি, এবং তারা আমাদের সঙ্গে ছিল। এখন, আমরা চাই স্কুল প্রশাসন এবং জেলা তাদের ভুল স্বীকার করে, এই বৈষম্য বন্ধ করুক।’

এই ঘটনা শুধু বালদি মিডল স্কুলের সমস্যা নয়, বরং বৃহত্তর একটি মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে, যা ফিলিস্তিনি এবং মুসলিম ছাত্রদের প্রতি বৈষম্যের প্রচলিত অবস্থা তুলে ধরে। ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর মোহাম্মদ নামে এক শিক্ষার্থী নিয়মিত ’ফ্রি গাজা’ লেখা ব্রেসলেট পরতেন এবং কাঁধে প্যালেস্টিনীয় কেফিয়েহ রাখতেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বারবার এটি খুলে ফেলতে বলেছিল। মোহাম্মদের মা মারিয়ামের মতে, মোহাম্মদ তার পরিচয় নিয়ে গর্বিত ছিল এবং চাপ থাকা সত্ত্বেও সে পিছু হটেনি। গাজায় চলমান সহিংসতায় অনেক শিক্ষার্থী তাদের আত্মীয়স্বজন হারানোর ফলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। এই পরিস্থিতি দেখে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ও সমর্থনমূলক পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন এই তিন শিক্ষক।

ঘটনাটি তীব্র আকার ধারণ করে ২০২৩ সালের নভেম্বরে, যখন ক্যারোলিন ইয়ং শিক্ষার্থীদের ক্লাসে প্যালেস্টিনীয়দের সমর্থনে পোস্টার বানাতে দেন। পোস্টারগুলোতে লেখা ছিল, ‘অ্যান্ড অ্যাপারথেইড,’ ‘এটি যুদ্ধ নয়, এটি গণহত্যা,’ এবং ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি।’ পোস্টারগুলোতে প্যালেস্টিনীয় পতাকার রং ও প্রতীকী চিত্রও ছিল। পোস্টারগুলো কমনরুমে প্রদর্শন করা হয়, কিন্তু মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই স্কুল প্রশাসন সেগুলো সরিয়ে ফেলে। তাদের দাবি ছিল, এই বিষয়বস্তুটি ইহুদি শিক্ষার্থীদের জন্য হুমকির পরিবেশ তৈরি করেছে।

এই ঘটনার পর অন্য শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, এই তিনজন শিক্ষক কর্মস্থলে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন এবং তারা ‘আন্তঃধর্মীয় উত্তেজনা’ বাড়িয়ে তুলেছেন। স্কুলের প্রিন্সিপাল বিয়ানকা গিলিস অভিযোগ করেন, শিক্ষকরা গাজার যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার স্কুল নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন এবং প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া পোস্টার তৈরি করতে দিয়েছেন। শাস্তি হিসেবে তিন শিক্ষককে পাঁচদিনের জন্য বেতন ছাড়া বরখাস্ত করা হয় এবং অন্য স্কুলে বদলির সুপারিশ করা হয়।

তবে শিক্ষকরা এই সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং শেষমেশ চাকরি ছেড়ে দেন। ক্যারোলিন ইয়ং বলেন, প্যালেস্টিনীয় ছাত্রদের পাশে না দাঁড়ালে নিজের কাছে সৎ থাকতে পারতাম না। এমিলি এনট্রিলি, যিনি এখন ক্যামডেনের একটি চার্টার স্কুলে শিক্ষকতা করছেন, বলেন, তিনি বালদি মিডল স্কুলে দীর্ঘ ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু এই ঘটনার পর থাকা সম্ভব হয়নি।

এই তিন শিক্ষক এখন মার্কিন শিক্ষা অধিকার দফতরে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাদের অভিযোগ, স্কুলটি মুসলিম, আরব এবং প্যালেস্টিনীয় ছাত্রদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, শিক্ষার্থীদের বাকস্বাধীনতা দমন করেছে এবং শিক্ষকদের তাদের ছাত্রদের সহায়তা করার কারণে শাস্তি দিয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, রমজান মাসে মুসলিম শিক্ষার্থীদের নামাজের সময় সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং প্যালেস্টিনীয় কেফিয়েহ পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যদিও স্কুলে ইসরায়েলের পতাকা ও অন্যান্য প্রতীক প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষকরা দাবি করেছেন, বালদি মিডল স্কুলে দ্বৈত মানদ- কাজ করছে। তারা উল্লেখ করেন, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় স্কুলে ইউক্রেনের সমর্থনে শিক্ষার্থীদের তৈরি আর্টওয়ার্ক প্রদর্শিত হয়েছিল। কিন্তু প্যালেস্টিনের সমর্থনে তৈরি কোনো কিছুকেই প্রশাসন গ্রহণ করেনি এবং বরং বিতর্কিত বলে চিহ্নিত করেছে।

মোহাম্মদের মা মারিয়াম বলেন, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ানোয় চাকরি হারিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে স্কুলটি তার সন্তানের জন্য নিরাপদ স্থান নয়। এই ঘটনা শুধু বালদি মিডল স্কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি বৃহত্তর বাকস্বাধীনতা, সাম্য, এবং মার্কিন স্কুলগুলোতে প্যালেস্টিনীয় ও মুসলিম শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছে। শিক্ষার্থীদের অধিকার ও শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে চলমান এই লড়াই এখন শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায্যবিচারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শেয়ার করুন