০৪ জুলাই ২০১২, বৃহস্পতিবার, ৬:৪২:২৫ পূর্বাহ্ন


ঢাকার সড়ক এখন জ্বলন্ত কড়াই
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৫-২০২৪
ঢাকার সড়ক এখন জ্বলন্ত কড়াই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পানি ছিটানো হচ্ছে


একই পৃথিবী, একই আকাশ, একই সূর্য। আমি এখন অস্ট্রেলিয়ার সূর্যোদয় স্টেট কুইন্সল্যান্ড। শরৎকাল শেষে শীত আসছে। প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। আমার জীবনসঙ্গী বাংলাদেশে ঢাকা উত্তরায়। দীর্ঘদিন পর পারিবারিক জরুরি কাজে বাংলাদেশে। আমি আছি দক্ষিণ গোলার্ধের প্রায় প্রান্ত সীমায়। রোজী দক্ষিণ এশিয়ায়। কথাগুলো অবতারণা দুই দেশ দুই সিটির পার্থক্য বোঝানোর জন্য। লোগান সিটি কুইন্সল্যান্ডে এখন আরামদায়ক শরৎকাল, ঢাকা পুড়ছে তীব্র দাবদাহে। আমি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোনোভাবেই বাংলাদেশের তুলনা করবো না। তবুও একেবারে কিছুটা তুলনা না করলেও নয়। কারণ এখনকার অস্ট্রেলিয়ার সিটিগুলো সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব হওয়ার পেছনে দেশটির নীতি নির্ধারকদের হাজারো প্ল্যান। ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই তারা কাজ করে গেছেন। যার ফল ভোগ করছে অস্ট্রেলিয়ার এখনকার অধিবাসী। বাংলাদেশ বা ঢাকা এর যেন উল্টো। সবুজ নগরী ছিল এক সময় ঢাকা। গোটা বাংলাদেশই ছিল সবুজের সমারোহ। কিন্তু সবই আজ বিলীন হতে বসেছে। আর রাজধানী ঢাকা এখন বিরাণভূমি। যেদিকে তাকাই শুধু ধু ধু। গাছপালা কেটে ফেলে উন্নয়নের ছোঁয়া দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর যে সবুজ নগরায়ণের জন্য গাছ লাগানোর প্রয়োজন সেটা বেমালুম ভুলে সবাই। যার কুফল ভোগ করছে সবাই। মানুষ এ বিষয়গুলো এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত সময়ে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ঈদের ছুটির সঙ্গে এক সপ্তাহ বাড়িয়ে স্কুল খুললেও ঠিক পরের দিন আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্কুলে বাচ্চাগুলো অসহায়। স্কুলে যেতে হচ্ছে তাদের জ্যাম ও উত্তপ্ত রাস্তায় পায়ে হেঁটে বা বিভিন্ন যানবাহনে। যা কোনোভাবেই তাপ প্রতিরোধক নয়। ফলে অসুস্থ হচ্ছে কোমলমতি শিশু। 

নীতিনির্ধারকরাও নির্বিকার। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। একের পর এক হিট অ্যালার্ট জারি। দাবদাহ প্রতিনিয়ত রেকর্ড গড়ছে। এমনটা আর কখনই দেখেনি কেউ। 

এছাড়া রাজধানীতে প্রতিনিয়ত সেই ট্রাফিক জ্যাম তো আছেই। ফলে জ্যামে শহরে চলাচলকারী বাসগুলোতে চেপে বসা মানুষগুলো ছটফট করতে থাকে। নগরীতে চলাচলে এসি বাস নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ ফিটনেসবিহীন লক্কড় ঝক্কড় মার্কা গাড়ি। মানুষ নিরুপায়। এমন উত্তপ্ত অবস্থায় অফিসগামী বা বিভিন্ন কাজে বের হওয়াদের ওই বাহনই ভরসা। 

তবে বাংলাদেশে এবার গ্রীষ্মকালে যে প্রচণ্ড গরমের পেছনে বৈষয়িক আবহাওয়া পরিবর্তন ছাড়াও পাপের পরিণতি বলতেও দ্বিধা নেই। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, নদী, জলাধার ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা মহানগরীকে কংক্রিটের বস্তি বানানো হয়েছে। সীমিত সড়কগুলোতে অসংখ্য পরিবেশদূষণকারী যানবাহন নির্বিচারে উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। একসময়ের ছায়া সুনিবিড় শান্তির মহানগর ঢাকা এখন জ্বলন্ত কড়াইয়ের মতো জ্বলছে। রাস্তায় নামাই দায়। ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তায় পায়ে হেঁটে চলা দুষ্কর। বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের পেটে খাবার দিতে রাস্তায় নামতে হচ্ছেই। কিন্তু তারা বিচলিত হচ্ছেন। গরম বাতাস এসে চোখে মুখে লেগে প্রচ- ঘামিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে নাগরিক। কারো কিছুই করার নেই। কারণ আবহাওয়ার ওপর দখল কার? 

এই যে ঢাকা মহানগরীতে স্বাভাবিক বায়ু চলাচল রুদ্ধ করে অসংখ্য কাচ ঘেরা বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলো, নদী, জলাধার জবরদখল করা হলো, পরিবেশের কথা বিবেচনা না করে উন্নয়নের মহাযজ্ঞের নামে মহানগরকে বসবাসের অযোগ্য করা হলো, দায়দায়িত্ব কে নেবে? একটি বিদেশি সংস্থা পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন বাংলাদেশি মেয়েকে হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। মেয়েটা ৫২ বছরের পাপ মোচন করার জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু তাকে নানাভাবে সমালোচনা করছে নির্বোধ মানুষগুলো। 

আমি অস্ট্রেলিয়ায় অবকাঠামো নির্মাণকাজে সম্পৃক্ত থেকে দেখেছি এখানে একটি গাছ কাটতে হলে কত ধরনের অনুমতি লাগে। নিতান্ত অপরিহার্য হলে একটির পরিবর্তে চারটি গাছ লাগাতে হয়। বাংলাদেশে কাজ করার সময় আমি নিজেও আমার সব কর্মস্থলে অসংখ্য ফলদ, বনজ এবং ভেষজ গাছ লাগিয়েছি। কিন্তু বনখেকো, নদীখেকো মানুষগুলো অক্সিজেন ফ্যাক্টরিগুলো ধ্বংস করে প্রিয় ঢাকা মহানগরীকে গ্যাস চেম্বার বানিয়ে ফেলেছে। আমার নিজের শহর ফরিদপুর। দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি খুলনায়। ইদানীং পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মিত হওয়ায় দক্ষিণ বঙ্গের উন্নয়নের জানালা-দরজা খুলে গেছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর বদৌলতে উত্তরবঙ্গ আগে থেকেই সংযুক্ত। প্রয়োজন উত্তর এবং দক্ষিণ বঙ্গের উন্নয়ন যেন সবুজ উন্নয়ন হওয়া। পরিবেশ ধ্বংসের মতো পাপ করে যেন সবুজ শ্যামল বাংলাদেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় না হয়। স্কুলজীবন থেকেই যেন শিশুদের পরিবেশ সচেতন করে গড়ে তোলা হয়। 

শান্তির লোগান সিটি থেকে শিগগিরই আসবো বাংলাদেশে আমার সঙ্গে ইনশাআল্লাহ আসবে বর্ষাকাল অচিরেই। এখানে সকাল হয় পাখির ডাকে। চারিদিকে সবুজ বৃক্ষের সমারোহ। চাইলেই যেতে পারি প্রশান্ত সাগরপাড়ে। চিন্তাই করতে ভুলে গেছি বিদ্যুৎ জ্বালানি ঘাটতির কথা। কিন্তু বাংলাদেশ তথা, ঢাকা কত ভিন্ন। তবুও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সহকর্মীদের ধন্যবাদ দেব তীব্র দাবদাহের সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েনি। অন্তত রাজধানী ঢাকার বেলায়। এ ধারা অব্যাহত থাক প্রার্থনা করি। কেননা প্রচণ্ড দাবদাহে যদি বিদ্যুৎও না থাকে মানুষগুলো অসহায় হয়ে যাবে। 

শেয়ার করুন