পতিত স্বৈরশাসকের আমলে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহযোগিতা চাইলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজরা প্রবাসে কোথায় সম্পত্তি ক্রয় করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রয় করেছে এটা প্রবাসীরা ভালো জানেন। তারা এসব দুর্নীতিবাজদের তথ্য বাংলাদেশ কনস্যুলেটের মাধ্যমে জানাতে পারে। তাছাড়া এই অর্থ উদ্ধারে প্রবাসে ল’ ফার্ম নিয়োগ করা হবে। দুর্নীতিবাজ বা চোরদের বাঁচিয়ে রেখে টাকা আদায় করতে হবে। তাদের মেরে ফেললে হবে না। গত ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এসব কথা বলেন।
সভার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানানো হয়। কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং সংস্কার, অর্থ পাচার, রিজার্ভ হ্যাকিং মামলা, নতুন নোট ছাপানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।
গভর্নর জানান, বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিগত সরকারের বিভিন্ন অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। মূলধনের টাকা গায়েব হয়েছে। আমরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করছি। তবে সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারসহ অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আমেরিকায় অর্থ পাচারকারীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, আমরা সব চুরির তথ্য বের করবো।
ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে উল্লেখ করে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিগত সময়ে বিকাশকে ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন প্রদান করা হয়নি, নগদকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং দুর্ভাগ্যজনক। তবে বর্তমানে নগদ সরকারে, তাই নগদকে দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। রিজার্ভ হ্যাংকিং নিয়ে নিউইয়র্কে এখনো মামলা চলছে, যেখানে ফেডারেল রিজার্ভ ও বাংলাদেশের পাশে আছে বলে জানান তিনি। সুইফ সিস্টেমের সঙ্গে এখন আর কোনো সিস্টেম যুক্ত নয়। সুইফটের লোকজন কিছুদিন আগেও পরিদর্শন করে গেছে বলে জানান গভর্নর।
ব্যাংকে শেয়ার থাকলেই স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের আর ইচ্ছেমতো পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত করা যাবে না বলেও মন্তব্য করেন গভর্নর। তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি তৈরি করছে । শুধু তাই নয় ইনডিপেনডেন্ট ডাইরেক্টর সংখ্যা ৫০/৫০ করা হবে এবং ওই ডাইরেক্টরদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্যানেল তৈরি করবে। তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব নিয়েই ১৪ ব্যাংকের বোর্ড পরিচালনা করি। বোর্ড ঠিক থাকলে ব্যাংক পরিবর্তন হতে বাধ্য। আর কোনো রাজনৈতিক নিয়োগ দেওয়া হবে না। সেই সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ নিতেও দেওয়া হবে না। যেভাবে অর্থ নিয়েছে বসুন্ধরা, বেক্সিকো ও এস আলম গ্রুপ।
নতুন নোট ছাপানোর বিষয়ে গভর্নর বলেন, এটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। নতুন নোট ছাপাতেও ১৮ মাস থেকে দুই বছর সময় লাগতে পারে। ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, ভারতের তৎকালীন গভর্নর এর বিরোধিতা করলেও রাজনৈতিক কারণে পুরোনো নোট বাতিল করা হয়েছিল, যেখানে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারও বিপদে পড়েছিল। গভর্নর থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন না বলে জানান তিনি।
দায়িত্বে আসার পর থেকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এখনো পাননি উল্লেখ করে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, আগামী দিনে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পাবেন না এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী, কমিউনিটি প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভার আগে নিউইয়র্কের রেমিটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও কনসুলেট জেনারেল অফিসে এক সভায় বক্তব্য রাখেন গভর্নর।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য গিয়াস আহমেদ, আব্দুল লতিফ সম্রাট, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুকিত চৌধুরী, অ্যাটর্নি মিজানুর রহমান, লেখক সাঈদ তারেক, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সভাপতি আব্দুর রব মিয়া, সৈয়দ রাব্বী, বিএনপি নেতা দেওয়ান কাউসার, মুনির হোসেন, ডা. ওয়াজেদ এ খান, জেবিবিএর সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ সোলায়মান, টাইম টিভির প্রেসিডেন্ট আবু তাহের, সেকিল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান খোকন, সোহেল হোসেন, জয়নাল আবেদীন, বিএনপি নেতা আব্দুস সবুর, জাহাঙ্গীর সরওয়ার্দী, গিয়াস উদ্দিন, প্রফেসর শওকত আলী, আবুল কাশেম, বদরুল হক আজাদ প্রমুখ।