০৮ মে ২০১২, বুধবার, ০৭:০০:১৮ পূর্বাহ্ন


সাবধান রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে
ড. এম.এম. আদেল
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৪-২০২২
সাবধান রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে


মুসলিম বিশ্ব রমজানকে স্বাগতম জানায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। মনে হয় ব্যবসায়ীরা রমজানের মৌসুমেই সারা বছরের অর্থ উপার্জন করবেন। ধন-সম্পদের লোভ মানুষের মধ্যে এতোই প্রকট। অর্থশাস্ত্রে বলা হয় যে, মানুষের অভাব  অফুরন্ত।  অভাব পরস্পর নির্ভরশীলও।  ধন-সম্পদের লিপ্সাটাই  অর্থশাস্ত্রে অন্যভাবে বলা হয়েছে। 

ধন-সম্পদের অপকারিতা সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে, এমনকি তোমরা কবরস্থানে পৌঁছে যাও। এটা কখনো উচিত নয়। তোমরা সত্বরই জেনে নেবে।’ সুরা আততাকাসুর, ১০২:১-৩)। কবরস্থানে পৌঁছে যাওয়ার সময় হলেও মানুষের মধ্যে ধন-সম্পদ আহরণের ইচ্ছা কমে না। মৃত্যুর পর গাফিলতি বোঝা যাবে। 

‘মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো তিগ্রস্ত।’  (সুরা আল মুনাফিকুন, ৬৩:১১)

‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীাস্বরূপ আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার।’ (সুরা  আত তাবাগুন, ৬৪:১৫)

‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্যই কামনা করে, হয় আমি তাদের দুনিয়াতেই তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেবো এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না।’ (সুরা  আল-হুদ ১১:১৫)

‘এরাই হলো সেসব লোক আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছু নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে; আর যা কিছু উপার্জন করেছিল, সবই বিনষ্ট হলো।’ (সুরা আল-হুদ:১১:১৬)

‘সত্যি সত্যি মানুষ সীমা লঙ্ঘন করে,।’ ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।’ (সুরা আল-আলাক, ৯৬:৬-৭)

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে  রাসুলুল্লাহ (সা.)কে বলেন:

‘বলুন, যদি আমার পালনকর্তার রহমতের ভাণ্ডার তোমাদের হাতে থাকতো, তবে ব্যয়িত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অবশ্যই তা ধরে রাখতে। মানুষ তো অতিশয় কৃপণ।’ (সুরা বনি-ইসরাইল, ১৭:১০০) (http://www.quraanshareef.org/)

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে সুরা সাবায় অতি লোভের দরুণ অকৃতজ্ঞের শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন:

‘সাবার (এখন ইয়েমেনের একটা শহর) অধিবাসীদের জন্যে তাদের বাসভ‚মিতে ছিল এক নিদর্শন- দুটি উদ্যান, একটি ডানদিকে, একটি বামদিকে। তোমরা তোমাদের পালনকর্তার রিজিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। স্বাস্থ্যকর শহর এবং মাশীল পালনকর্তা।

অতঃপর তারা অবাধ্যতা করলো, ফলে আমি তাদের ওপর প্রেরণ করলাম প্রবল বন্যা! আর তাদের উদ্যানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই উদ্যানে, যাতে উদগত হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কুলবৃ।

এটা ছিল কুফরের কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ব্যতীত কাউকে শাস্তি দেই না।

তাদের এবং যেসব জনপদের লোকদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলম, সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং সেগুলোতে ভ্রমণ নির্ধারিত করেছিলাম। তোমরা এসব জনপদে রাতে ও দিনে নিরাপদে ভ্রমণ করো।

অতঃপর তারা বললো, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের ভ্রমণের পরিসর বাড়িয়ে দাও। তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। ফলে আমি তাদেরকে উপাখ্যানে পরিণত করলাম এবং সম্পূর্ণরূপে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে। 

আর তাদের ওপর ইবলিস তার অনুমান সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল। ফলে তাদের মধ্যে মোমিনদের একটি দল ব্যতীত সকলেই তার পথ অনুসরণ করলো।

তাদের ওপর শয়তানের কোনো মতা ছিল না, তবে কে পরকালে বিশ্বাস করে এবং কে তাতে সন্দেহ করে, তা প্রকাশ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আপনার পালনকর্তা সব বিষয়ে তত্ত¡াবধায়ক।’ ( সুরা আল-সাবা, ৩৪:১৫-২১)

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তবে তোমাদেরকে আরো দেবো এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সুরা ইব্রাহীম, ১৪:৭)

অসত ব্যবসায়ীরা কোরআনের এই  অমূল্য শিা ভুলে গিয়ে নগদ যা পায় হাত পেতে নেয়ার চেষ্টা করে থাকে রমজান মাসে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) ধন-সম্পদপিপাসু ব্যক্তিদের সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছেন। উনি (সা.)  বলেছেন যে, পানি যেমন ঘাস উত্পন্ন করে,  ধনাসক্তি ও প্রভুত্বের লিপ্সা আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তেমনি মোনাফেকি উত্পন্ন করে থাকে। উনি  (সা.) আরো বলেছেন যে, ছাগলের পালের মধ্যে দোটা ক্ষুধার্ত  বাঘ ঢুকে যা না তি করতে পারে, ধন ঐশ্বর্য ও মানমর্যাদার মোহ আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে তা থেকে অধিক তি করতে পারে। রাসুলুল্লাহর (সা.)-এর পরে মুসলমানদের মধ্যে একদলের স্বভাব হবে নানা বিচিত্র কারুকার্যপূর্ণ বহু দামি পোশাক পরিধানের, মনমোহিনী সুন্দরী কামিনী রাখার, অল্পাহারে পরিতৃপ্ত না হওয়ার, প্রাচুর্যেই তাদের আকাক্সক্ষার নিবৃত্ত না হওয়া, সংসার অর্জনের সর্বশক্তি নিয়োগ, দুনিয়াকেই প্রভু বলে মনে করা, সবকিছুই দুনিয়া হাসিলের জন্য করা ইত্যাদি। দুনিয়া হাসিলই মুখ্য হবে আর ধর্ম-কর্ম গৌণ হবে। উক্ত স্বভাবের এক বা একাধিক কোনো ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যাবে। এই লোকজন ইসলামকে বিনষ্ট করে, এদেরকে সম্মান না করতে, এদের অসুস্থতায় না দেখতে, এদের জানাজায় অংশগ্রহণ না করতে, এদেরকে সালাম না দিতে বলেছেন। যারা এসব উপদেশ না শুনবে তারও ইসলাম বিনষ্টকারীদের মধ্যে গণ্য হবে। ( উত্স: কিমিয়ায়ে সাআদাত, ইমাম গাজ্জালী (রহ.), তৃতীয় জিল্দ,  ষষ্ঠ পরিচ্ছদ ধনাশক্তি পৃ. ১৮৩-১৮৪)।  

রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে লোভ সংবরণ করতে বলেছেন। কারণ পূর্বেকার প্রজন্ম লোভের পিছনেই ধ্বংস হয়েছে। লোভ তাদেরকে কৃপণ করেছিল। লোভের দরুণ তারা পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। লোভ তাদরেকে অভদ্র আচরণে ঠেলে দিয়েছিল। (সুনান আবু দাউদ)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর সাহায্য পেতে আমাদেরকে গণনা ছাড়া দান করতে বলেছেন, আর মওজুদ করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)

আমাদের দরিদ্রতাকে ভয় করতেন না, বরং ভয় করতেন আমাদের ধনলিপ্সার প্রতিযোগিতা নিয়ে। আমাদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে ভয় করতেন না, বরং উনি ভয় রকরতেন আমরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কি করে বসি (মসনদে আহমদ)।

তিনি (সা.) বলেছেন যে, বদান্যতা আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে, বেহশতের সম্মুখে নিয়ে আসে, লোকজনের নিকট নিয়ে আসে। কার্পণ্যতা আল্লাহর থেকে দূরে নিয়ে যায়, বেহেশত থেকে দূরে ঠেলে, লোকজন থেকে দূরে নিয়ে যায় আর দোজখের নিকট নিয়ে আসে। একজন অশিতি উদার ব্যক্তি বিদ্বান বখিল থেকে ভালো।  (সুনান আল-তিরমিজি) 

তিনি আরো বলেছেন যে, বিলাসিতা থেকে সাবধান। আল্লাহর বান্দারা বিলাসিতায় জীবনযাপন করে না। (মসনদে আহমদ) 

আদম সন্তানের যদি একটা স্বর্ণপূর্ণ উপত্যকা থাকতো, সে দুটো উপত্যকা চাইতো। তার মুখ কবরের বালি ছাড়া আর কিছুতে পূর্ণ হতো না। তবুও আল্লাহ তায়ালা অনুতপ্তকারীদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে থাকেন (বুখারী ও মুসলিম)। ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে যে, আমরা যত পাই, তত চাই। চাওয়া-পাওয়ার অন্ত নাই। ধন-সম্পদে আমাদের মুখ ভরবে না। একমাত্র কবরের বালিই আমাদের মুখ ভরাতে পারে। 

আদম সন্তান উদরের থেকে খারাপ কোনো পাত্রকে ভর্তি করতে পারে না, যেহেতু কয়েক কামড় (গ্রাসই) তার মেরুদণ্ড সোজা রাখার জন্য যথেষ্ট। যদি সে এটা না করতে পারে, তবে তার এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি ও অন্য তৃতীয়াংশ বাতাস দিয়ে পূর্ণ করবে।  (সুনান আল-তিরমিজি)

নিশ্চয়ই প্রত্যেকটা কওমের জন্য একটা পরীা ছিল। আর তাঁর কওমের জন্য পরীা হচ্ছে ধন-সম্পদ (সুনান আল-তিরমিজি)। 

‘তোমরা জায়গা-জমির আয়োজন করো না, অন্যথায় দুনিয়ার মোহ-মায়া তোমাদের গ্রাস করে ফেলবে।’ (মুকাশাফাতুল কুলুব, পৃ. ৩৩৫)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন- মানুষ তো ‘আমার মাল, আমার মাল’ বলে বেড়াচ্ছে; অথচ তার মাল তো শুধু এটুকু যা সে খেয়ে শেষ করেছে, কিংবা পরিধান করে পুরোনো করে ফেলেছ অথবা দান-সদকা করে আখেরাতের জন্য জমা করেছে।’ (মুকাশাফাতুল কুলুব, পৃ. ৩৩৩)।

‘তিনটি বস্তু আদম সন্তানের বন্ধু- তন্মধ্যে একটা তার রুহ কবজ পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকবে আর একটা কবর পর্যন্ত, আর একটা হাশরের মাঠ পর্যন্ত।  প্রথমটি তার মাল, দ্বিতীয়টা তার আত্মীয়স্বজন, তৃতীয়টা হচ্ছে তার আমল (মুকাশাফাতুল কুলুব, পৃ. ৩৩৪)।

আমেরিকায় সব দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এই কোভিডের আমলে। সব স্তরের আমেরিকানরা এই মূল্যস্ফীতি অনুভ‚ত  করছেন। তবে এই চড়ামূল্য বিশেষভাবে লণীয় হালাল দ্রব্যাদির বাজারে। দিনার স্ট্যান্ডার্ডের জরিপে গ্রোসারি সেক্টর ১৩.৮ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন মুসলমানের বাস।  তাদের প্রায় ৪০ শতাংশ দরিদ্রতার সীমায় কিংবা তার নিচে অবস্থান করেন। পিউ গবেষণা কেন্দ্র বলে ইনাদের ৬০ শতাংশই ইমিগ্র্যান্ট। মুসলমান ব্যবসায়ীরা হালাল মাংস বিক্রয় করবেন, অহালাল থেকে চড়াদামে। 

রমজান সংগ্রামের সময় বিশেষ করে বিশ্বের সর্ববৃহত শরণার্থী শিবির কেনিয়ার দাবাবের অধিকাংশের। সোমালিয়ার সংঘাত আর দুর্ভি এড়ানোর জন্য হাজার হাজার লোক এই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। কোনো কোনো পরিবার এক পকালের জন্য কয়েক কিলো ভুট্টার আটা, মটরশুঁটি আর রান্নার তেল পেয়ে থাকে। এগুলো হিসাব করে ব্যবহার করতে হয়। রমজানে এ থেকে ভালো খাবার তাদের জন্য জোটে না। 

প্রতিটা মুসলিম দেশেই- পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইয়েমেন, আজারবাইজান- রমজান মাস আসার পূর্বেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

ধন-সম্পদের ওপর এতো কিছু বলার পরও মুসলিম বিশ্বে রমজান মাস হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অসাধু ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। 

আর পশ্চিমা বিশ্বে অমুসলমান ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য  হ্রাস করে থাকেন ধর্মানুষ্ঠান পালনের জন্য। 

শেয়ার করুন