২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৩:০৩:১১ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


নেপথ্যে লবিংয়ে ক্ষমতাসীন দল
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বিদেশীদের চাপ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৩-২০২৩
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বিদেশীদের চাপ


আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি’র ওপর দেশী-বিদেশী চাপ বাড়ানো হয়েছে। বিএনপি যেনো আওয়ামী লীগের সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয় সে ব্যাপারে এই চাপ দেয়া হচ্ছে। বিএনপি’র প্রভাবশালি সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বিএনপি’র যেনো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় সে ব্যাপারে এবার আর্ন্তজাতিক অঙ্গন হঠ্যাৎ করে অতিমাত্রায় তৎপর হয়েছে। এমনকি এধরনের চাপও দেয়া হচ্ছে যেনো বিএনপি এই সরকারের অধীনেই অংশ নেয়, ইতিবাচক থাকে। 

কিভাবে এই চাপ আসছে? 

এতোদিন বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে দিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ দেয়ার কথা শোনা গিয়েছিল। দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে যেনো সব বিরোধী দল অংশ নেয় সেভাবেই আর্ন্তজাতিক অঙ্গন থেকে চাপ আসছিল। এমনকি বলা হয়েছিল বাংলাদেশে ২০২১ সালের শেষের দিকে র‌্যাবের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেয় হয়, যা ছিল দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে এধরনের প্রথম চাপ শুরুর প্রক্রিয়া। মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অর্থ দফতরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ খবর প্রকাশ করা হয় ২০২১ সালের শেষের দিকে। এতে বলা হয়, গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত থাকার জন্য আজ বেনজির আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর- যার ফলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য হবেন। এনিয়ে ক্ষমতাসীরা অনেক উদ্বিগ্ন হয় পড়ে। এবং বেশ দেন দরবার করে এমন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে। এমনকি শোনা যায়, যে তারা এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে লবিস্টও নিয়োগ দেয়। এধরনের তৎপরতার মধ্যেই বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেছিলেন, র‌্যাবের উপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হলে মানবাধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এরপর দেশে বেশ কয়েকজন মার্কিন কুটনীতিকও বাংলাদেশে যায়। তাদেরকেও র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করা হয় দেশের একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে। কিন্তু এসব মার্কিন কুটনিতিকরা কেউই র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে শক্ত কমিটমেন্ট সরকারকে দিতে পারেনি।

আওয়ামী লীগের টনক নড়া ও পদক্ষেপ

এদিকে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার এমন পরিস্থিতিতে দেশের অন্যতম বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি বলা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনে একের পর এক কর্মসূচি দিতে থাকে। বিএনপি ধরে নেয় যে সরকার এখন আর আগের মতো তাদের সভা সমাবেশ বন্ধ বা বাধা দিতে পারবে না। ফলে বিএনপি এধরনের পরিস্থিতি তাদের দল ও আন্দোলনের মাঠ গুছিয়ে ফেলে। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সব কটি বিরোধী দলকেই তারা তাদের দাবি ও কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। যা আওয়ামী লীগের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী রাজনৈতিক মাঠে বলা যায় এধরনের একা পড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে তাদের দলকে মাঠে নামাতে। রাজনৈতিকভাবে মাঠে মোকাবেলা করতে বিএনপি’র বিপরীতে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে এখন দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকি আওয়ামী লীগ তাদের মাঠকে শক্তভাবে ধরে রাখতে প্রতিটি জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে একযোগে তাদে ভাষায় ‘বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য ও সহিংসতার প্রতিবাদে’ শান্তি সমাবেশ করবে বলে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। আওয়ামী লীগ এজন্য দেশের ৪০ জেলায় ৫৩ কেন্দ্রীয় নেতাকে পাঠায়। এরপর থেকে থেকে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট বা সমমনাদের যেকোনো কর্মসূচির বিপরীতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একের পর এক কর্মসূচি দিয়েই যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লবিং

এদিকে এতো কিছুর পরও আওয়ামী লীগ চুপ করে বসে নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দলটি তাদের ইমেজ ধরে রাখতে নানান ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। একাজটি সুচারুভাবে কাজ করতে তারা একটি শক্ত প্রতিবেশি দেশকে কাজে লাগিয়েছে। বিশেষ করে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ছাড়া মার্কিনীদের সাথে সর্ম্পক জোরদারে এই প্রতিবেশিকে ব্যবহার করে। এই প্রতিবেশির সহযোগিতায় বলা যায় বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকার কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বলা যায় শক্ত অবস্থানে চলে আসে। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বেশ কয়েকটি বক্তব্য ছিল খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন একবার বলেছেন, র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনাবাসী ভারতীয়রাও (নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান-এনআরআই) মার্কিন সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছে বলে দাবি করা হয়। এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ঘটনা চমকে দেয় সব্বাইকে তা ছিল ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় খাতরার মন্তব্য। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তার দেশের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তিনি এটা এমন সময়ে বলেছিলেন যখন বাংলাদেশে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডরেকে শোলে সফরে আসেন। আর এই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলের ডরেকে শোলের সফরের পর থেকে শোনা যাচ্ছে র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন বাহিনীর মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে সরকারের ইমেজ উদ্ধারে শক্ত লবি কাজ করছে। আর এমন পরিস্থিতি আরো ফুটে উঠেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের আরেক বক্তব্যে। তিনি জি-২০ সম্মেলনে ভারতের আমন্ত্রণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, নয়াদিল্লি বাংলাদেশকে সম্মান দিয়েছে বলেই বাকি দেশগুলোও সম্মান দেখিয়েছে। এটি ভারতের বন্ধুত্বের বড় নিদর্শন। ভারতের আমন্ত্রণ আমাদের জন্য বড় পাওয়া। ফলে ধরে নেয়া যায় শক্ত প্রতিবেশি দেশটির সহযোগিতায় সরকার তাদের আন্তর্জার্তিক অঙ্গনকে বেশ শক্তিশালি করেছে। এমনকি শোনা যাচ্ছে এই শক্ত লবিং-এর জোরেই ক্ষমতাসীন সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যে, বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায় না। ভিন্ন পথে ক্ষমতায় যেতে চায়। সম্প্রতি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমনই বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। বিদেশীদের কাছে অভিযোগ করা হচ্ছে এই বলে যে, বিএনপি সব সময় অসংবিধানিক পথে ক্ষমতায় যেতে চায়। বিদেশীদের বোঝানো হচ্ছে যে বিএনপি সংবিধান মানে না। তারা সংবিধানে বাদ দিয়ে ক্ষমতা চায়। বলা হচ্ছে বিএনপি’ একটি সাম্প্রদায়িক দল। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল চায় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমন বক্তব্যে বেশ কয়েকটি দেশ সত্য বলেই গিলেছে। এমন প্রমাণ মিলেছে গত রোববার বিএনপি’র সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেড় ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। দলটির তাদের আগের অবস্থান তুলে ধরেন। কিন্তু তারপরেও বিএনপি যেনো নির্বাচনে অংশ নেয় এমন আহবানও জানানো হয় তাদের পক্ষ থেকে। বলা হয় নির্বাচনে না অংশ নিলে কিভাবে বোঝা যাবে পরিবেশ পরিস্থিতির? এমন জবাবে অবশ্য বিএনপি জানিয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতমূলক নির্বাচনে অংশ নিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বৈধতা পাবে বলে জানিয়েছে দলটি। এমন বক্তব্যের পর অবশ্য বৈঠকে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে হবে না বলে জানিয়েছে ইইউ। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে সংস্থাটি। এর পাশাপাশি বিএনপিকে এ বার্তা দিয়ে ইইউ বলেছে, নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চায় তারা। তবে বিএনপি সাফ জানিয়ে দেয় যে তারা আওয়ামী লীগের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচনে যাবে না। তবে বিএনপি’র একজন নেতা এই প্রতিবেদককে জানান যে এবারে কূটনীতিকরা বিএনপি’কে নির্বাচনে যেতে প্রচ্ছন্ন চাপ দিয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে জানিয়েছেন সফররত যুক্তরাজ্যের ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এফসিডিও) প্রতিমন্ত্রী (ইন্দো-প্যাসিফিক) অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়াকে গণভবনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে। বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তিনি সন্তুষ্ট। 

শেষ কথা..

বিএনপি’কে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে দেশের ভেতরে বিভিন্নভাবে কাজ করে ক্ষমতাসীনরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের প্রস্তাব দিয়ে বিএনপি’কে এবার ক্ষমতাসীনদের অধীনেই শেষ বারের মতো নির্বাচনে অংশ নিতে দেন-দরবার-তদবির করেছে। দেন-দরবারে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতাসীনরা এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের লবি ব্যবহার করছে। তবে এই ব্যাপারে একটি প্রতিবেশী দেশ শক্ত ভূমিকা রাখায় ক্ষমতাসীনরা এর সুফলের ব্যপারে বেশ ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করে ক্ষমতাসীনদের লবিং, দেন-দরবার কতটা সফল হবে তা দেখতে আরো কিছু সময় লাগবে।

শেয়ার করুন