শিশু ওয়াদি আলফায়ুমিকে হত্যা এবং তার মাকে ছুরিকাঘাত করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত জোসেফ কুবা
এক নির্মম ইসলামবিদ্বেষী ঘৃণামূলক অপরাধের বিচারের সমাপ্তি হয়েছে গত ২ মে। ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিশু ওয়াদি আলফায়ুমিকে ইসলাম বিদ্বেষপ্রসূত ঘৃণাজনিত অপরাধের কারণে নৃশংসভাবে হত্যা এবং শিশুটির মাকে গুরুতরভাবে আহত করার দায়ে ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের প্লেইনফিল্ড শহরের বাসিন্দা, ৭৩ বছর বয়সী জোসেফ কুবাকে ৫৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে উইল কাউন্টি আদালত। বিচারক অ্যামি বার্টানি-টমজ্যাক ২ মে রায় প্রদান করেন। কুবাকে প্রথম ডিগ্রির হত্যাকাণ্ড, হত্যাচেষ্টা, দুটি গুরুতর আঘাত এবং দুটি ঘৃণাজনিত অপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারক জানান, প্রথম ডিগ্রির হত্যার সাজা তাকে পূর্ণাঙ্গভাবে ভোগ করতে হবে এবং হত্যাচেষ্টার শাস্তির অন্তত ৮৫ শতাংশ তাকে ভোগ করতেই হবে।
২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যেই কুবা তার দুই বছর ধরে বসবাসকারী মুসলিম ভাড়াটিয়া শিশুটির মা হানান শাহিন ও তার ছেলে ওয়াদি আলফায়ুমির ওপর আক্রমণ চালায়। শাহিন আদালতে সাক্ষ্য দেন যে, সেদিন সকালে ওয়াদি ঘুম থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে বিছানার চাদর পরিবর্তন করছিল এবং একটি শিক্ষাভিত্তিক মোবাইল গেম খেলছিল। কিছুক্ষণ পর কুবা তাদের দরজায় এসে হঠাৎ ঢুকে পড়ে, শাহিনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় এবং ওয়াদির ওপর বর্বর হামলা চালায়। সে ছেলেটিকে ২৬ বার ছুরি মারে এবং ৭ ইঞ্চি ব্লেডের ছুরিটি তার দেহেই গেঁথে রেখে যায়। পুলিশ এসে দেখে, ৬২ পাউন্ড ওজনের শিশুটি বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর পড়ে আছে। মা হানান শাহিন জানান, আক্রমণের সময় তিনি ভেবেছিলেন তিনি মারা যাচ্ছেন। তিনি নিজেকে বাথরুমে আটকে রেখে ৯১১-এ কল করেন ও বলেন, সে আমার ছেলেকে ছুরি দিয়ে খুন করছে। শেষবার তিনি ওয়াদির মুখে শুনেছিলেন, ওহ না!
রায় ঘোষণার সময় আদালত কক্ষে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ওয়াদির চাচাতো দাদা মাহমুদ ইউসুফ বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে কুবার দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করেন, সে যেন অন্তত তার অপরাধের ব্যাখ্যা দেয়। আমরা জানি এটা ঘৃণাজনিত অপরাধ, কিন্তু জানতে চাই- কেন? কী শুনলেন বা দেখলেন, যা আপনাকে এতোটা সহিংস করে তুললো? কিন্তু কুবা কোনো কথা বলেননি। তার নীরবতা পরিবারের হৃদয়ে আরো গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। ওয়াদির বাবা ওদাই আলফায়ুমি বলেন, একটা সাজা হয়তো আইনের বিচারে যথাযথ, কিন্তু আমাদের পরিবারের পক্ষে এটি কখনোই যথেষ্ট ন্যায়বিচার নয়। রায়ের আগে কুবার আইনজীবী দাবি করেন যে, বিচার চলাকালীন আবেগঘন উপস্থাপনাগুলো, বিশেষ করে ওয়াদির মৃত্যুর ছবি, বিচারকদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তবে বিচারক টমজ্যাক সেই দাবিকে খারিজ করে দেন এবং বলেন, আপনার উত্থাপিত অভিযোগ সত্ত্বেও আদালতে উপস্থাপিত প্রমাণের শক্তিই এই মামলার নির্ধারক।
এই ঘটনাটি আমেরিকায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তে থাকা ইসলামোফোবিয়ার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ওয়াদির নাম উল্লেখ করে বলেন, ওয়াদি একজন গর্বিত আমেরিকান ছিল। আমরা কোনো বিদ্বেষমূলক আচরণের সামনে নীরব থাকতে পারি না। ঘটনার পর হানান শাহিন হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেন এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর ৩০ এপ্রিল ইলিনয় সিনেটে সর্বসম্মতভাবে পাস হয় ‘ওয়াদি রেজ্যুলেশন’। একই সঙ্গে হাউসেও এর সহানুভূতিশীল একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এই রেজোলিউশনের মাধ্যমে ওয়াদি আলফায়ুমির জীবন ও উত্তরাধিকারকে সম্মান জানানো হয়েছে এবং সেই ঘৃণাজনিত ও অবমাননাকর প্রচারণার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে, যা তার হত্যার প্ররোচক হিসেবে কাজ করেছে।
এই রেজ্যুলেশন অনুযায়ী, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ‘ওয়াদি দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে, যা জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি দিবসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রেজ্যুলেশনটি একটি বহুজাতিক, বহু সম্প্রদায়ভিত্তিক মানবাধিকার জোটের নেতৃত্বে পাস হয়, আরব-আমেরিকান হেরিটেজ মাসের শেষ দিনে-এক প্রতীকী মুহূর্তে, যখন স্প্রিংফিল্ডে শত শত মানুষ এশিয়ান-আমেরিকান অ্যাকশন ডে উপলক্ষে ‘আশ্রয়, নিরাপত্তা ও অন্তর্ভুক্তি’র দাবিতে একত্রিত হন।
কেয়ার শিকাগো শাখার নির্বাহী পরিচালক আহমেদ রেহাব এক বিবৃতিতে বলেন, ওয়াদি ছিল একজন নিষ্পাপ শিশু। তাকে হত্যা করা হয়েছে শুধু তার পরিচয়ের কারণে- মুসলিম, ফিলিস্তিনি এবং ভালোবাসার পাত্র। এই রেজ্যুলেশন ঘৃণার বিরুদ্ধে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের একটি মাইলফলক। আমাদের সংগ্রাম এখানেই শেষ নয়।ওয়াদির বাবা বলেন, আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল, আমি তার জন্য ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছিলাম। একবার ছুরি মারলেই কি শেষ হতো না? ২৬ বার? কোনো বাচ্চা যেন আর কখনো ঘৃণার শিকার না হয়, সেটাই আমাদের এখনকার লড়াই।
জোসেফ কুবা তার জীবনের শেষ দিনগুলো কারাগারে কাটাবেন। তবে শুধু তার সাজা দিয়েই এই নির্মম ঘটনার সমাপ্তি হয় না। ওয়াদি আলফায়ুমির নাম আজ ইলিনয়জুড়ে ঘৃণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, সমতা ও শান্তির প্রতীক। ২০২৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ইলিনয়বাসী প্রথমবারের মতো পালন করবে ‘ওয়াদি দিবস’-শুধু স্মরণের দিন নয়, বরং প্রতিজ্ঞা করার দিন: ঘৃণার বিপরীতে মানবতা আর বিভেদের বিপরীতে ভালোবাসা বেছে নেওয়ার দিন। ওয়াদি আলফায়ুমির হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পারিবারিক শোকের ঘটনা নয়- এটি একটি জাতীয় বিবেকের প্রশ্ন। ছয় বছরের একটি নিষ্পাপ শিশুর জীবন নিভে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিদ্বেষ যখন বাড়িতে ঢুকে পড়ে, তখন তার পরিণতি কতটা বিভীষিকাময় হতে পারে। জোসেফ কুবার দণ্ডপ্রাপ্তি আইনি বিচারের এক দৃষ্টান্ত হলেও নৈতিক বিচারে সমাজের সামনে রেখে গেছে আরো বড় এক চ্যালেঞ্জ-ঘৃণার বীজ উপড়ে ফেলে ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সহাবস্থানের সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
‘ওয়াদি রেজ্যুলেশন’ এবং ‘ওয়াদি দিবস’-এর ঘোষণা কেবল একটি শিশুকে স্মরণ করার উদ্যোগ নয়, বরং একটি শপথ- যে আমরা আর কোনো শিশুকে ঘৃণার বলি হতে দেবো না। ২১ সেপ্টেম্বর শুধু একটি দিন নয়, এটি এক বার্তা: বিভাজনের জবাবে ঐক্য, সহিংসতার জবাবে শান্তি, এবং নীরবতার জবাবে প্রতিবাদের বার্তা। ওয়াদির জীবন যেমন ছোট ছিল, তার প্রভাব তেমনই বিশাল-একটি সমাজকে বদলে দেওয়ার মতো।