একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার বিএনপি’র নেতারা ভালো চোখে দেখছেন না। এর পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপও দলটির দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিএনপির নেতারা এসব কিছুকেই এখন রহস্যজনক বলে মনে করেন। তাদের ধারণা সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক নাটকীয়তা দেখা যাবে। এর পাশাপাশি দেশের ভেতরের রাজনীতির পাশাপাশি ভূ-রাজনীতি নিয়েও অনেক ঘটনা পুরো জাতিকে প্রত্যক্ষ করতে হবে বলে তারা মনে করেন।
কি বললেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস?
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরায় এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এতে তিনি যা যা বলেছেন তার চুম্বক অংশ বিশেষ করে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যগুলো তুলে ধরা হলো। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জনগণ তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হন্তান্তরের কথা বলছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার এখনও তাদের জন্য ভালো সমাধান। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সরাসরি চলে যেতে এখনও বলছে না। বরং একটা ভালো নির্বাচন উপহার দিতে সরকারই নির্বাচন আয়োজনের দিকে যাচ্ছে।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরায় ‘মুহাম্মদ ইউনূস: রিয়েল রিফর্ম অর জাস্ট আ নিউ রুলিং ক্লাস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি গত ২৭ এপ্রিল রোববার আলজাজিরার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতে আরও বলেন, নির্বাচনের আগে সংস্কারের তালিকা ছোট হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন এবং তালিকা বড় হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনপ্রত্যাশা এখনও তুঙ্গে। জনগণ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার এখনও তাদের জন্য ভালো সমাধান।
সাক্ষাৎকারে এক পর্যায়ে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ড. ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের প্রসঙ্গ ওঠে। ড. ইউনূস জানান, তিনি বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে বলেছিলেন তিনি। জবাবে মোদি বলেছিলেন, এটা তার জন্য সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে কিছু বললে, সেটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।’
তবে সাক্ষাৎকারে বিগত দিনের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে দেশে অর্থবহ সংস্কার এবং এযাবৎকালের সেরা নির্বাচন উপহার দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর পাশাপাশি নির্বাচন জুনের পরে যাবে না বলেও উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সাক্ষাৎকারে প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী-ই মূলত সবচেয়ে তীক্ষ্ম বক্তব্য রেখেছেন। আলজাজিরায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস যে জনগণের কথা বলেছেন ‘সেই জনগণ কারা’ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি আরও বলেন, জনগণ ভোট চাচ্ছে না, এটা কিভাবে বুঝলেন? এখানে বলা হচ্ছে, জনগণ। জনগণ বলতে কারা? এখন কোনো একটা বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধাভোগী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে জনগণের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে গিয়ে গণতন্ত্রকে সংস্কারের মুখোমুখি করছে। কোনো বেশি বিশেষ সুযোগ-সুবিধাভোগী বিরুদ্ধাচরণ করছে এটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই।
নতুন চমক রাখাইন ইস্যু
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপেও তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর দিতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলাপাড় বইছে। এখন দেখা যাক কে কি বলছে।
বিএনপিসহ অন্যরা যা বললো
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সরকারের এমন পদক্ষেপে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এতে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি আলোচনা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি বলে মত দিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই করিডোরের কারণে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মন্তব্য করেছেন, নিরাপত্তার বিষয় জড়িত থাকায় করিডোরের প্রসঙ্গটি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ বলেছেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত হতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্লেষণ কি বলেন
একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারে দেয়া বক্তব্য আর বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর দিতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত-এমন দু’টি বিষয় রাজনৈতিক অঙ্গনে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে কারো কারো ধারণা। প্রথমত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারে দেয়া বক্তব্য বিএনপি কিভাবে দেখেন তা একান্তে আলাপ করেছেন দলটির কয়েকজন নেতা। তাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, বিএনপি যে আগামী বছরেই ত্রয়োদশ নির্বাচন হতে পারে এই বিষয়ে যে সর্বশেষ আশা নিয়ে বসে আছে তা হয়তবা হচ্ছে না। কেননা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেভাবে বলেছেন যে তিনি বুঝতে পেরেছেন জনগণ তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হন্তান্তরের কথা বলছে না। তাতে বোঝা গেলো নির্বাচন হয়তবা সহসা হচ্ছে না। যদিও প্রশ্ন হলো প্রধান উপদেষ্টা আসলে এটা কিভাবে বুঝেছেন, না-কি বোঝানো হয়েছে? না-কি অন্যকিছুর আভাস দিলেন বেশ ভদ্রভাবে? ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি বোঝাতে চাইলেন বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলিকে জনগণ পছন্দই করে না? তারা বিকল্প হিসাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস-কে পছন্দ করছে? একারণে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি তাহলে রাজনৈতিক দলের সরকার খুব দ্রুত ক্ষমতা পেয়ে যাক এটা তিনিই চান না? তাহলে যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের কথা তিনি বলছেন তা আসলে কথা কথা। আসল্য লক্ষ্য ভিন্ন। আবার এমন আলোচনা শেষ না হলে হতেই বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর দিতে সরকারের নেয়া নীতিগত সিদ্ধান্ত-ই বা কিভাবে নেয়া হলো? যেখানে সবদলই বলেছে যে, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস-তো কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনার সুযোগ দেননি। অন্যভাবে বলা যায় রাজনৈতিক দল বা মতকে আমলেই নেয়া হয়নি। কেবল দেশে ‘সংস্কার সংস্কার’ খুব দরকার বলে গলা ফাটিয়ে বেড়ানো নেপথ্যে অন্য কিছু হয়ে যাচ্ছে তার ইঙ্গিত এটি। প্রশ্ন হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেনো, কিভাবে কোন শক্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। সার্বিক বিষয়ে বিশ্লেষণে অনেকেই মনে করেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আসলে কি করবেন তা এখন সন্দেহের বেড়াজালে পড়ে গেলো। এর পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে নেয়া এমন কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো শক্ত পদক্ষেপ প্রমান করে চারিদিকে যে যা ভাবছে বা সহজ অঙ্ক কষে বসে আছে- তা আসলে ঠিক না। আবার সাক্ষাৎকারে এক পর্যায়ে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ড. ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের প্রসঙ্গ এলে তিনি যা বললেন সে-টি খুব সুখকর না। কারণ যে তথ্য জানা গেলো তা হচ্ছে, বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে বলেছিলেন তিনি। জবাবে মোদি বলেছিলেন, এটা তাঁর জন্য সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি দিল্লী ম্যানেজ বা নিয়ন্ত্রণ হয়নি.. বা হচ্ছে না? এত্তোসব ঘটনায় বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈদিক ক্ষেত্রে সামনে অনেক কিছু দৃশ্যমান হয়ত হয়ে যাবে যা কারো ভাবনায় থাকবে না..। চলমান ঘটনা বিশ্লেষণে এমনটাই মনে করে অনেকে।