০১ মে ২০১২, বুধবার, ১১:০৮:২৬ অপরাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি এমপি ও কর্মকর্তার বাড়ি ক্রয়ে তোলপাড়
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০১-২০২৩
যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি এমপি ও কর্মকর্তার বাড়ি ক্রয়ে তোলপাড় মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান মিয়া গোলাপের বাড়ি


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ঘটনা ও দুবাইয়ে অবৈধ অর্থে বাড়ি ক্রয় নিয়ে বাংলাদেশ ও বিদেশে বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যাপক অলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমনিতেই দীর্ঘদিন কানাডার বেগমপাড়া ব্যাপক আলোচিত। বাংলাদেশের অনেক আমলা, ব্যাবসায়ী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বেগমদের জন্য বাড়ি ক্রয় করে নিরাপদে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়ে ওইসব ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশে তাদের কর্মকান্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে তোলপাড়ের ঘটনা নতুন কিছু না। কিন্তু এর সঙ্গে এবার যুক্ত হতে যাচ্ছে আমেরিকা ও দুবাই। ক্রমশ বেড়িয়ে আসছে আমেরিকা ও দুবাইয়ে বাড়ি ক্রয়ে করা ব্যক্তিবর্গের তালিকা। 

তবে নিজের বৈধ অর্থে এসব বাড়ি ক্রয়ে সমালোচনা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যেসব চিত্র ফুটে উঠছে ক্রয় সংক্রান্ত তথ্যাবলীতে- তাতে এসব সম্পদ সম্পূর্ণ অবৈধ অর্থে ক্রয় ভিন্ন কৌশলে। সমস্যা সেখানেই। কারণ দেশ থেকে গত এক যুগে বহু অর্থ পাচার হয়ে গেছে বলে প্রায়ই রিপোর্ট আসছে। সেগুলো কোথায় কোথায় যেতে পারে সেটা আন্দাজ করা হলেও এসব বাড়ি/ফ্লাট ক্রয়ের ঘটনায় এখন অবৈধ অর্থ পাচার হওয়া স্থানের ঠিকানা উঠে আসছে।  

তবে দেখার বিষয় হলো এসব চিত্র হঠাৎ করেই কেন যেন ভেসে উঠছে। এবং যা আসছে বিদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা ও অনুসন্ধানী রিপোর্টে। কেন এসময়ে এসব চিত্র উঠছে সেটাও একটা প্রশ্ন। 

ওয়াসার সাবেক এমডি তাসকিম এ খান 

ওয়াসায় টানা ১৩ বছর এমডির পদে থেকে নানা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন ওয়াসার সাবেক এমডি তাসকিম এ খান। খুঁটির জোড় কোথায় এর উৎস খুঁজেছেন অনেকেই। বহু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, অফিসে অনুপস্থিত, বিদেশে অবস্থান করে অফিস পরিচালনা করেন এমন অনেক সমালোচনা তার বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই আলোচনায় ছিলেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। টানা ১৩ বছর এমডি, মাসিক ৬ লক্ষাধিক টাকার বেশি বেতন, বড় বড় প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সেই তাসকিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বিলাসবহুল বাড়ির সন্ধান মিলেছে তার। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক শহরে কেনা এসব বাড়ির মূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি হবে বলে অনেকে ধারণা দিয়েছেন। দেশ থেকে টাকা পাচার করে তিনি এসব বাড়ি কিনেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিপুল পরিমাণ পাচার করা টাকায় বাড়ি কেনায় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তালিকায় সন্দেহভাজন হিসেবে তাকসিমের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকেও। এ নিয়ে ঢাকার একটি পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড়। তাসকিমও জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কোনো বাড়িই তার নয়। তিনি নিজে একজন সৎ মানুষ এ দাবিও তার। 

জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে তাকসিমের বিলাসবহুল ১৪ বাড়ির সন্ধান নিয়ে সর্বত্র তোলপাড় হওয়ার পর তাকসিমের সম্পদের সন্ধানের তথ্য জানতে চাইবে দুদকও। তাকসিম সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) ’গভর্নমেন্ট ওয়াচ নোটিশ’-এর একটি কপি অভিযোগের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

সিআইএসহ যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস (ডিওজে), ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), দেশটির অন্যান্য সংস্থা ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল) তাকসিম এ খানের বিষয়ে কাজ করছে বলে ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ির বিষয়ে সম্প্রতি দুদকে অভিযোগ জমা দেয়া দুই ব্যক্তির একজন হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি মো. সোহেল রানা।

তিনি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের প্রতি অনুরোধ জানান। দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, বিদেশি ঋণে করা ওয়াসার বড় বড় প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তা হুন্ডিসহ বিভিন্ন উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন তাকসিম। পাচারের অর্থে দেশটির লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরের অভিজাত এলাকায় নগদ ডলারে ১৪টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, তাকসিম যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিক। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে যোগ দেন। তাঁর পরিবারের সব সদস্য যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তাকসিমও প্রতিবছরে প্রায় তিন মাস যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করেন। এক সময়ের ভাড়াটিয়া তাকসিম লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো অভিজাত শহরে বিলাসবহুল বাড়ি কেনেন। এ খবর ওই শহরের বাঙালিপাড়ার মানুষের মুখে মুখে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তাকসিমের বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদ থাকলেও দেশে তাঁর কোনো সম্পত্তি নেই। গুলশান-২ এর ৫৫ নম্বর সড়কে সরকারি বাসভবনে তিনি থাকেন না। জানা গেছে তিনি থাকেন নয়াপল্টনে, শ্বশুরবাড়িতে।

সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) 

অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) তাদের ওয়েস সাইটে দেয়া তথ্যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের (মাদারীপুর) সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন বলে তথ্যের উপস্থাপনা করা হয়েছে। যে সম্পদের বিবরণি তার নির্বাচনী হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেননি। এই তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি তাদের ওয়েবসাইটে করা একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তথা গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। তিনি দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন।

ওয়েব সাইটের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি সুউচ্চ ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)। 

ওসিসিআরপির করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পাঁচটি কনডোমিনিয়াম কিনেছিলেন আবদুস সোবহান। সে সময় ওই সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ২৪ লাখ ডলার। এ ছাড়া আশপাশের ভবনগুলোতে ৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার মূল্যের তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন তিনি। নিউইয়র্কে কেনা এসব সম্পত্তির নথিপত্র বলছে, সম্পত্তিগুলো নগদ অর্থে কেনা হয়েছিল। এগুলোর মালিকানায় রয়েছেন তাঁর স্ত্রী গুলশান আরাও।

ওসিসিআরপির করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আবদুস সোবহান নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আরও একটি সম্পত্তি (বাড়ি) কিনেছিলেন। ওই সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ১২ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন। এর সাত মাস আগে বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

দুবাইয়ে বাড়ী ফ্লাট ক্রয়ে বাংলাদেশীদের ঢল 

শুধু বাংলাদেশীদের জন্য নয়। বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই দুবাইয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও থাকার জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা লোভনীয়। দুবাইও কতৃপক্ষও চমকপ্রদ সব অফার দিয়ে চলছে। এতে দেশটির আর্থিক অবস্থাও সমৃদ্ধি হয়েছে। তবে ওই দেশটিতে বাংলাদেশীদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ ক্রয় দৃষ্টিগোচর হয়েছে।  

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশী। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুবাইয়ে বসবাসকারীসহ বিভিন্ন সূত্রের অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো তথ্য অনুযায়ী, ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির পরিসংখ্যানটি করা হয়েছে সি৪এডিএসের ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে। এরপর গত দুই বছরে দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের প্রপার্টি ক্রয়ের প্রবণতা আরো ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছে বাংলাদেশীরা, যার তথ্য তারা দেশে পুরোপুরি গোপন করে গেছেন। ঢাকার একটি গণমাধ্যমে রিপোর্টে প্রকাশ যে, বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের গোপনে কেনা প্রপার্টির অর্থমূল্য এখন কম করে হলেও ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। 

ওই সুত্র আরো জানায়, বৈশ্বিক অর্থনীতির কভিডকালীন বিপত্তির মধ্যেও দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশী প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশীরা ছিল শীর্ষে। স্থানীয় ভূমি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কভিডকালে দুবাইয়ে বাংলাদেশী ধনীরাই প্রপার্টি কিনেছেন সবচেয়ে বেশি। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর বাসিন্দাদের পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশীরা। 

জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশের বিত্তশালীদের কাছে দুবাই ছিল পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে। সেখানে সম্প্রতিককালে ওই আকর্ষণ থেকে রূপ নিয়েছে বিনিয়োগ হিসেবে। 

সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে বাংলাদেশীদের যারা ওই সম্পদ ক্রয় করেছেন তারা মোটেও বৈধপথে অর্থ নিয়ে গিয়ে করেননি। অবৈধ অর্থেই সেটির বেশিরভাগ হয়েছে। একইভাবে মালয়েশিয়াতেও সেকেন্ড হোম প্রজেক্টে বহু বাংলাদেশী কোটি কোটি ডলারের মাধ্যমে নাগরিকত্ব ও বিভিন্ন প্রপার্টির মালিক হয়েছেন। বহুদিন আগ থেকে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম নিয়েও আলোচিত হয়েছে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, ভারতেও অনেকে প্রপার্টি ক্রয় করেছেন বিভিন্নভাবে অর্থ পাচার করে নিয়ে যেয়ে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রেও সরকার দলীয় মন্ত্রী, এমপি, আমলা, আইন- শৃঙ্খলা বাহিনী এবং ব্যবসায়ীদের বাড়ি রয়েছে। সেই সব তথ্যও আগামীতে আসতে পারে।

শেয়ার করুন