৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:২৫:৪৩ পূর্বাহ্ন


নিউইয়র্কে গাজায় ক্ষুধার্থ মানুষ রক্ষার লক্ষাধিক মানুষের বিক্ষোভ
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৮-২০২৫
নিউইয়র্কে গাজায় ক্ষুধার্থ মানুষ রক্ষার লক্ষাধিক মানুষের বিক্ষোভ ১৬ আগস্ট নিউইয়র্ক সিটির ব্রায়ান্ট পার্কে গাজা সংহতি সমাবেশে মানুষ জড়ো হন, বিক্ষোভ মিছিল


গাজায় চলমান মানবিক সংকট ও অনাহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিউইয়র্ক সিটির ব্রায়ান্ট পার্কে গত ১৭ আগস্ট এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ‘স্টপ স্টারভিং গাজা : ম্যাস মার্চ ফর হিউম্যানিটি’ শিরোনামের এ কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট থেকে আগত লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেন। ইসরায়েলের অবরোধ, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ এবং বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার বিরুদ্ধে এ আন্দোলন ছিল এক দৃঢ় মানবিক ও রাজনৈতিক বার্তা। আয়োজনে অংশ নেয় বহু মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রগতিশীল সংগঠন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছোট ছোট সমাবেশ হলেও নিউইয়র্কের এই মিছিল ছিল সবচেয়ে বড় এবং সুসংগঠিত।

বিক্ষোভে অংশ নেয় বিভিন্ন সংগঠন, যার মধ্যে ছিল ফিলিস্তিনি ইয়ুথ মুভমেন্ট, দ্য পিপলেস ফোরাম, কেয়ার, নিউজার্সি পিস অ্যাকশনসহ বহু মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বক্তৃতা, স্লোগান, গান ও মানববন্ধনের মাধ্যমে তারা গাজায় চলমান মানবিক সংকট তুলে ধরেন। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় বর্তমানে ১১ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে রয়েছে এবং শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং ছাত্র অধিকারকর্মী মাহমুদ খালিল বিক্ষোভ সমাবেশের উদ্বোধন করেন। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় তিনি বলেন, ইসরায়েল গাজাকে পরিকল্পিতভাবে আমেরিকার বোমা, অর্থ ও সমর্থনের মাধ্যমে এবং সেটা করা হচ্ছে আমাদের করদাতাদের টাকায় ধ্বংস করছে। তিনি বলেন, সময় এখনই মুক্তির সেতুগুলো আমাদের দিয়েই শুরু হবে। আলজাজিরার নিহত সাংবাদিক আনাস আল-শারিফের শেষ কথাগুলো উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, যদি আমরা আনাসের কথাগুলো শুধু শোক বা বক্তৃতায় না রেখে কর্মে পরিণত করি, তবে আর কোনো তরুণ ফিলিস্তিনিকে শুধু সত্য বলার অপরাধে শেষ বিদায় জানাতে হবে না।

শ্রমিক নেতা ক্রিস স্মলস বলেন, আমরা এখানে গাজার শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে এসেছি। শ্রমিক, শিশু, মা-সবাই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। যখন আমরা আমেরিকার শ্রমিকদের অধিকারের জন্য লড়াই করি, তখন আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষেও দাঁড়াই। কারণ অন্যায়, দমন আর শোষণের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। তিনি আমাজনের মতো বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, এ কোম্পানিগুলো সামরিক শিল্প ও নজরদারি ব্যবস্থায় জড়িত, যা সরাসরি ফিলিস্তিনিদের জীবন হুমকির মধ্যে ফেলছে।

ফিলিস্তিনি ইয়ুথ মুভমেন্টের মুখপাত্র মরিয়ম ওসমান বলেন, মানুষ এখন মোবাইল স্ক্রিনে শিশুদের অনাহার দেখছে আর এটাই মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করছে। আমাদের সরকার যা করছে, তা জনগণের মানসিকতা প্রতিফলিত করে না।

সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা রান্নার হাঁড়ি-চামচ বাজিয়ে প্রতীকীভাবে ‘ক্ষুধার শব্দ’ তুলে ধরেন। অনেকেই হাতে লিখে এনেছিলেন পোস্টার-‘গাজা বাঁচাও’, ‘অনাহার যুদ্ধের অস্ত্র হতে পারে না’, ‘আমেরিকার অর্থে গণহত্যা নয়’, ‘সাংবাদিকদের হত্যা বন্ধ করো’। শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল একটি ‘চিঠি কর্নার’, যেখানে তারা গাজার শিশুদের উদ্দেশে বার্তা লিখে সহানুভূতি প্রকাশ করে।

এ বিক্ষোভের ঠিক একদিন আগে ট্রাম্প প্রশাসনের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা দেয়, গাজার অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য হিউম্যানিটারিয়ান মেডিকেল ভিসা প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত থাকবে। এ ঘোষণাকে ‘অমানবিক’ এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দেন সংগঠকরা। মানবাধিকারকর্মী জিম কেডি বলেন, আমি মানবিক সহায়তার কাজ করেছি, আমি জানি কীভাবে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। এ সংকট রাজনৈতিক নয়, মানবিক। এ মিছিল শুধু নিউইয়র্ককেন্দ্রিক ছিল না; বিশ্বের বিভিন্ন শহরেও একই দিনে সংহতির কর্মসূচি পালিত হয়। লন্ডন, প্যারিস, টরন্টো, ইস্তাম্বুল এবং কেপটাউনের মতো শহরগুলোতেও ফিলিস্তিনের পক্ষে মানুষ রাস্তায় নামে। আলজাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এ বিক্ষোভকে গুরুত্বের সঙ্গে কভার করে।

বিক্ষোভ শেষে আয়োজকরা মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান, যাতে তারা ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে এবং গাজায় অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করে। তারা বলেন, এ বিক্ষোভ শুধুই শোক প্রকাশ বা প্রতীকী প্রতিবাদ নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে মানুষ সরাসরি জবাবদিহির দাবি তুলছে। গাজার মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে তারা রাস্তায় নেমেছেন এবং এ আন্দোলন এখানেই থেমে থাকবে না। নিউইয়র্কের এ সমাবেশ প্রমাণ করে, আমেরিকার সাধারণ মানুষ আর নীরব নেই। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক নৈতিকতার প্রশ্নে তারা আজ সোচ্চার। এখন দেখার বিষয়, সরকার সে আওয়াজ আদৌ শুনবে কি না।

গাজার শিশুদের জন্য মানবিক চিকিৎসা ভিসা স্থগিত করলো যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্প প্রশাসন গাজার বাসিন্দাদের জন্য সব ধরনের ভিসা কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে, যার মধ্যে শিশুদের জরুরি চিকিৎসার জন্য মানবিক মেডিকেল ভিসাও অন্তর্ভুক্ত। গত ১৭ আগস্ট মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক ঘোষণায় জানায়, সাম্প্রতিককালে ইস্যু করা কিছু সাময়িক মানবিক চিকিৎসা ভিসার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পূর্ণ ও গভীর পর্যালোচনার জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের এ ঘোষণা এমন এক সময়ে এলো, যখন ট্রাম্পপন্থী চরম-ডানপন্থী কর্মী লরা লুমার সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে এ ভিসা প্রোগ্রামকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি ‘হিল প্যালেস্টাইন’ নামের একটি মানবিক সংস্থার শেয়ার করা একটি ভিডিও পোস্ট করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, যেখানে সান ফ্রান্সিসকো বিমানবন্দরে গাজা থেকে আগত শিশুদের ফুল ও বেলুন দিয়ে স্বাগত জানানো হচ্ছিল। ওই পোস্টে তিনি ভিসা অনুমোদনকারী পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের বরখাস্তের দাবি জানান।

এর আগে মানবিক সংস্থা হিল প্যালেস্টাইন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা গাজার আহত শিশুদের যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বড় একক মেডিকেল ইভাকুয়েশন মিশন পরিচালনা করেছে। এতে ১৪৮ জন গাজাবাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়, যার মধ্যে ৬৩ জন শিশু ছিল; অনেকেই যুদ্ধের কারণে হাত-পা হারিয়েছে বা মারাত্মক দগ্ধ হয়েছে। হিল প্যালেস্টাইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞ জিনা সালমান বলেন, এ শিশুদের আর অপেক্ষা করার সময় নেই। তাদের জীবন এখন ঝুঁকির মুখে। তবে শনিবার পর্যন্ত সংস্থাটি নতুন করে কোনো মন্তব্য করেনি।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ভ্রমণ ডকুমেন্টধারী ৬৪০ জনকে যুক্তরাষ্ট্রে সাময়িক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল, যার মধ্যে অনেকেই চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন।

এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে ফিলিস্তিনি অধিকার সংগঠনগুলো। ফিলিস্তিন চিলড্রেন’স রিলিফ ফান্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চিকিৎসার জন্য এ ধরনের মানবিক ইভাকুয়েশন গাজার শিশুদের জন্য জীবনদায়ী। তারা এ সিদ্ধান্তকে অমানবিক উল্লেখ করে তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। কেয়ারের নির্বাহী পরিচালক নিহাদ আওয়াদ বলেন, আমেরিকান অস্ত্রে আহত ফিলিস্তিনি শিশুদের যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটি প্রমাণ করে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘ইসরায়েল ফার্স্ট’ নীতির নিষ্ঠুরতা কতটা চরমে পৌঁছেছে।

গত মাসে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তালিকায় বলা হয়, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ চলাকালে প্রায় ৬০ হাজার গাজাবাসী নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৮ হাজার ৫০০ জন শিশু। যদিও ইসরায়েল দাবি করে, তারা বেসামরিক প্রাণহানি এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে এবং হামাস নাকি হাসপাতাল, স্কুল ও শরণার্থী ক্যাম্পের মতো স্থানে আস্তানা গড়ে তোলে। এ ভিসা স্থগিতাদেশ শুধু চিকিৎসা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক অবস্থানের ওপরও প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক মহলেও এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

শেয়ার করুন