০৫ মে ২০১২, রবিবার, ৬:৫১:৫৬ পূর্বাহ্ন


মাহমুদুর রহমান মান্নার প্রশ্ন
ডেটলাইন ১০ ডিসেম্বর, কি ভাবছে বিএনপি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-১১-২০২২
ডেটলাইন ১০ ডিসেম্বর, কি ভাবছে বিএনপি মাহমুদুর রহমান মান্না


জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে নাগরিক ঐক্য এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। আয়োজিত এ আলোচনা সভার বিষয় ছিল ‘যুগপৎ আন্দোলন ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর’। এতে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না তার নিজ এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নবগঠিত রাজনৈতিক মোর্চার বক্তব্যও তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি তার বক্তব্যে আগামী ১০ ডিসেম্বর নিয়েও বক্তব্য উঠে আসে। 

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান ১০ ডিসেম্বর নিয়ে একটি বক্তব্য দেন। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। এতে সরকারের দলও নড়ে চড়ে বসে। এরপর থেকেই জনমনে ও রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কী হতে যাচ্ছে ১০ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর নিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সে আলোচনা সভায় উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছি ১০ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরে কী হবে?


বিএনপির ইতোমধ্যে কয়েকটি সমাবেশ হয়েছে। আরও তিন-চারটা সমাবেশ হবে। সেই সমাবেশগুলো একসঙ্গে যোগ করে ঢাকার কোনও এক জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে পারবেন? তার মানে ঢাকায় একটা হুলুস্থুল হবে। মহাসমাবেশ, যেটা জীবনে এর আগে কখনও হয়নি। আপনারা কি মনে করেন এরপরই এই সরকারের পতন হবে? এব্যাপারে মান্না বিস্তারিত ব্যাখায় বলেছেন বলেন, দেশ এখন একটি পরিস্থিতির সরাসরি মুখোমুখি হয়েছে। এখন সেই পরিস্থিতি ও আমাদের সবার সামনে আছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কয়েকটি মহাসমাবেশ হয়েছে, যেখানে জনসমাগম দেখা গেছে। বিএনপি কি নিজেও বুঝেছিল এই মহাসমাবেশ এত বড় হবে?


একের পর এক এই মহাসমাবেশে শক্তির তরঙ্গ সৃষ্টি হবে? তিনি আরও বলেন, আমরা সাহস নিয়ে যদি রাস্তায় নামতে পারি, মনে করি এই সরকারের পতন হবে। পুরা পরিস্থিতিটাই বদলে গেছে। এই সমাবেশগুলোর আগে একটা ভয়ের চাদর সারা দেশে ঢেকে গিয়েছিল। এখন কোনও ভয়ের চাদর নেই। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের মাঝে প্রত্যয় এনে দিতে পারবেন যে আমরা জয়ের দিকে যাচ্ছি। সরকার ঢাকায় সমাবেশ করতে দেবে না মন্তব্য করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, ঢাকার সমাবেশ দেখে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন না। বরং ক্ষমতা থাকার জন্য যা যা দরকার তা-ই করবেন। আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণতন্ত্র মঞ্চের রাজনৈতিক দলের নেতারা।

এদিকে আলোচনা সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর চুম্বকাংশ পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো। 


মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশ আজ এক ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বর্তমান অবৈধ ক্ষমতাসীনদের ১৪ বছরের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, দুঃশাসনে দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।  ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের মধ্যরাতের ভোট ডাকাতির মাধ্যমে তারা দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে একটি অকার্যকর, জবাবদিহিতাহীন, অগণতান্ত্রিক সর্বপরি একটি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সরকার দেশের বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করেছে।

সরকার এবং সরকারি দলের মদদপুষ্টরা গত ১৪ বছরে ১০ লাখ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খালি করে ফেলেছে। তারা কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছে। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।


সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং অপশাসনে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় ক্রমশ কমছে।  দেশের অর্থনীতি আজ দেউলিয়া হবার পথে। রিজার্ভ সংকটের কারণে অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রীও আমদানি করা যাচ্ছে না।  মূল্যস্ফীতি অতীতের যেকোন সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য এখন নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। উন্নয়নের গল্প শোনানো সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং দফায় দফায় দেশে দুর্ভিক্ষের আশংকার কথা বলছেন।  দেশের জনগণ ফুঁসে উঠেছে।  


বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সভা সমাবেশে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগনের অংশগ্রহণ গণ অভ্যূত্থানের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রশাসন এবং দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সরকার এসব সমাবেশ বন্ধ করার চেষ্টা করছে।  ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং সরকারের অনুগত পরিবহন নেতাদের দ্বারা সমাবেশের ২/৩ দিন আগে থেকে বাস, ট্রাক, লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে নির্লজ্জভাবে জনগণের স্বত:ফূর্ত অংশগ্রণকে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করছে।  কিন্তু তারপরও জনস্রোত ঠেকাতে পারেনি। এই যৌবন জল তরঙ্গ রুধিব কি দিয়া বালির বাঁধ? 


অনেকে মনে করেন, জনগণের অভ্যূত্থান ঠেকাতে সরকার আরও কঠোর হবে। প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের কথায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।  আমরা মনে করি, যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, তা ঠেকানো সম্ভব নয়।  নাগরিক ঐক্য জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে।  কোন রাজনৈতিক দলের বা নেতৃত্বের ডাকে নয় বরং জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে সকল বাধা অতিক্রম করে সরকার বিরোধী কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে।  এই জনস্রোত ঠেকানো যাবে না। জনগণ অভ্যূত্থানের জন্য প্রস্তুত। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব এবং সকল বিরোধী শক্তির সর্বব্যাপক ঐক্য।  

ইতিমধ্যে প্রায় সব ক’টি রাজনৈতিক দল এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেবার ব্যাপারে একমত হয়েছে। বর্তমান সরকারের পতনের পর একটি অর্ন্তÍবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই অর্ন্তবর্তী সরকারের কাঠামো বা রূপরেখা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জোট তাদের মতামত দিয়েছে।  নাগরিক ঐক্য মনে করে, অর্ন্তবর্তী সরকার বা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, তার কাজ হবে বিগত ১৪ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করে একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করা।  



এই সরকারকে একদিকে যেমন দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে হবে, অন্যদিকে আমলাতন্ত্র, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণের সংস্কার; লুটপাট-দুর্নীতি, নিপীড়ন-নির্যাতনের বিচার এবং সর্বক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের দখলদারিত্ব দূর করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। 



আমরা সরকার পতনের এক দফা দাবির সাথে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রত্যাশা করি। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে সাংবিধানিক এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কর্মসুচি উত্থাপন করেছি। আমরা চাই, বিদ্যমান শাসন কাঠামোর গঠনমূলক পরিবর্তন যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার সুযোগ না পায়।  


নাগরিক ঐক্য কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।  আমরা বলেছি, দেশের মানষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ৬ কোটি দরিদ্র মানুষকে মাসে এক হাজার টাকা করে দিতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে এই ব্যবস্থার পরিধি আরও বিস্তৃত করতে হবে। প্রান্তিক জনগণ থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত বিনামূল্যে ওষুধসহ চিকিৎসা চিশ্চিত করতে হবে।  হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করবে। ধাপে ধাপে শিক্ষার ব্যয় কমিয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ সহজ করতে হবে।


বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন করার মাধ্যমে জনগণের ন্যায়বিচার পাবার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করে শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সরকারি সেবা পাবার জন্য গ্রামের মানুষের শহর এবং রাজধানীর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে একটি জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।  


নাগরিক ঐক্য মনে করে, রাষ্ট্রের কাঙ্খিত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য এই সকল কর্মসূচির বিষয়ে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।  ইতিমধ্যে আমরা ৭ টি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন সরকারের পতন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে সত্যিকার জবাবদিহিতামূলক, গণতান্ত্রিক, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র নির্মাণের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছি। আমরা প্রত্যাশা করি, অপরাপর রাজনৈতিক শক্তির সাথে এই সকল কর্মসূচিকে সামনে রেখে সমঝোতার ভিত্তিতে আগামী দিনের লড়াইকে আরও বেগবান করতে পারব।    


সংকট উত্তরণে সবার আগে এই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। আর সেজন্য প্রয়োজন সকল বিরোধী শক্তির ব্যাপক ঐক্য।  কিন্তু দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সকল বিরোধী শক্তির একই মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব না’ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে যুগপৎ কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে এই অবৈধ ফ্যাসিবাদী সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। এই যুগপৎ আন্দোলনে প্রত্যেককে নিজের নিজের জায়গা থেকে দলীয় কিংবা জোটগতভাবে অংশ নিতে হবে। বিভিন্ন দল বা জোটের মধ্যে মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু সেই মতভেদ ভুলে ন্যূনতম ঐক্যমতের ভিত্তিতে, স্বৈরাচার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার প্রশ্নে এক দফা দাবি নিয়ে এই আন্দোলনে অংশ নেয়াই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।


যেই প্রত্যাশা নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল, এখনো সেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আমরাই সেটা পারি। পারি সবাই মিলে দেশটাকে আমূল বদলে দিতে।  সবাই মিলে আন্তরিকভাবে সঠিক কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হতে পারলে, সেই সোনার বাংলা গড়া সম্ভব।  নাগরিক ঐক্য সবাইকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।

শেয়ার করুন