০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৯:১৮ অপরাহ্ন


টোকিওর আকাশছোঁয়া বিস্ময়-স্কাই ট্রি”
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-১০-২০২৫
টোকিওর আকাশছোঁয়া বিস্ময়-স্কাই ট্রি” স্কাইটি


টোকিওর যে প্রান্ত থেকেই তাকানো হোক না কেন, দৃষ্টি আটকে যায় এক অদ্ভুত সৌন্দর্যে টোকিও স্কাই ট্রি। ৬৩৪ মিটার উঁচু এই টাওয়ার শহরের বুক থেকে উঠে গিয়ে যেন আকাশকে আলিঙ্গন করে। নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে, শেষ হয় ২০১২ সালে। শুধু সম্প্রচার টাওয়ার নয়, এটি আজ জাপানের এক প্রতীক, যেখানে ইতিহাস, প্রযুক্তি, শিল্প আর রোমান্স মিলেমিশে আছে। 

‘৬৩৪’ সংখ্যাটিও নিছক কাকতালীয় নয়। জাপানি উচ্চারণে এটি দাঁড়ায় মুসাশি”-টোকিওর প্রাচীন অঞ্চলের নাম। তাই এই টাওয়ারে দাঁড়ালেই মনে হয়, ইতিহাস আর আধুনিকতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। 

আমরা স্কাই ট্রির পাদদেশে এসে দাঁড়ালাম এক বিকেলে। চারপাশে মানুষের ভিড়, পর্যটকদের হাসি, আর নিচতলার টোকিও সোরামাচি শপিংমল যেন এক উৎসবমুখর গ্রাম। ৩০০টিরও বেশি দোকান, সুস্বাদু রেস্টুরেন্ট, জাপানি হস্তশিল্প আর আধুনিক ব্র্যান্ড-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল স্বপ্নের বাজার। আমরা প্রথমে ঢুঁ মারলাম একটি ওয়াগাশি (জাপানি মিষ্টি) দোকানে। ছোট ছোট রঙিন মিষ্টি যেন জাপানি ঋতুর প্রতিচ্ছবি। তারপর গেলাম এক রেমেন রেস্টুরেন্টে গরম ধোঁয়া ওঠা স্যুপে নুডুলসের স্বাদ যেন ভ্রমণের ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর করে দিলো। 

এরপর এলিভেটরে চেপে উপরে উঠতেই হৃদয়ে ধ্বনি তুললো এক অদ্ভুত অনুভূতি। প্রথমে টেম্বো ডেক (৩৫০ মিটার)-যেখানে কাচের জানালার ওপারে পুরো টোকিও শহর বিছিয়ে আছে। দূরে টোকিও বের নীল জল, রাস্তায় আলো ঝলমল গাড়ির সারি আর গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো যেন খেলনা ঘরের মতো ছোট্ট হয়ে গেছে। 

আরো উপরে টেম্বো গ্যালারিয়া (৪৫০ মিটার), যেখানে স্বচ্ছ কাচের করিডোরে হেঁটে মনে হচ্ছিল আমরা আকাশে ভেসে যাচ্ছি। সূর্য যখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল, তখন টোকিও শহরটা আলোয় জেগে উঠলো। অসংখ্য আলোকবিন্দু, নীল, বেগুনি আর সোনালি আলোয় স্কাই ট্রি জ্বলজ্বল করছিল। নিচের কোলাহল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আমরা এক নক্ষত্ররাজ্যের সাক্ষী হয়ে আছি। 

নিচে নামার সময় মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীতে ফিরে আসছি। কিন্তু স্কাই ট্রি আমাদের ভেতরে যে অনুভূতি রেখে গেল, তা কেবল ভ্রমণ নয়, এটি চিরস্থায়ী এক রোমান্স। আকাশের উচ্চতা আর মানুষের ভালোবাসা-দুটিই সীমাহীন। টোকিও স্কাই ট্রি তাই শুধু একটি টাওয়ার নয়, এটি হলো আকাশে লেখা প্রেমের কবিতা, যেখানে ভ্রমণ মিশে যায় হৃদয়ের গভীরতায়। 

গরমে জাপানিদের অভিনব যুদ্ধ!

হাতে ফ্যান, গলায় কুলার আর জ্যাকেটে বাতাস, টোকিওর রাস্তায় হাঁটলে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়বে। কারো হাতে ছোট একটি ব্যাটারিচালিত ফ্যান, কেউবা গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে নীল রঙের আইস কুলার, আবার কারো জ্যাকেট থেকে হাওয়া বের হচ্ছে ফিসফিস শব্দে। মনে হবে যেন গরমের বিরুদ্ধে জাপানিরা এক অদ্ভুত ‘টেকনোলজির ফ্যাশন শো’ করছে। 

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে জাপানের তাপমাত্রা অনেক সময় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর চলে যায়। এর সঙ্গে আর্দ্রতা এতো বেশি যে কয়েক মিনিট বাইরে থাকলেই ঘাম ঝরতে শুরু করে। তাই জাপানিরা কেবল গরমের সঙ্গে যুদ্ধ করে না, তারা গরমকে মোকাবিলা করার জন্য সৃজনশীল জীবনযাপন করে। 

রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো এক তরুণীর হাতে ছোট্ট ফ্যান ঘুরছে অবিরত। ব্যাগের মতো সহজে বহনযোগ্য এই ফ্যান জাপানের গ্রীষ্মে তরুণ-তরুণীদের সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী। অন্যদিকে একজন শ্রমিককে দেখা গেল এমন জ্যাকেট পরে আছেন, যেটার দুপাশে বসানো ফ্যান ভেতরে বাতাস ঢুকিয়ে শরীর ঠান্ডা রাখছে। দৃশ্যটা অদ্ভুত হলেও কার্যকর এ ‘এয়ার-কনডিশন্ড জ্যাকেট’ এখন শহুরে গ্রীষ্মের নতুন আবিষ্কার। 

শুধু তাই নয়, দোকান ভরতি কুলিং তোয়ালে, আইস জেল প্যাক, এমনকি ফ্যান লাগানো টুপি পর্যন্ত পাওয়া যায়। মনে হবে যেন প্রযুক্তি আর গরমের মধ্যে চলছে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা। কে কাকে হারাবে? কিন্তু এর পেছনে কেবল ভোগবিলাস নেই। জাপানে ‘হিটস্ট্রোক’ একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি। স্কুল, অফিস, এমনকি সরকারও মানুষকে গরম থেকে বাঁচতে নানা সচেতনতামূলক প্রচারণা চালায়। তাই ঠান্ডা রাখার এ ছোটবড় উপকরণগুলো আসলে তাদের স্বাস্থ্যরক্ষা ও জীবনযাত্রার অংশ। জাপানের এই চিত্রে স্পষ্ট হয় প্রকৃতির সঙ্গে তারা যুদ্ধ করে না, বরং প্রযুক্তি আর সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সহজভাবে সহাবস্থান শিখে নিয়েছে। আর এই সহজ সমাধানগুলো বিদেশিদের চোখে যেমন নতুন অভিজ্ঞতা, তেমনি জাপানিদের কাছে প্রতিদিনের অভ্যাস। 

এ ব্যাপারে আমার সব জান্তা গাইড নিকিতার কাছে জানতে চাইলে, সে আমার পর্যবেক্ষণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বল্লো, জাপানে গ্রীষ্মকাল সত্যিই বেশ গরম ও আর্দ্র (humid) হয়। বিশেষ করে টোকিও, ওসাকা বা কিয়োটো শহরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে গরম এতোটাই তীব্র হয় যে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই জাপানিরা বিভিন্ন অভিনব উপায়ে গরম মোকাবিলা করে, যার মধ্যে তোমার চোখে ধরা পড়েছে হাতের ফ্যান আর ফ্যান-জ্যাকেট। 

সে জানায় গড় তাপমাত্রা জুলাই-আগস্টে প্রায় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছায়। আর্দ্রতা অনেক বেশি (৬০-৮০%), ফলে তাপ সহ্য করা কঠিন হয়। তাই মানুষকে দীর্ঘ সময় বাইরে থাকতে হলে ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। 

এজন্য ছোট, ব্যাটারিচালিত ফ্যান যা সহজে হাতে নিয়ে ব্যবহার করা যায়। শপিং, রাস্তা হাঁটা বা ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময় এগুলো খুব কাজে লাগে। অনেক তরুণ-তরুণী এগুলো ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ হিসেবেও ব্যবহার করে। এছাড়া মার্কেটে কুল জ্যাকেট পাওয়া যায়। জ্যাকেটের দুপাশে ছোট ছোট মোটর ফ্যান বসানো থাকে। এসব জ্যাকেটের ফ্যান বাতাস টেনে নিয়ে ভেতরে চালনা করে, ফলে শরীর ঠান্ডা থাকে। সাধারণত নির্মাণ শ্রমিক, বাইরের কাজে নিয়োজিত মানুষ বেশি ব্যবহার করে। তবে এখন সাধারণ মানুষও গ্রীষ্মে ব্যবহার করছে। 

নিকিতা জানায় এর একটা সাংস্কৃতিক দিকও রয়েছে। জাপানিরা প্রযুক্তিকে দৈনন্দিন জীবনে খুব দ্রুত গ্রহণ করে। তারা ‘হিটস্ট্রোক প্রিভেনশন’ বা গরম থেকে বাঁচার কৌশলকে সামাজিক দায়িত্বের অংশ মনে করে। তাই স্কুলে, অফিসে-এমনকি রাস্তায়ও সবাইকে বিভিন্ন ঠান্ডা রাখার সামগ্রী ব্যবহার করতে দেখা যায়। 

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, জাপানের দোকানে তুমি এ ফ্যান আর জ্যাকেটের অসংখ্য ধরন পাবে। এমনকি কিছু ফ্যানের ডিজাইন এতো সুন্দর যে মনে হবে খেলনা বা কসপ্লের অ্যাকসেসরিজ! আর তুমি যদি চাও, তাহলে একটি কুল জ্যাকেট আমি তোমাকে গিফ্ট করতে পারি। 

আমি নিকিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করলাম। 

টোকিও বে-ক্রুজ

টোকিওর ব্যস্ত শহরটিকে আমরা সবাই চিনি আকাশছোঁয়া ভবন আর অবিরাম দৌড়ঝাঁপের জন্য। কিন্তু এ শহরের বুকেই লুকিয়ে আছে এক শান্ত জগত-টোকিও বে ক্রুজ। দিনের আলো থেকে রাতের ঝলমলে অন্ধকার, সব সময়ই এ ক্রুজ ভ্রমণ শহরের অন্য এক রূপ উন্মোচন করে। সন্ধ্যার ঠিক আগে আমি পৌঁছালাম ঞধশবংযরনধ চরবৎ-এ। বাতাসে লোনা গন্ধ, আর সমুদ্রের ঢেউয়ের আলতো শব্দ যেন আগাম জানিয়ে দিলো আজকের ভ্রমণ হবে অন্যরকম। ক্রুজ শিপে পা রাখতেই মনে হলো যেন শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে এক নতুন জগতে প্রবেশ করেছি। ক্রুজ ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলো। দূরে চোখে পড়লো রেইনবো ব্রিজ, রাতের আলোয় রঙিন হয়ে ওঠা এক স্থাপত্য কবিতা। নৌকার ডেকে দাঁড়িয়ে আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। সমুদ্রের হাওয়ায় চুল এলোমেলো, কিন্তু মন শান্ত, যেন ঢেউয়ের ছন্দে সব ক্লান্তি ভেসে যাচ্ছে। 

পাশেই বসে থাকা এক তরুণ দম্পতি হেসে বললেন, ‘টোকিওকে চিনতে হলে, জল থেকে দেখতে হবে।’ তাদের কথায় সায় না দিয়ে পারলাম না। 

রাত নেমে এলো ধীরে ধীরে। টোকিও টাওয়ার দূরে সোনালি আলোয় ঝলমল করছে আর সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে শহরের আলোকরেখা। প্রতিটি আলো যেন ঢেউয়ের বুকের ওপর নাচতে নাচতে গল্প বলছে। ক্রুজের ভেতরে চলছিল সংগীত আর হালকা খাবারের আয়োজন। জাপানি সুশি, টেম্পুরা, সঙ্গে এককাপ উষ্ণ চা-ঢেউয়ের সঙ্গে মিলেমিশে এ যেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা। দু’ঘণ্টার যাত্রা শেষে যখন ক্রুজ ধীরে ধীরে ঘাটে ফিরছে, তখন মনে হচ্ছিল, এ আলো, এ ঢেউ আর এই শান্তি আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই। টোকিওর রূপ আমি অনেকভাবে দেখেছি, কিন্তু টোকিও বে ক্রুজে দেখেছি শহরের সবচেয়ে রোমান্টিক ও শান্ত রূপ। 

শিবুয়া ক্রসিং

যারা টোকিওতে এসে আধুনিক নগরজীবনের ধারা অনুভব করতে চান তাদের সেই অভিজ্ঞতার সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ হয়ে দাঁড়াল শিবুয়া ক্রসিং। আমাদের এবারের গন্তব্য সেখানেই। বাস থেকে নেমেই প্রথমেই চোখে পড়লো বিশ্ববিখ্যাত হাচিকো ভাস্কর্য। এই কুকুরটির মালিকের প্রতি অবিচল আনুগত্যের গল্প সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে। আজও হাজারো মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে, অপেক্ষা করে কিংবা কেবল একটু সময় কাটায়। হাচিকোর সামনে দাঁড়িয়ে আমারও মনে হলো-এই শহর শুধু আধুনিকতার নয়, বরং মানবিক গল্পেরও বাহক। 

গাইড জানায়, শিবুয়া ক্রসিংয়ের পাশে থাকা হাচিকো ভাস্কর্য আসলে টোকিওর অন্যতম আবেগঘন ও মানবিক প্রতীক। ১৯২৩ সালে জাপানের আকিতা প্রদেশে জন্ম নিয়েছিল একটি কুকুরছানা-হাচিকো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাকে দত্তক নেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের অধ্যাপক হিদেসাবুরো উএনো। 

হাচিকো দ্রুতই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। প্রতিদিন সকালে অধ্যাপক উএনো যখন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন, হাচিকো তাকে শিবুয়া স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতো, আর বিকেলে ফেরার সময় স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতো। 

কিন্তু ১৯২৫ সালের একদিন হঠাৎই অধ্যাপক উএনো হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তিনি আর কখনো স্টেশন থেকে ফেরেননি। কিন্তু তবুও হাচিকো থামেনি। 

পরবর্তী ৯ বছর ধরে, প্রতিদিন একই সময়ে সে শিবুয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে তার মালিকের জন্য। 

স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করা মানুষরা প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল, পরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিল। অনেকেই তাকে খাবার দিতো, আবার কেউবা আদর করতো। ধীরে ধীরে হাচিকো হয়ে ওঠে জাপানি সংস্কৃতিতে অবিচল আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রতীক। 

১৯৩৪ সালে হাচিকোর জীবদ্দশাতেই শিবুয়া স্টেশনের সামনেই তার একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। হাচিকোও তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। 

হাচিকো মারা যায় ১৯৩৫ সালে, কিন্তু তার কাহিনি মানুষের হৃদয়ে আজও বেঁচে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মূল ভাস্কর্য গলিয়ে ফেলা হয়, তবে যুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে নতুন করে আবার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। আজ সে ভাস্কর্যই শিবুয়া ক্রসিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, হাজারো পর্যটকের মিলনস্থল হয়ে। 

হাচিকোর কাহিনি এতোটাই আবেগপূর্ণ যে জাপান ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে রিচার্ড গের অভিনীত Hachi: A Dogs Tale চলচ্চিত্রটি হাচিকোর গল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। 

আজও শিবুয়া স্টেশনের হাচিকো এক প্রতীক-মানুষের ভালোবাসা, আনুগত্য আর অটল প্রতীক্ষার প্রতীক। পর্যটকরা এখানে ছবি তোলে, কেউ কেউ ফুল বা উপহার রেখে যায়। আর স্থানীয়রা এটিকে মিলনস্থল হিসেবে ব্যবহার করে ‘চল, হাচিকোর কাছে দেখা করি’। গল্প শুনতে শুনতে আমরা স্কিংবদন্তি ক্রসিংয়ের কাছে পৌঁছে যাই। পাঁচ দিক থেকে রাস্তাগুলো এসে মিশেছে এক জায়গায় আর প্রতিবার সিগন্যাল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মানুষের স্রোতের মহানৃত্য। 

গাইডের সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সিগন্যাল সবুজ হতেই শত শত মানুষ একসঙ্গে চারদিক থেকে রাস্তায় ঢুকে পড়লো। এই দৃশ্য কেবল এক রাস্তা পার হওয়া নয়, এটি শহরের জীবন্ত এক চিত্রকলা। মানুষের পদক্ষেপ, ব্যস্ততা, তাড়াহুড়া-সব মিলিয়ে মনে হলো আমি যেন টোকিওর হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। আশ্চর্যজনকভাবে এত ভিড়েও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, বরং আছে এক ধরনের অদ্ভুত শৃঙ্খলা ও ছন্দ। চারপাশে বিশাল খঊউ স্ক্রিনে বিজ্ঞাপন চলছে, ঝলমলে আলোয় রাত যেন এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকরা সেলফি তুলছে, কেউবা LED করছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে মুহূর্তগুলো জমে থাকছে চিরস্মৃতিতে। 

কিছু মানুষ আবার উপরে উঠে গেছে শিবুয়া স্ক্রাম্বল স্কোয়ার বা শিবুয়া ১০৯ শপিং মলের ভিউ ডেক থেকে পুরো ক্রসিংয়ের পাখির চোখে দৃশ্য উপভোগ করতে। আমি দাঁড়িয়ে শুধু বিস্ময়ে দেখছিলাম-কীভাবে প্রতি দুই মিনিট পরপর এই ভিড় গড়ে ওঠে আর গলে যায়, যেন সমুদ্রের ঢেউ আসছে আবার সরে যাচ্ছে। 

শিবুয়া শুধু ক্রসিংয়ের জন্য নয়, বরং ফ্যাশন ও বিনোদনের রাজধানী হিসেবেও বিখ্যাত। শিবুয়া ১০৯ হলো তরুণ-তরুণীদের ফ্যাশনের এক আইকন। অসংখ্য ব্র্যান্ড শপ, কসমেটিক স্টোর, জুতার দোকান সারিবদ্ধভাবে সাজানো। আমি ভিতরে ঢুকে দেখলাম প্রতিটি দোকান যেন নতুন প্রজন্মের রঙে রাঙানো। 

আরেকদিকে আছে আধুনিক শিবুয়া স্ক্রাম্বল স্কোয়ার, যেখানে রেস্টুরেন্ট, বইয়ের দোকান, আর ৪৭ তলায় অবস্থিত পর্যবেক্ষণ ডেক থেকে টোকিওর এক অন্যরকম সৌন্দর্য দেখা যায়। শিবুয়ায় অসংখ্য ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট আছে, যেগুলো ভ্রমণকে আরো আনন্দময় করে তোলে। অনেক ক্যাফে থেকে কাচের জানালার ভেতর বসে শিবুয়া ক্রসিংয়ের দৃশ্য দেখা যায়, যা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। গাইড আমাদের নিয়ে গেল একটা কফিশপে। কফি হাতে দেখছিলাম কীভাবে প্রতিবার সিগন্যাল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে শহরের ছন্দ আবার শুরু হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, আমি কোনো লাইভ সিনেমা দেখছি। 

গাইড জানায়, সন্ধ্যা নামতেই শিবুয়া যেন আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে। নিয়ন লাইট, ঝলমলে বিলবোর্ড, হাসি-আনন্দে ভরা মানুষের স্রোত-সব মিলিয়ে শিবুয়া রাতের টোকিওর আসল প্রতীক হয়ে ওঠে। রাস্তা ভরা তরুণ-তরুণী, কোরিয়ান পপ ফ্যাশনে সজ্জিত যুবক-যুবতী, গান-বাজনা, খাবারের গন্ধ-সবকিছু যেন একসঙ্গে মিশে গড়ে তুলে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। শিবুয়া ক্রসিং আমার কাছে শুধু এক জায়গা নয়; মনে হচ্ছিল এটি টোকিওর আত্মার প্রতিচ্ছবি। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এই শহর কখনো থেমে থাকে না, থামে না মানুষের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা আর ছুটে চলা। ক্রসিংয়ের প্রতিটি পা ফেলা যেন জীবনের প্রতি মানুষের অদম্য যাত্রার প্রতীক। শিবুয়া আমাকে শিখিয়েছে ব্যস্ততা কখনোই বিশৃঙ্খলা নয়, যদি সেখানে ছন্দ থাকে। আর সেই ছন্দই টোকিওকে করে তুলেছে এক জীবন্ত কবিতা।

মেইজি জিনগু 

টোকিওর কোলাহল, ট্রাফিক আর নিয়ন আলো পেছনে ফেলে আমি আর ট্যুর গাইড নিকিতা চেপে বসলাম ট্রেনে। শহরের প্রাণকেন্দ্র টোকিও স্টেশন থেকে JR Yamanote Line ধরে চললাম। কেবল বিশ মিনিটের যাত্রা। দুজনেই নেমে পড়লাম Harajuku Station-এ। গেট থেকে বের হতেই চোখে পড়ল এক বিশাল কাঠের টোরি গেট, যেন এক জাদুকরী দরজা, যা আমাকে শহরের কোলাহল থেকে নিয়ে যাবে নীরবতার অরণ্যে। 

মেইজি জিনগুর পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো শহরের মাঝেই যেন আমি কোনো প্রাচীন বনের গভীরে ঢুকে পড়েছি। চারপাশে ঘন সবুজে ঢাকা শত শত গাছ, যার মধ্যে অনেকই মানুষের হাতে লাগানো হলেও আজ তারা পরিণত হয়েছে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে। বাতাসে ভেসে আসছিল পাখির ডাক আর পদতলে নুড়ির কচমচ শব্দ। কোলাহল মিলিয়ে গেল, মনে হলো সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। 

নিকিতা জানায়, ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত মেইজি জিনগু নির্মিত হয়েছিল সম্রাট মেইজি ও সম্রাজ্ঞী শোকেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সম্রাট মেইজি ছিলেন আধুনিক জাপানের স্থপতি, তিনি পশ্চিমা প্রযুক্তি গ্রহণ করে জাপানকে আধুনিক যুগে নিয়ে গিয়েছিলেন, তবে জাপানি ঐতিহ্যের শিকড়ও দৃঢ় রেখেছিলেন। এ মন্দির তাই শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বরং আধুনিক জাপানের জন্মকাহিনীর প্রতীক। 

মন্দিরের চারপাশে বিস্তৃত বনভূমি রয়েছে, যেখানে প্রায় এক লাখের বেশি গাছ লাগানো। এ বন শহরের মধ্যেও একটি প্রাকৃতিক শান্তির কোন তৈরি করে। মন্দিরের স্থাপত্য শিন্তো ধাঁচের কাঠামোতে, যা জাপানের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মন্দিরে নিয়মিতভাবে শিন্তো অনুষ্ঠান, বিবাহ ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে নববর্ষে এখানে ভিড় হয় হাতসুমোডে (Hatsumode)-এর জন্য। দর্শনার্থীরা এখানে ইমা প্ল্যাক-এ তাদের ইচ্ছা লিখে ঝুলিয়ে রাখে এবং ওমামরি ক্রয় করে আশীর্বাদ নেয়। 

সকালের হালকা কুয়াশা ভেদ করে ঢুকে পড়লাম মেইজি জিনগুর বিশাল টোরি গেট দিয়ে। কাঠের গেটের উঁচুতা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে গেল। পেছনে টোকিওর ব্যস্ততা, সামনে শান্তির বনভূমি- এক বিশাল বিরতির মতো। পথের ধ্বনিতে শুধু পাখির কুলকুল আর পাতার নরম শব্দ। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, শহরের কোলাহল যেন দূরে হারিয়ে গেছে। এ বনভূমির প্রতিটি গাছ যেন আমার কল্পনার সঙ্গে কথা বলছে। 

প্রধান মন্দিরে প্রবেশ করতেই দেখা মিললো মানুষের শ্রদ্ধার প্রার্থনা। কয়েন ফেলে, মাথা নত করে, হালকা স্নিগ্ধ প্রার্থনা-অনুভূতি একেবারে ভিন্ন। পাশে ছোট ছোট ইমা প্ল্যাক ঝুলে আছে, যেখানে মানুষ তাদের স্বপ্ন ও আশা লিখেছে। একটু দূরে ওমামরি দোকানে চোখ পড়ল রঙিন তাবিজের ওপর। প্রতিটি তাবিজ যেন ভেতরে এক রহস্যময় আশীর্বাদ লুকিয়ে রেখেছে। 

মেইজি জিনগুর শান্ত বাগান, পথের নিচু আলো এবং ভোরের হালকা হাওয়া এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিলো। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো, সময় থমকে গেছে। শহরের কোলাহল, জাপানের আধুনিকতা-সব যেন মন্দিরের বাইরে। বাইরে বেরিয়ে হরাজুকুর রাস্তায় ঘুরতে গেলাম। শহরের ব্যস্ততা আবার ফিরে এলো, কিন্তু মনের মধ্যে সেই শান্তির অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে চলেছি। মেইজি জিনগু শুধু একটি স্থান নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা, যেখানে ইতিহাস, প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে দর্শনকে মনে রাখার মতো করে তোলে। 

ইম্পিরিয়াল প্যালেস

আজ আমাদের গন্তব্য হলো ইম্পিরিয়াল প্যালেস। ইম্পিরিয়াল প্যালেস জাপানের সম্রাটের সরকারি বাসভবন, যা টোকিওর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। একসময় এখানেই ছিল এডো ক্যাসেল, টোকুগাওয়া শোগুনদের আস্তানা। মেইজি পুনর্গঠনের পর থেকে এটি সম্রাটের রাজপ্রাসাদে রূপ নেয়। প্রাসাদের ভেতরের মূল অংশ সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য সব সময় খোলা নয়, তবে বাইরের ইস্ট গার্ডেন, নাইজুবাশি ব্রিজ আর চারপাশের খাল ও বাগান সব সময়ই পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়। বসন্তে চেরি ফুল ফোটার সময় এখানে ভিড় হয় সবচেয়ে বেশি। 

আমরা গাইডকে অনুসরণ করে কেয়োমিজু গেটের পথ ধরে ইস্ট গার্ডেনের দিকে চললাম। প্রাচীন প্রাচীর আর সুসজ্জিত ল্যান্ডস্কেপ চোখে পড়ল। ঝরনার ধ্বনি, পাথরের সেতু এবং গোলাকার উদ্যান আমাদের মনে করালো শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসের পদচারণা। ইস্ট গার্ডেনের প্রবেশমুখেই চোখে পড়লো কুসুনকি মাসাশিগের মূর্তি। ধাতব ঘোড়ায় চড়া সামুরাই যেন সময়ের ভেতর দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে দৃঢ়তা, মুখে শান্তি মনে করিয়ে দেয়, কখনো কর্তব্য ত্যাগ করা যায় না। আমরা পাশে এসে ছবি তুললাম আর চারপাশে ছোট ছোট পর্যটক ও স্থানীয়রা শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল। কেউ ফুল রাখছিল, কেউ শান্তভাবে তার সাহসের গল্প মনে করছিল। 

ইস্ট গার্ডেনের গাছপালা, ফুলের সুবাস এবং পাখির ডাক-সবকিছু মিলিয়ে একটা চমৎকার আবহ সৃষ্টি করছিল। বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল আমরা শুধু প্রকৃতির মধ্যে নেই, বরং ইতিহাসের মাঝখানেও ভেসে চলছি। 

ইস্ট গার্ডেনের সৌন্দর্য উপভোগের পর আমরা এগিয়ে গেলাম আউটার গার্ডেনে। এখানে রয়েছে খোলা উদ্যান, লেক এবং প্রাচীন প্রাসাদের দেওয়াল। ভ্রমণকারীরা এখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারে এবং পাখির ডাক ও বাতাসের সুরে মন মেলাতে পারে। লেকের জলে সূর্যের প্রতিফলন, পাথরের সেতুর ওপর এর ছায়া একটা মনোমুগ্ধকর অবস্থা তৈরি করছিল। 

আমরা ধীরে ধীরে ইম্পেরিয়াল প্যালেসের প্রাঙ্গণের দিকে এগিয়ে গেলাম। শহরের ব্যস্ততা, ট্রেনের শব্দ এবং মানুষজনের হট্টগোল যেন একদম দূরে সরে গেছে। প্রতিটি ধাপ আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল ইতিহাসের গভীরে। 

টোকিওর গরম রোদে হেঁটে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম ইম্পেরিয়াল প্যালেসের সামনে। প্রাসাদটির বয়স হাজার বছরের বেশি, কিন্তু প্রতিটি ইট যেন আমাদের গল্প শোনাচ্ছে। প্যালেসের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজ উদ্যান, প্রাচীন কাঠের সেতু ও শান্ত জলরাশি যেন সময়কে থমকে রেখেছে। ইতিহাস আমাদের কানে ফিসফিস করে-এ প্রাসাদেই বসেছিলেন জাপানের সম্রাটরা, রাজনীতি রচনা হতো এবং দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হতো। 

আমরা হেঁটে গেলাম কেয়োমিজু গেটের দিকে। বৃক্ষের ছায়ায় ভরা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, প্রতিটি ধাপ যেন অতীতের পৃষ্ঠায় ছাপ ফেলছে। জলরাশির পাড়ে দাঁড়িয়ে জলপাখিদের খেলায় চোখ রাখলাম; শান্তির এ মুহূর্তে বুঝলাম, সম্রাটদের জীবনের প্রতিটি স্নিগ্ধ প্রভাত এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। 

কাব্যিকভাবে বলতে গেলে, প্যালেসটি যেন একটি অমোঘ চিত্রকর্ম-প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি বারান্দা একেকটি কবিতা। দিনের আলো পড়লে প্রাচীন দেওয়ালগুলোকে সোনালি আভা দেয় আর রাতের আঁধারে চাঁদের আলো যেন চুপচাপ সব ইতিহাস কথা বলে। 

হাঁটতে হাঁটতে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাছাকাছি একটা কফিশপে গিয়ে বসলাম। কাপচিনোর গরম ধোঁয়া, এবং চারপাশের মানুষজনের গল্প-সব মিলিয়ে মনে হলো, আজ আমরা শুধু ভ্রমণই করিনি, ইতিহাসকে অনুভব করেছি। ইস্ট ও আউটার গার্ডেন শুধু উদ্যান নয়; এগুলো ইম্পেরিয়াল প্যালেসের প্রাণ, যেখানে ইতিহাস, শান্তি এবং কাব্যের স্পর্শ একত্রিত হয়ে অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে। 

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ 

শেয়ার করুন