নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতিয় নাগরিক পার্টি (বিসিপি) বিদ্যমান শাসনতন্ত্র বাতিল করে নতুন শাসনতন্ত্র রচনা এবং তার ভিত্তিতে বাংলাদেশে দ্বিতীয় রিপাবলিক সৃষ্টির মূলমন্ত্র ঘোষণা করেছে। বিষয়টি নিয়ে শুধু জনমনে নয়, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা বিতর্ক, নানা বিভ্রান্তি দানা বেঁধেছে। একটি জনযুদ্ধ, স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শের ভিত্তিতে ১৯৭২ শাসনতন্ত্র রচনা করেছিল। সেই শাসনতন্ত্র কিন্তু আকাশ থেকে পড়েনি। পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকার সেই শাসনতন্ত্র নানাভাবে পরিবর্তন করে শাসনতন্ত্রকে বিতর্কিত করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু সেই শাসনতন্ত্র সুরক্ষার অঙ্গীকার ঘোষণা করে শপথ নিয়েছে। জন আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সরকার বিজ্ঞজনদের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র সংশোধন এবং পরিমার্জন করে সকল রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। জুলাই আগস্টে একটি আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে। সেটিকে পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব বলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয় আছে। বিপ্লব হলে বিপ্লবী সরকার দায়িত্ব নিতো, শাসনতন্ত্র বাতিল হত। সেগুলো কিন্তু হয়নি। ছাত্র-জনতার একটি অংশ রাজনৈতিক দল গঠন করে সেই দলের কিছু মূলনীতি ঘোষণা করেছে। দেশে কয়েক ডজন রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের মৌলিক নীতি আদর্শ আছে। কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত এবং বহাল থাকা শাসনতন্ত্র পরিবর্তন, সংশোধন অথবা বাতিল হবে তার কিছু নিয়ম নীতি আছে। অনির্বাচিত সরকার কোনোভাবেই সেই অধিকার সংরক্ষণ করে না। এজন্য একটি জনতার ভোটে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ প্রয়োজন এবং সেই পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পরিবর্তন, সংশোধন বা নতুন করে রচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে।
বলা বাহুল্য ‘ফ্যাসিবাদী’ কথাটি একটি বহুশ্রুতি বচন এখন বাংলাদেশ। সত্যিকার অর্থে কথাটি যারা প্রতিনিয়ত বলছে তারা কতটা ফাসিজিম সত্যিকার অর্থে বোঝেন বা জানেন সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জেএনপি বর্তমান শাসনতন্ত্রের কোন কোন ধারা ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেগুলো সুস্পষ্ট করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এবং জনতার সামনে তুলে ধরতে পারে। জানিনা নতুন দলে এমন কোনো বিজ্ঞ অভিজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ আছে কি না? থাকলে ভালো কথা, তাহলে তাদের পর্যলোচনা থেকে জাতি উপকৃত হবে। সেটি না করা পর্যন্ত জাতির কাছে নতুন সংবিধান বা দ্বিতীয় রিপাবলিক সৃষ্টির দাবি হালে পানি পাবে বলে মনে হয় না।
কেন দ্বিতীয় রিপাবলিক করতে হবে?
বাংলাদেশের সমস্যা হলো জনগণকে ভোটের সাংবিধানিক অধিকার বঞ্চিত রাখা। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে রাজনৈতিকরণ করে বিরোধী দল এবং পক্ষকে কুক্ষিগত করে রাখা। বর্তমান সরকার কিন্তু বিভিন্ন সংস্কার কমিশন করে সংস্কারের পথনকশা তৈরি করছে। সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু সংস্কার সরকার করবে বাকিগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকার করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে। নতুন দলটিকে আগে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমোদন নিয়ে নিজেদের আদর্শ জনগণের কাছে উপস্থাপন করে নির্বাচনে জয়ী হতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে অনেক প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নিয়ে কিছুদিন আলোড়ন সৃষ্টি করে বিলুপ্ত হয়ে গাছে। রাজনৈতিক দল হিসাবে টিকে আছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ কিছু প্রান্তিক রাজনৈতিক দল। তরুণদের বর্তমান দল আধুনিক ধ্যান ধারণা নিয়ে রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনলে জনগণ সাধুবাদ জানাবে। কিন্তু বিষয়বস্তুর গভীর উপলব্ধি না করে কিছু হঠকারী ঘোষণা দিয়ে অগ্রসর হলে দলটির সম্ভাবনা কিন্তু মুকুলেই ঝরে পড়বে।
শতবাধা, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সরকার কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়সীমায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তৎপরতা শুরু করেছে। পাশাপাশি চেষ্টা চলছে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। ভেঙে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার। একই সঙ্গে জুলাই আগস্ট এবং তত পরবর্তী হত্যাকান্ড, সুপরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ বিষয়ে বিশ্বাসযোজ্ঞ অনুসন্ধানের মাধ্যমে স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলেছে। এই মুহূর্তে অযাচিত দাবি দাওয়া পরিহার করে দেশপ্রেমিক সবার উচিত সরকারের শুভ উদ্যোগের সহায়তা করা।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিধারা নির্ধারণ করবে দেশের জনসাধারণ আর সেটির জন্য প্রয়োজন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ থেকেও কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বাকিদের ছেটে ফেলে নিরপেক্ষ অবয়ব দিতে হবে। দেশে কিন্তু জেল পালানো সন্ত্রাসীরা থানা থেকে লুট করা এবং বিভিন্নভাবে সংগৃহীত মারণাস্ত্র দিয়ে ডাকাতি, লুটতরাজ, খুন করছে। জন জীবন অতিষ্ঠ্য করে স্বাধীনতাকেই বিপন্ন করে তুলেছে। জনতার ধৈর্যের সীমা আছে। আবার নতুন করে শিশু ধর্ষণের নির্মম ঘটনা দেখা যাচ্ছে। আমি নতুন রাজনৈতিক দলসহ দেশের সকল দেশপ্রেমিক জনতাকে দেশের স্বার্থে একতাবদ্ধ থাকার আহবান জানাচ্ছি। দেশ বাঁচলে নির্বাচন, উন্নয়ন সব কিছু হবে। না হলে শুধু দেশের শত্রুরাই উপকৃত হবে। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ একটি পতিত দেশে পরিণত হবে।