নিউইয়র্ক সিটির দুই মুসলিম ছাত্রী, জারমিন আজম (২০) ও শাজনিন হাওলাদার (১৯), নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) বিরুদ্ধে গত ১০ মার্চ ফেডারেল আদালতে মামলা করেছেন। মামলাটি ইউএস সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অফ নিউইয়র্কের দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে গাজা সংঘর্ষের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের হিজাব জোরপূর্বক খুলে ফেলেন, যা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করেছে। এই মামলা দায়ের করেছে ক্ষতিগ্রস্ত দুই ছাত্রীর পক্ষে কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস নিউইয়র্ক (কেয়ার) এবং আইন সংস্থা এমেরি সেলি ব্রিঙ্কারহফ আবাদি ওয়ার্ড ও মাজেল এএলএএলপি।
মামলায় বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সময় পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের ওপর নির্মম আক্রমণ চালিয়েছেন, যা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত মর্যাদার গুরুতর লঙ্ঘন। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট, জারমিন আজম ও শাজনিন হাওলাদার নিউইয়র্কে একটি ফান্ড রেইজারের বাইরে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিলেন। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিবাদটি নিউইয়র্ক সিটির মেট্রোপলিটান রিপাবলিকান ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত হয়, যা আপার ইস্ট সাইডে অবস্থিত। এখানে বিভিন্ন নির্বাচিত কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে একটি ফান্ড রেইজার চলছিল। কিছু সময় পর, প্রতিবাদকারীরা একটি নতুন স্থানে চলে যায়, যেখানে নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)-এর বিশাল উপস্থিতি ছিল, যার মধ্যে ছিল এনওয়াইপিডির বিতর্কিত স্ট্র্যাটেজিক রেসপন্স গ্রুপের কর্মকর্তারা। পুলিশ প্রতিবাদকারীদের ঘিরে ফেলে এবং তাদের শরীর ও সাইকেল ব্যবহার করে ধাক্কা দেয়। এই স্থানে জারমিন আজম এবং শাজনিন হাওলাদারের ওপর আক্রমণ ঘটে, যেখানে তাদের হিজাব জোরপূর্বক খুলে ফেলা হয়।
মামলার নথি অনুযায়ী, অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ রুয়েল স্টিফেনসন বিক্ষোভ চলাকালে জারমিন আজমের গলায় তার হিজাব চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে টেনে নিয়ে যান। আজম বলেন, আমি এত ব্যথা পাচ্ছিলাম যে মনে হচ্ছিল আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। আমি আমার স্কার্ফ ঢিলা করার চেষ্টা করছিলাম যাতে শ্বাস নিতে পারি। অন্যদিকে শাজনিন হাওলাদার অভিযোগ করেন, সার্জেন্ট জোসেফ স্পল্ডিং তার হিজাব জোরপূর্বক টেনে খুলে ফেলেন, যা তার গলায় পেঁচিয়ে যায়। শাজনিন বলেন, এটা যেন আমাকে জনসমক্ষে লাঞ্ছিত করা হলো। আমি এখনো সেই মুহূর্তের কথা মনে করে কাঁপি, যখন এতগুলো চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
সার্জেন্ট জোসেফ স্পল্ডিং, শাজনিনের হিজাব টেনে এমনভাবে গলা পেঁচিয়ে ধরেন যে, তিনি শ্বাস নিতে পারছিলেন না। ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’ বলে চিৎকার করলেও অফিসার তার হাত ছাড়েননি। অবশেষে অন্যান্য প্রতিবাদকারীরা হস্তক্ষেপ করে তাকে মুক্ত করেন, কিন্তু এর আগেই তিনি পিপার স্প্রের শিকার হন। শাজনিন বলেন, সেদিন বাড়ি ফিরে আমি সম্পূর্ণরূপে আতঙ্কিত ছিলাম। আমার শরীর ব্যথায় ভরা ছিল, চুলের গোড়ায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, এবং রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমি ন্যায়বিচার চাই, যেন আর কোনো হিজাবি নারী এই নির্যাতনের শিকার না হন।
অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ রুয়েল স্টিফেনসন জারমিনকে গলা চেপে ধরে টানতে থাকেন, একহাতে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করতে করতে অন্য হাতে লাঠি ছোঁড়েন। তার হিজাব ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং তাকে জনসমক্ষে উন্মুক্ত করে রাখা হয়। পুলিশ প্রিসিঙ্কটে তাকে হিজাব পুনরায় পরার সুযোগ দেয়নি; বরং একজন অফিসার তার স্কার্ফের অংশ তার মুখে ছুড়ে মারেন। জারমিন বলেন, আমার হিজাব আমার বিশ্বাস, পরিচয় এবং মর্যাদার প্রতীক। এনওয়াইপিডি সেটি ছিঁড়ে ফেলার মাধ্যমে আমাকে সম্পূর্ণরূপে অপমান করেছে। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলাম। কিন্তু এটি শুধু আমার ঘটনা নয়, এটি প্রতিটি হিজাবি নারীর বাস্তবতা যারা প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেন।
আইনি প্রতিক্রিয়া ও দাবি
কেয়ার নিউইয়র্কের আইনজীবী ক্রিস্টিনা জন বলেন, এই ধরনের আচরণ মুসলিম নারীদের প্রথম সংশোধনী অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। এটি একটি কৌশল যা নারীদের মুখ বন্ধ করতে চায়, কিন্তু আমরা ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করব। এই মামলায় নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের নীতিতে পরিবর্তন আনার দাবি করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে কখনোই জনসমক্ষে কোনো মুসলিম নারীর হিজাব জোরপূর্বক সরিয়ে ফেলা না হয়। এই ঘটনাগুলো শুধু ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে একটি ধারাবাহিক নিপীড়নের প্রতীক। কেয়ার- নিউইয়র্ক ও আক্রান্তরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-তারা ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেন, যাতে আর কোনো মুসলিম নারীকে তার মর্যাদা ও বিশ্বাসের জন্য মূল্য দিতে না হয়।
হিজাব-যা একজন মুসলিম নারীর চুল, কান, গলা এবং বুকের অংশ ঢেকে রাখে।এটি সরিয়ে ফেলা তাদের গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনের গুরুতর অবমাননা। মামলাটি ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে শুধু শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির জন্য নয়, বরং কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস(নিউইয়র্ক)-এর মিশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্যও, যা ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং মুসলিমদের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে।