কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আলী’ স্পেশাল মেনশন পেয়েছে। এটি দেশের জন্য এক গৌরবময় মুহূর্ত। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা আদনান আল রাজীব এই অর্জনকে শুধু নিজের না বলে মনে করছেন গোটা দেশের, বিশেষ করে সেই মানুষদের- যারা নানা চাপে পড়ে কণ্ঠরোধ করে বাঁচে। কানের এই অর্জন নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। নিজের অনুভূতি, সিনেমার পেছনের গল্প, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থান নিয়ে খোলামেলা মত দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: কানের মতো মর্যাদাপূর্ণ আসরে ‘আলী’ স্পেশাল মেনশন পেল। অনুভূতিটা কেমন ছিল?
আদনান আল রাজীব: এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এক বিশাল অর্জন। প্রথমবারের মতো এমন স্বীকৃতি পাওয়া শুধু আমার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বাংলাদেশের জন্যও বড় একটি মুহূর্ত। এই মুহূর্তে যখন বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন এমন একটি খবর মানুষকে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করে। আমি মনে করি, আমরা কিছুটা হলেও মানুষের মনে আশা জাগাতে পেরেছি। আর কান চলচ্চিত্র উৎসব তো স্বপ্নের জায়গা-যেখানে নিজের নামের সঙ্গে দেশের নাম উচ্চারিত হওয়া এক অনন্য অনুভূতি। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। যখন পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ল, সেটা ছিল জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত।
প্রশ্ন: প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এমন একটি স্বীকৃতি পেল। আপনি কীভাবে দেখছেন এই অর্জন?
আদনান আল রাজীব: এমন কিছু হবে ভাবিনি কখনো। আমি তো শুধু নিজের মতো করে একটা গল্প বলতে চেয়েছিলাম। এই স্বীকৃতি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। একইসঙ্গে, দেশের জন্যও এটা সম্মানের। কারণ এটা দেখিয়ে দিল, আমাদেরও সক্ষমতা আছে-শুধু দরকার সাহস ও ধারাবাহিকতা।
প্রশ্ন: বিয়ের পর এই সাফল্য-কীভাবে দেখছেন?
আদনান আল রাজীব: আমি এখন মনে করছি, বউ (মেহজাবীন চৌধুরী) আমার জন্য লাকি চার্ম! বিয়ের পরই যেন ভাগ্য খুলে গেল। প্রথমবারই কান উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া, এরপর স্পেশাল মেনশন পাওয়া-সবই যেন এক অলৌকিক যাত্রা। ইনশাআল্লাহ, সামনে আরও বড় কিছু হবে বলে বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন: ‘আলী’ সিনেমাটি কাদের উৎসর্গ করেছেন?
আদনান আল রাজীব: আমি এই সিনেমাটি তাদের উৎসর্গ করেছি, যারা সমাজের নানা চাপের কারণে নিজেদের কথা প্রকাশ করতে পারেন না। ‘আলী’ মূলত একটি কণ্ঠস্বর-যেটা মানুষের আত্মাকে প্রশ্ন করতে শেখায়, ‘তুমি কে?’ যারা নীরব থেকে কষ্ট সহ্য করেন, তাদের গল্পই আমি বলেছি।
প্রশ্ন: সিনেমাটির পেছনের গল্প কী? কী ছিল অনুপ্রেরণা?
আদনান আল রাজীব: ‘আলী’ ছোট একটি ছেলের গল্প হলেও এর ভেতরে আছে বিশাল এক মানবিক বাস্তবতা-হারিয়ে ফেলা, ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, আত্মপরিচয়ের খোঁজ। এই গল্প কিছুটা আমার নিজের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত। আমি বিশ্বাস করি, যত ব্যক্তিগত একটি গল্প হয়, সেটাই সবার সঙ্গে বেশি সংযোগ তৈরি করে।
প্রশ্ন: নির্মাণের সময় কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল?
আদনান আল রাজীব: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একদল নতুন শিল্পী নিয়ে কাজ করা। তবে তারাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তারা এতটা আন্তরিকভাবে কাজ করেছে যে, পর্দায় চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাজেট সীমাবদ্ধতা ছিল, লোকেশন ম্যানেজ করাও কঠিন ছিল। কিন্তু আমাদের টিমের আন্তরিকতায় সব সহজ হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: ফিলিপাইনের সহ-প্রযোজনা কতটা জরুরি ছিল?
আদনান আল রাজীব: অত্যন্ত জরুরি ছিল। ফিলিপাইনের যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা সবাই আমার বন্ধু। আমাদের দেশে পোস্ট-প্রোডাকশনের সুবিধা সীমিত, তাই আমরা মিলে কাজটি করেছি। তাদের ছাড়া এই সিনেমাটি এমনভাবে নির্মাণ করা সম্ভব হতো না।
প্রশ্ন: এই অর্জন কি ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে সাহস জোগাবে?
আদনান আল রাজীব: অবশ্যই। কানে স্বীকৃতি মানে শুধু সম্মান নয়, এটি একটি দিকনির্দেশনাও। আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছানো মানে অনেক বড় দায়িত্বও নেওয়া। এখন আরও সাহস নিয়ে, আরও আন্তরিকভাবে গল্প বলতে চাই।
প্রশ্ন: স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
আদনান আল রাজীব: অনেকেই ভাবেন স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা কেবল প্রস্তুতির প্ল্যাটফর্ম। আমি তা মনে করি না। এটি নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী মাধ্যম। খুব অল্প সময়েই গভীর বার্তা দেওয়া যায়। তরুণ নির্মাতাদের আরও বেশি করে এই মাধ্যমে আসা উচিত।
প্রশ্ন: পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা আছে?
আদনান আল রাজীব: অবশ্যই আছে। আমি এখন একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছি। তবে তাড়াহুড়ো করতে চাই না। ভালোভাবে প্রস্তুত হয়ে, সঠিক গল্প নিয়ে বড় পর্দায় আসতে চাই।
প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সিনেমা কোথায় দাঁড়িয়ে?
আদনান আল রাজীব: আমার মতে, আমরা এখন এক ধরনের রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নির্মাতারা সাহসী, সৃজনশীল এবং বৈচিত্র্যময় গল্প বলছেন। এখন দরকার ধারাবাহিকভাবে ভালো কাজ করে যাওয়া। ‘আলী’-এর মতো সিনেমা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেলে, অন্য নির্মাতারাও উৎসাহিত হবেন।
প্রশ্ন: দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন পাচ্ছেন?
আদনান আল রাজীব: অনেক মানুষ আমাকে লিখেছেন, ইমেইল করেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, তারা সিনেমাটি দেখে নিজেদের জীবনের সঙ্গে সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। দর্শক যখন বলেন, ‘আপনার গল্পটা যেন আমার জীবনের কথা বলে’ তখন মনে হয়, পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
প্রশ্ন: তরুণ নির্মাতাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ?
আদনান আল রাজীব: তাদের বলব-নিজের গল্প বলুন, কারো মতো হওয়ার চেষ্টা করবেন না। প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়। সাহস নিয়ে শুরু করুন। আন্তর্জাতিক মানের গল্প বলার জন্য বড় বাজেটের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু সততা ও দৃষ্টিভঙ্গি।