২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৭:৩৪:২৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান


দেশকে ইকবাল কবির জাহিদ
মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত দেশ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৯-২০২২
মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত দেশ ইকবাল কবির জাহিদ


বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেছেন, দেশ মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত। সমস্যাটি জটিল এবং বহুমাত্রিক। যেমন- মানুষের বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রে স্বাধীনতা নিবর্তনমূলক ডিজিটাল আইনে বন্দী এবং নিম্নমানের আচরণের শিকার। বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংক লোপাট, দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সরকারি ছত্রছায়ায় সীমাহীন দৌরাত্ম্য এবং সিন্ডিকেট ও সরকার একাকার- আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে ইকবাল কবির জাহিদ এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ। 

রাজনৈতিক জীবনে দেখা যায় ইকবাল কবির জাহিদ সপ্তম শ্রেণিতে স্কুলে ছাত্র ইউনিয়নের পাঠচক্রে সংগঠিত হন। অষ্টম শ্রেণিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর প্রাথমিক কমিটিতে সংগঠিত হন। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে অংশ নেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহরে পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে গ্রামাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধরত পার্টি কমরেডদের কাছে পাঠানোর কাজে যুক্ত থাকেন এবং শহরে স্কোয়াড গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গোপন প্রচার কাজে শামিল হন এবং নানাধরনের গুপ্ত হামলার সাথে যুক্ত থাকি।

’৭৩-এর এসএসসি এবং ’৭৪-এ যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে এইচএসসি পাঠরত অবস্থায় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন মেনে নিপীড়নমূলক পরিস্থিতিতে আত্মগোপনে চলে যান। ’৭৯ সালে জেলা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত এবং জেলা সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ’৮০ সালে শ্রমিক সংগঠনে প্রকাশ্য কাজের সাথে যুক্ত হন। এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)  কেন্দ্রীয় কমিটির বিকল্প সদস্য মনোনীত হন। ’৮৩ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ’৯২ সালে ঐক্য কংগ্রেসে গঠিত ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য নির্বাচিত হন। পার্টির ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্কসবাদী) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বর্তমানে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি চীন-ভারত-নেপালে পার্টি প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। 

নিচে ইকবাল কবির জাহিদের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আন্দোলনে অন্যতম সংগঠক তিনি। 

দেশ: দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন বলে মনে করেন?

ইকবাল কবির জাহিদ: দেশ মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত। সমস্যাটি জটিল এবং বহুমাত্রিক। যেমন- মানুষের বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রে স্বাধীনতা নিবর্তনমূলক ডিজিটাল আইনে বন্দি এবং নিম্নমানের আচরণের শিকার। বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংক লোপাট, দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সরকারি ছত্রছায়ায় সীমাহীন দৌরাত্ম্য এবং সিন্ডিকেট ও সরকার একাকার- আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। মানুষ দৈনন্দিন ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, লাগামহীন কর বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খরচের বোঝায় শ্রমিক-কৃষক, শ্রমজীবী-পেশাজীবী, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এখানে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার টাকা। মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৮২৪ ডলার। যার সাথে সাধারণ জনগণের সম্পর্ক নেই। সভা-সমাবেশ, সংগঠিত হবার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। হামলা-মামলা-গুম, জনগণের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি, প্রশাসনিক ও দলীয় সন্ত্রাসীদের হুমকির মাধ্যমে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। ভোটাধিকার ও নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ভোট সম্পন্ন করে জনগণের ভোটাধিকার নস্যাৎ করা হয়েছে। 

সরকার জনগণ থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারদলীয় স্বার্থ বা নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে জনগণের ওপর হামলে পড়েছে। দলীয় স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক সহিসংতাকে লালন-পালন করছে। ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের ওকালতি করছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পরিকল্পনার সাথে আমাদের ভূখ-কে যুক্ত করে নিয়েছে। ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে জড়িত। সরকারের ভারতের প্রতি নতজানু মনোভাবের কারণে অসম বাণিজ্য, ট্রানজিট, উজানের পানি প্রশ্নে ভারতের স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে। আমাদের সার্বভৌমত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

এমনই এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দেশ। সরকারের ওপর মানুষের ন্যূনতম আস্থা নেই। গণতান্ত্রিক পন্থায় তাদের ক্ষমতায় আসার কোনো সুযোগ নেই। 

দেশ: দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। এদের সাথে বাম প্রগতিশীলরাও আছেন। এ সরকার কি জনগণের আশা আকাক্সক্ষা পূরণে কিছু করছে না?

ইকবাল কবির জাহিদ: মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু দলটি এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কেবল জনগণের সামনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধুয়া তুলে তাদের প্রতারিত করছে। তারা সংবিধানে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানার প্রশ্ন, চার মূলনীতি- অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের স্বীকৃত অধিকারসহ সকল মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সংবিধানে ঘোষিত শোষণ-বৈষম্য দূরে থাক, লুটেরা দুর্বৃত্তশ্রেণির স্বার্থে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে জনগণের বিরুদ্ধেই তাদের অবস্থান। ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি সমর্থন এবং দেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শক্তিগুলোকে লালন-পালন করে রাজনৈতিক স্বার্থে সহিংসতার সৃষ্টিকে মদদ প্রদানের কোনোটিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে খাপ খায় না। বরং তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করছে। তাদের সাথে কমিউনিস্ট বামপন্থী নামধারী যারা আছেন, তারা প্রমাণ করেছেন তারা অধঃপতিত বুর্জোয়া পথের অনুসারী। ১৪ দলের ২৩ দফা শিকেয় উঠিয়ে রাখা হয়েছে। সরকার সমর্থিত বামপন্থীরা সে ব্যাপারে নীরব। রাষ্ট্রধর্ম বজায় রাখার ব্যাপারেও তারা নীরব। সর্বোপরি সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, ভোটাধিকার হরণসহ সকল অপকর্মের পাহারাদার এ সরকার। অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে তারা নিম্নমানের রুচির পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। আওয়ামী লীগের শরিকদের পক্ষে জনগণের ন্যূনতম স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব নয়।

দেশ:  দেশের পদ্মা ব্রিজের মতো এতো বড় একটা উন্নয়ন কর্মকা-কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। 

ইকবাল কবির জাহিদ: পদ্মা ব্রিজ উন্নয়ন প্রসঙ্গ আলোচনার পূর্বে যে কথাটা বলা দরকার তাহলো, উন্নয়ন তো মানুষের জন্য। তা যদি হয় তাহলে উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে হবে ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জনপদের সুদূরপ্রসারি স্বার্থ বিবেচনায় রেখে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের প্রশ্নকে আরো জরুরি করে তুলেছে। কিন্তু রামপালে সুন্দরবন বিধ্বংসী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ৭টি কয়লাত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, জনবসতির মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রসহ নানাধরনের মেগা দুর্নীতির জন্য মেগা প্রজেক্ট করে চলেছে। এসব প্রকল্প জনস্বার্থকে বিপন্ন করছে। এগুলি দেশের অস্তিত্ববিরোধী। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে অনেক উন্নয়ন দেখা যেতে পারে, কিন্তু তা কি পরিমাণ দুর্ভোগের কারণ হবে সেটি ইতিমধ্যে অনুমান করা যাচ্ছে। পদ্মা ব্রিজের কথায় আসা যাক। পদ্মা নদীর স্রোতের গতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। এর পানিবাহিত পলি অন্য যে কোনো নদী থেকে আলাদা। সেক্ষেত্রে কতটুকু বাস্তবসম্মত নীতি অনুসরণ করা হয়েছে তা এখনই সাধারণের বোধগম্য নয়। যমুনা ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রেও সে বিষয়টি বিবেচনা পায়নি। ফলে নদীর নাব্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও পলিদ্বারা নদী ভরাট হয়েছে এবং ব্রিজের মুখে চর পড়েছে।

দ্বিতীয়ত. ব্রিজের ওপর ডাবল রেললাইন হতে পারতো। রহস্যজনক কারণে তা করা হয়নি। সে দুর্ভোগ রেল চালু হওয়ার সাথে সাথেই অনুভব করা যাবে। তৃতীয়ত. পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু কৃষিজমি রক্ষা ও শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে কৃষিজমি বেহাত হচ্ছে। যত্রতত্র জমি হাতবদলের ধুম পড়ে গেছে। অপরিকল্পিত এ সকল কর্মকা- পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, সেদিকে মনোযোগ নেই।

দেশ: এর আগে কি দেশের অবস্থা এমন খারাপ থাকেনি?

ইকবাল কবির জাহিদ: ৫১ বছর ধরে লুটেরা শোষকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলগুলি পালাক্রমে দেশ চালিয়েছে। তারা সকলেই সাম্রাজ্যবাদী প্রেসক্রিপশন, মুক্তবাজার ও নয়া উদারীকরণের অর্থনীতি পক্ষে। ফলে জনগণের দিক থেকে ভালো থাকার সুযোগ হয়নি- পরিসংখ্যান তাই বলে। রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমানে সেটি ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। এটি লুটেরা শোষকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলগুলির শাসনের ধারাবাহিক পরিণতি।

দেশ: এসরকারের কি কি সফলতা আপনার চোখে পড়ে?

ইকবাল কবির জাহিদ : জনগণের দিক থেকে যদি বলেন, তাহলে তাদের জন্য কোনো সফলতা আসেনি। উন্নয়ন, দারিদ্রবিমোচন ইত্যাদি কর্মসূচিতে দুর্নীতি সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে।

দেশ: দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন। বলছেন গণতন্ত্র নেই। কিন্তু কই আপনাদের এমন দাবির পক্ষেতো জনগণকে সমথর্ন দিতে দেখা যায় না।

ইকবাল কবির জাহিদ  : এদেশের মাটির বৈশিষ্ট্য হলো- পানি পড়লেই নরম কাদা হয়ে যায়। আবার রৌদ্দুরে কঠিন শক্ত হয়ে যায়। এ মাটির মানুষের বৈশিষ্ট্যে তার মিল পাওয়া যায়। মানুষ নিরীহ নরম প্রকৃতির সহনশীল কিন্তু যখন বেঁকে বসে সেটা হয় উল্লম্ফন আকারে। নিমেষেই রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। জনজীবনের সংকট, প্রচণ্ড নির্যাতন, ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। যে পরিস্থিতি দেখছেন তা দ্রুত পাল্টে যেতে পারে। তবে আস্থাভাজন সাহসী নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। তাও কেটে যেতে পারে ঘটনার মধ্য দিয়ে।

দেশ: দেশে কোনো একটি বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠছে না? জনগণ কি এ সরকারের আমলে শান্তিতে আছে বলে রাস্তায় নামছে না?

ইকবাল কবির জাহিদ: উত্তর ওপরের প্রশ্নে বলা হয়েছে।

দেশ: এ সরকার কি দেশের উন্নয়নে কাজ করেনি?

ইকবাল কবির জাহিদ: এসবে উত্তর আগেই দিয়েছি। 

দেশ: শুধু কি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করছেন?

ইকবাল কবির জাহিদ: আমরা জনগণের পক্ষ থেকে লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণির দল আওয়ামী লীগের জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা করি। কেন তার বিরোধিতা করতে হবে তা তাদের আচরণ দ্বারা তারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। আমাদের লড়াইটা শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে, শোষণমূলক এ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে।

দেশ: এ সরকারকে আপনি কি পরামর্শ দেবেন?

ইকবাল কবির জাহিদ: পরামর্শ একটাই। এই মুহূর্তে পদত্যাগ করুন। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো সাথে আলোচনা করে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হোক।

দেশ: আপনি এক সময়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি করতেন। সে দল আপনাকে বহিষ্কার করেছে। এতো শ্রম, মেধা দিয়ে সে দলকে গড়ার পরও কেন বহিষ্কার হলেন। 

ইকবাল কবির জাহিদ: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি তথ্য সঠিক নয়। ওই পার্টি নেতৃত্বের বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি আত্মপ্রতিষ্ঠা, দলকে অধঃপতিত করা, সুবিধাবাদী চক্র গড়ে তোলা, পার্টি নির্ধারিত মতাদর্শ, রণনীতি রণকৌশল জলাঞ্জলি দিয়ে, পার্টিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অধীনস্ত করে ফেলায় পার্টি অভ্যন্তরে মতাদর্শ রক্ষার সংগ্রামকে পরাস্ত করার জন্যে পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র পরিপন্থী গঠনতন্ত্র না মেনে ১০ম কংগ্রেসে জেতার জন্য হাজারের ঊর্ধ্বে সদস্য করা, নেতৃত্বের দুর্নীতি, পার্টি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন, পার্টির সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে সভাপতির স্ত্রীকে সাংসদ বানানো ইত্যকার আদর্শবিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা করে আমরা ১০ম কংগ্রেস বর্জন করি এবং ২৯ ও ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন করি। গঠিত হয় ২৫ জনের সেন্ট্রাল কমিটি। পরবর্তীতে অস্থির হয়ে ৪ জন সিপিবিতে যোগ দিয়েছেন। বাকিরা সকলেই পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ আছেন।

দেশ: আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি যে আদর্শ ও রাজনীতি নিয়ে দল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সে আর্দশে এখন আর নেই। তাদের দ্বারা সে ধরনের আর্দশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব না?

ইকবাল কবির জাহিদ : হ্যাঁ।

দেশ: বলা হয়ে থাকে আদর্শগত বিরোধের জেরে অবশেষে ভেঙে গিয়েছিল সেই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। পার্টির ১০ম কংগ্রেস বর্জন করে সেসময়ে নেতারা ২৯-৩০ নভেম্বর যশোরে ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির’ মতাদর্শ রক্ষা সমন্বয় কমিটির ব্যানারে জাতীয় সম্মেলন করে ১১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নামে এ দলের সভাপতি নুরুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ইকবাল কবির জাহিদ। এখন প্রশ্ন আপনি তো সে অবস্থানেও এখনো থাকতে পারলেন না? কারণ কি? তাহলে কি ধরে নেবো ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির’ থেকে সরে যাওয়া ভুল ছিল। সে সময়ে কমরেডরাও এখন আর নেই আপনার সাথে। কারণ কি?

ইকবাল কবির জাহিদ: এমন প্রশ্নের উত্তর আগেই বলে ফেলেছি। 

দেশ: বলা হয়ে থাকে একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন্নেছা বিউটিকে মনোনয়ন দেয়ায় পার্টির একটি অংশ তা মেনে নিতে পারেনি। এসব বিবেচনা করেই দলের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করেছে একটি অংশ। আসলে বিষয়টি আদর্শগত ছিল না। আপনারা কয়েকজন এমপি পদ পাননি, তাই সে সময়ে দল ভেঙেছেন, কি বলেন? 

ইকবাল কবির জাহিদ: তথ্যটি সঠিক নয়। ওয়ার্কার্স পার্টি বামফ্রন্ট ও ১১ দলের নীতিগত অবস্থান থেকে সরে এসে বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করে আওয়ামী লীগের সাথে একমঞ্চে অবস্থান নেয়। এটি ছিল পার্টির গৃহীত রাজনীতি পরিপন্থী। তার পূর্ব থেকেই পার্টিকে লুটেরা, বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের সাথে একমঞ্চ করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত ছিল এবং এ প্রসঙ্গে বিতর্ক চলা অবস্থায় নেতৃত্ব ১৪ দলীয় জোট গঠন করে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় একসাথে আন্দোলন, একসাথে নির্বাচন, একসাথে সরকার গঠন করা হবে। এই ঘোষণায় ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বের প্রধান অংশ অতি উৎসাহী হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে পার্টি সিদ্ধান্ত ও শৃঙ্খলা উপেক্ষা করে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। আমিসহ হায়দার আকবর খান রনো, নুরুল হাসান, আজিজুর রহমান তার বিরোধিতা করে পার্টি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্টির ‘হাতুড়ি’ প্রতীকে নির্বাচন করার পক্ষে মতামত প্রদান করি। কিন্তু তারা তা কর্ণপাত করেননি। সরকারে অংশগ্রহণের প্রশ্নে আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট ছিল যে, মন্ত্রিত্বে অংশগ্রহণ করা যাবে না। নেতৃত্ব ক্ষমতার লোভে ব্যক্তিগত স্বার্থে পার্টি গৃহীত মতাদর্শ, রণনীতি ও রণকৌশল জলাঞ্জলি দেয়। পার্টি অভ্যন্তরে এই মতাদর্শগত সংগ্রামে আমি আন্তঃপার্টি সংগ্রামে রত থেকেছি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিদ্ধান্ত হয় ‘নৌকা’ প্রতীকের বাইরে ‘হাতুড়ি’ প্রতীকেও নির্বাচন করা হবে। সে মোতাবেক ৬০ জন কমরেড প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আমার নির্বাচনী এলাকায় হাতুড়ি নিয়ে নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি সভাপতি নিজেই দিয়ে আসেন। কিন্তু নমিনেশন পেপার প্রত্যাহারের দিন অন্যদের মতো আমাকেও প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। ফলে ‘নৌকা’ না পাওয়া বিষয়ে আমার সম্পর্কে প্রচার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বাস্তববিবর্জিত।

দেশ: এবার আসি আপনাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে। বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্কসবাদী) ঐক্য কংগ্রেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ গঠিত হয়। এ ব্যাপারে আপনি কি বার্তা দিতে চান? এভাবে ভাঙাভাঙি আর বিভেদের মধ্যে কি বামদের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ছে?

ইকবাল কবির জাহিদ: এক্ষেত্রে বলতে চাই- মানুষ কি চাচ্ছেন? মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ গণবিচ্ছিন্ন একটি দল। বিএনপি-জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ অন্য লুটেরা, বুর্জোয়াশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলো পরীক্ষিত। মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। অপরদিকে বামপন্থীরা বিভক্ত, শক্তি দুর্বল। মানুষ চাই বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হোক। মানুষের এই আকাক্সক্ষা আমরা ধারণ করছি এবং এই ঐক্য তার শুভযাত্রা। অপরাপর কমিউনিস্ট শক্তিসমূহের সাথে আলোচনা ও মাঠে একসাথে কাজের কর্মপন্থা আমরা গ্রহণ করেছি। একইসাথে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ও জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ প্রত্যয় ঘোষণা করছে।

দেশ: কেন বাম দলগুলি একমঞ্চে সত্যিকার অর্থে আসতে পারে না। কারণ কোনো না কোনোভাবে এই বাম দলগুলি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পক্ষে থাকে। এভাবে কি দেশে সত্যিকার অর্থে কোনো বাম মোর্চা কার্যকর সম্ভব?

ইকবাল কবির জাহিদ: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বড় ধরনের সংকট হলো- ডান সুবিধাবাদ ও বাম বিচ্যুতি। বর্তমানে ডান সুবিধাবাদী, সংস্কারবাদী বিচ্যুতি প্রাধান্যে রয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে নিজস্ব শ্রেণিশক্তির ওপর দাঁড়াতে না পারার দুর্বলতা বুর্জোয়াদেরই পক্ষে যায়। এমন অবস্থায় বাম গণতান্ত্রিক জোট নিজস্ব শ্রেণিশক্তির ওপর দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া ব্যবস্থা ও রাজনীতির বিরুদ্ধে বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য নিজস্ব শ্রেণিশক্তি সমাবেশের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট বামপন্থীদের ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের চেষ্টা করছে। গত ২৫ আগস্ট জ¦ালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদের হরতালে ৯ বাম দল তার সাথে যুক্ত হয়েছে। এই ধারা বাম গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে ব্যাপক জনগণকে সংগঠিত করে জনগণের গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হবে।

শেয়ার করুন