মাত্র ১৯ বছর বয়সেই বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছে কিলিয়ান এমবাপ্পের। যে বয়সে ফুটবলারদের ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার কথা না, সেখানে বিশ্বকাপ জিতে রীতিমত রেকর্ড গড়েছেন ফরাসি এ তরুণ। এত অল্প সময়ে বিশ্বকাপে পেলে, ম্যারাডোনার রেকর্ড ভেঙে ফেলেছেন। মেসির রেকর্ডও ছুঁতে চলেছেন। ছাড়িয়ে গেছেন দিয়েগো ম্যারাডোনা ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে।
১৯৫৮ সনে পেলের পর থেকে বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে তিনি হচ্ছেন পাঁচটি গোল করা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়।
কৈশোরে ফুটবল খেলতে গিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে অনুকরণ করতেন এমবাপ্পে। ছোটবেলায় এভাবেই নিজের ঘরের দেয়াল জুড়ে টাঙিয়ে রাখতেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ছবি। পুরো ঘরটা পোস্টারে ঢাকা। একজন ফুটবলারের পোস্টার। ঘরে ঢুকলে এটাকে একজন কিশোরের ছেলেমানুষি মনে হতে পারে! তবে আসলে মোটেও তা নয়। প্রত্যেকটা ছবির সঙ্গে জুড়ে আছে ওই কিশোরের সংকল্প, একদিন আমিও এমন হবো। এমবাপ্পে নিজের ঘরের দেয়ালজুড়ে রোনালদোর ছবি লাগিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন রোনালদো হওয়ার। তার সে পরিকল্পনা,পরিশ্রম সম্ভবত সফল।
রাশিয়ায় অনুষ্টিত বিশ্বকাপ জয়ী এমবাপ্পে, ট্রফি হাতে। ছবি সংগৃহীত
২০১৭ সালের ২৫ মার্চ, মাত্র ১৮ বছর, ডান পায়ে ফুটবল খেলায় পারদর্শী লুক্সেমবুর্গের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফ্রান্সের হয়ে অভিষেক করেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। ওই ম্যাচের ৭৮তম মিনিটে আক্রমণভাগের খেলোয়াড় দিমিত্রি পায়েতের বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে প্রবেশ করেন তিনি। ম্যাচে তিনি ১২ নম্বর জার্সি পরিধান করে কেন্দ্রীয় আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেন ওই ম্যাচে ৩-১ গোলে জয়লাভ করে ফ্রান্স। ফ্রান্সের হয়ে অভিষেকের বছরে এমবাপ্পে সর্বমোট ১০ ম্যাচে একটি গোল করেছেন।
রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপের জন্য দিদিয়ে দেশঁয়ের অধীনে ঘোষিত ফ্রান্স দলে স্থান পাওয়ার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান এমবাপ্পে। ২০১৮ সালের ১৬ জুন তারিখে, তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে ফিফা বিশ্বকাপে অভিষেক করেন তিনি। পাঁচদিন পর, পেরুর বিরুদ্ধে ম্যাচের ৩৪তম মিনিটে তিনি ফিফা বিশ্বকাপে তার প্রথম এবং ম্যাচটির জয়সূচক গোলটি করেছেন। এই আসরের ফাইনালে তার দল ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে উক্ত প্রতিযোগিতার ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, ম্যাচের ৬৫ তম মিনিটে লুকাস এরনঁদেজের অ্যাসিস্ট হতে গোল করেছেন। ওই বিশ্বকাপে তিনি ৭ ম্যাচে চারটি গোল করে তিনি সেরা যুব খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয়লাভ করেন।
টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্স। ২০১৮ সালের পর ২০২২ সালেও বিশ্ব মঞ্চে জয়ের কেতন উড়ানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ফরাসিরা পৌঁছে গিয়েছে ফাইনালে। আর এই যাত্রায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী এক তরুণ প্রতিভা, কিলিয়ান এমবাপ্পে।
বিশ্বকাপের এবারের আসরে মাত্র পাঁচ ম্যাচেই পাঁচ গোল করেছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে, আছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় সবার উপরে। সেই থেকে সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরো দুই গোল।
সেই এমবাপ্পে এখন...
এই বয়সেই যেসব রেকর্ড ইতিমধ্যে গড়েছেন, তাতে এক সময়ে মেসি, রোনালদো, নেইমারকে ছাড়িয়ে যাবেন হয়তোবা।
রিসেন্ট ফুটবলে স্টার হয়ে আসা এমন অনেকের গল্পটাই হয়ত কাছাকাছি। কেউ কেউ হয়ত দেয়ালজুড়ে মেসির ছবি লাগিয়ে বড় হয়েছেন।
সেইসব তারুণ্যের আজকে জয় হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে।
ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরের তরুণদের মধ্যেও একসময় আমাদের দেশের মত দলাদলি, গ্যাংবাজি, খুনাখুনি ছিলো। ১৮৯০ সালের দিকে সে শহরের নীতিনির্ধারকরা এই তরুণদের কন্ট্রোল করতে তাদের দলাদলিকে কাজে লাগিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর ম্যানচেস্টার সিটি নামে দুটো ফুটবল ক্লাব খুলে দিলেন। তরুণরা মাস্তানি ছেড়ে দিয়ে আপন করে নিলো ফুটবলকে।
এই যে ফুটবল ওয়ার্ল্ডকাপে সারাবিশ্বে একটা জোয়ার চলে যাচ্ছে। মাত্র ৩১ বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়া ক্রোয়েশিয়া ২০১৮সালে ফাইনাল ২০২২ সালে সেমি ফাইনাল খেলে ফেললো এসব থেকেও আমাদের দেশে কোন ফুটবলের জোয়ার এলো না।
রাতজেগে খেলা দেখা আমাদের তরুণদের মধ্যে দলাদলি গ্যাংবাজি করা ছেলেরা পরের দিনই গেলো নিজের বয়সী ভাই ব্রাদারদের পেটাতে। কেউ কেউ গেলো নিজের শিক্ষকের মুখের উপর আঙুল উঁচু করে কথা বলতে।
আমরা হয়ত কিছুই শিখলাম না। কিংবা আমাদের কিছুই শেখানো হল না।
আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, আমরা খেলার মাঠে দুটো ছক্কা মেরে এসে কিংবা ফুটবলে একটা গোল দিয়ে এসে সেটাকে কোন অর্জন হিসেবে বাসায় বলতে পারিনি।
এই প্রজন্মের অবস্থা আরও খারাপ।
মরক্কোকে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে এখন ফ্রান্স। যার অগ্রভাগে এমবাপ্পে। মরক্কোর বিপক্ষে জয়ের পর প্রিয় বন্ধু আশরাফ হাকিমি ভেঙ্গে পরলে এভাবেই শান্তনা দিতে দেখা যায় ফরাসি নয়াককে/ছবি সংগৃহীত
এমবাপ্পে যে বয়সে রোনালদোর ছবি দিয়ে দেয়াল সাজিয়েছিলেন আমাদের সে বয়সের ছেলেদের হাতেও আমরা রাজনীতির ক্ষমতা তুলে দিয়েছি। স্কুল লেভেলেই তাদেরকে দিয়ে ছাত্ররাজনীতি করিয়ে পড়াশোনার চেয়ে বেশি হ্যাডম শেখাচ্ছি।
পড়াশোনা ছাড়া কোন খেলা, ক্রিয়েটিভ কাজে আমাদের দেশে কোন স্পেস নেই অথচ সেই পড়াশোনা দিয়েও দিনশেষে কোন চাকরি হচ্ছে না।
আমরা স্কিলড হচ্ছি না। না খেলায়, না পড়াশোনায়, না মানুষ হওয়ায়। আমাদের স্কিলড বানানো হচ্ছে না। ইচ্ছে করেই সিস্টেমটাকে এমন করে রাখা হচ্ছে।
আমাদেরকে পড়ানো হচ্ছে বড়জোর কেরানি হওয়ার জন্য। আমাদের হাতে হাতুড়ি তুলে দিয়ে কাউকে পেটাতে পাঠানো হচ্ছে কিছু নির্দিষ্ট মানুষের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য।
আমরা পড়ব। কিন্তু কাজের পড়া পড়ব না। সেইসব পড়াশোনার স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে আমাদের দেশি কোম্পানিও আমরা চালাতে পারবো না। পাশের দেশ থেকে লাখ লাখ ছেলেপেলেরা এসে সব পোস্ট দখল করে নেবে।
একটু এগিয়ে যাওয়া ক্রিকেটেও সাকিবদের পর পাইপালাইনে কেউ নেই।
আমাদের কোন চেঞ্জ নেই। কোন নীতি নেই। চিরস্থায়ী ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসা নীতিনির্ধারকরা ন্যূনতম মনুষত্বও হারিয়ে ফেলেছেন। তার আর কাউকে গোনে না। আমাদের কোন কিছু হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। এমন একটা দেশে এমবাপ্পেরা কখনো তৈরি হবে না, কোন মড্রিচ তৈরি হবে না।
এই দেশে গোল্ড মেডেল জেতা জাওয়াদের চেয়ে হাতুড়ি মারা সেই নেতার দাম বেশি।
কশেরুকা ভাঙার পরও নেইমার আবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।
আমাদের পুরো মেরুদণ্ডটাই ভাঙা।
আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না,
আমাদের সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয়া হয় না!