প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে কংগ্রেসে উত্থাপিত হয়েছে রিপাবলিকান দলের একটি নতুন আইন প্রস্তাব ‘দ্য ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’। এই আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিক ব্যতীত অন্য সব প্রবাসীর আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তরের (রেমিট্যান্স) ওপর ৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই কর প্রস্তাবটি পাস হলে গ্রিন কার্ডধারী, এইচ-১বি, এল-১, এইচ-২বি ও অন্যান্য অস্থায়ী ভিসাধারীরা যারা মূলত বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন এবং কাজ করছেন তাদের সবাইকেই এই কর দিতে হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী, যে কোনো আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স লেনদেনে প্রেরক যদি ‘ভেরিফায়েড ইউএস সেন্ডার’ না হন, অর্থাৎ তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বা জাতীয় না হন, তবে তাকে ৫ শতাংশ হারে রেমিট্যান্স কর দিতে হবে।
এই কর রেমিট্যান্স প্রোভাইডার যেমন ব্যাংক, মানি ট্রান্সফার কোম্পানি ইত্যাদির মাধ্যমে সংগ্রহ করে কোয়ার্টারভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগে জমা দিতে হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কোনো রেমিট্যান্সের জন্য সর্বনিম্ন লেনদেনের সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। অর্থাৎ অল্প পরিমাণ অর্থ পাঠালেও এই কর প্রযোজ্য হবে, যদি প্রেরক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক না হন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই কর আরোপ কার্যকর হলে কেবল প্রবাসী পরিবার নয়, তাদের গৃহদেশগুলোর অর্থনীতিও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ, যার মধ্যে ৩২ লাখই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটি মোট ১১৮.৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যার মধ্যে ৩২ বিলিয়ন ডলারই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
প্রস্তাবিত এই কর কার্যকর হলে রেমিট্যান্সের ওপর বছরে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত কর দিতে হবে, যা প্রবাসীদের ওপর মারাত্মক আর্থিক চাপ তৈরি করবে। এই বিলের প্রভাব শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। দক্ষিণ এশীয় দেশ যেমন- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বৈদেশিক রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২১.৯৭ বিলিয়ন ডলার, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
বাংলাদেশি প্রবাসীরা যেসব দেশে কাজ করেন, তার মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া এবং যুক্তরাজ্য অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশি পরিবারগুলোকে শুধু জীবনযাত্রায় সহায়তা করে না, বরং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন, যাদের মধ্যে অনেকে গ্রিনকার্ড ও অস্থায়ী ভিসার আওতায় রয়েছেন এবং নিয়মিত অর্থ পাঠান বাংলাদেশে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এই নতুন কর আরোপ হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হবেন, এবং এতে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, ভোক্তা ব্যয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা বেলজিয়ামের মোট জিডিপির সমান। শুধু মেক্সিকোতেই রেমিট্যান্স এসেছে ৬৩.৩ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটিকে ভারতের পর দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশ ছিল ভারত (১২৯ বিলিয়ন ডলার), এরপর মেক্সিকো (৬৮ বিলিয়ন), চীন (৪৮ বিলিয়ন), ফিলিপাইনস (৪০ বিলিয়ন) এবং পাকিস্তান (৩৩ বিলিয়ন)।
রেমিট্যান্স অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ বা আন্তর্জাতিক সাহায্যের থেকেও বড় আয়ের উৎস। এই অর্থ গ্রামীণ উন্নয়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও হাউজিং খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত কর এসব দেশের জন্য বড়সড় ধাক্কা হতে পারে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অভিবাসী সংগঠন এবং মানবাধিকার সংস্থা এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাদের মতে, এই প্রস্তাব বৈধ অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক এবং যুক্তরাষ্ট্রে রেমিট্যান্সনির্ভর পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা ও গৃহদেশের অর্থনীতিকে একযোগে ঝুঁকিতে ফেলবে।
সংক্ষেপে, দ্য ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল যদি আইন হিসেবে কার্যকর হয়, তাহলে এটি হবে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের জন্য এক দুঃসংবাদ- বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের মতো রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য। এটি শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও আঘাত হানবে।