২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৮:৪৭:৫৫ পূর্বাহ্ন


লুটেরাদের এখন লুন্ঠনের স্বর্গরাজ্য
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৪-২০২২
লুটেরাদের এখন লুন্ঠনের স্বর্গরাজ্য গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি


দেশ’কে জোনায়েদ সাকি 

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছন, নাগরিকদের ন্যূনতম মর্যাদার প্রতীক ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র-সরকার-দল সব একাকার হয়ে এই ব্যক্তিকেন্দ্রীক ক্ষমতার অধীনস্ত হয়েছে। রাষ্ট্র থেকে রাজনীতি নির্বাসিত হয়ে তা অধীনস্ত হয়েছে এক আমলাতন্ত্রিক কর্তৃত্বের। গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, হয়রানি, জেল-জুলুমের মাধ্যমে বিরোধিতাকে দমন করা    হচ্ছে। মানুষের জান-জবানের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে মানুষ সমালোচনা করতেও এখন ভয় পায়। নজরদারি এমন চূড়ান্ত আকার নিয়েছে যে প্রত্যেক নাগরিকই আজ ভীত সন্ত্রস্ত। আর গোটা জনগণকে এরকম পরিস্থিতে রেখে গুটিকতক লুটেরাদের জন্য তৈরি দেশকে করা হয়েছে লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্য।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা তুরে ধরতে গিয়ে জোনায়েদ সাকি এসব কথা বলেন।  সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ, জোনায়েদ সাকির  সাক্ষাৎকার নেন গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। 

জোনায়েদ সাকি বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন ও ২০১৮ সালে আগের রাতেই এক নজিরবিহীন ভোটডাকাতির মাধ্যমে এক ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে তাদের নাগরিকত্বের মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে এই সরকার। এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে গিলে খেয়ে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করেছে। 

কেনো দেশ কি এগুচ্ছে? সরকারের এত উন্নয়ন কি চোখে পড়ছে কী না?

এমন প্রশ্নের উত্তরে জোনায়েদ সাকি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন ও উন্নয়নের প্রভাবে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে নির্বিচারে, ব্যাংক লোপাট হচ্ছে, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি এবং চাল-ডাল ভোজ্যতেলসহ নিত্য পণ্যের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। একদিকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে অন্যদিকে নতুন নতুন কোটিপতি তৈরি হচ্ছে।

সারা দেশের প্রাত্যহিক বাস্তবতা এখন দিনে-দুপুরে যেখানে-সেখানে মানুষ খুন হয়ে যায়, নারীরা ধর্ষিত হয়, লাঞ্ছিত হয় ঘরে-বাইরে, কিন্তু পুলিশ অপরাধীদের খুঁজে পায় না। শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম, শিক্ষার মানের দিক বিবেচনা করলে যা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কোভিড ১৯ সংক্রমণ শুরু হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম, নৈরাজ্য, লুটপাটের দৌরাত্ম জনসম্মুখে নগ্নভাবে উন্মুক্ত হয়। সব মিলিয়ে এই দেশটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার পুরো কাঠামোটাই আজ ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেও ক্রমাগত দুর্বল করছে। 

বাংলাদেশ তো এখন আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে উন্নয়নের একটি রোল মডেল বলে প্রচারিত হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে? 

মোটেই না ভোটারবিহীন জবর-দখলকারী ফ্যাসিবাদী সরকার তার সমস্ত রকম রাজনৈতিক দুর্বলতা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। এর প্রভাবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেশের সম্মান কমছে, গুরুত্ব নষ্ট হচ্ছে।  নিজস্ব মর্যাদায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়তে পারার সক্ষমতা দিনে দিনে হারাচ্ছে। ফলে সার্বোভৌম ক্ষমতার পরিধি সঙ্কুচিত হচ্ছে। অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ ঊর্ধ্বে তুলে ধরার বদলে তা গোষ্ঠীগত আনুকূল্য লাভের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র না থাকায় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জনসম্মতিহীন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থই এই সম্পর্ক নির্মাণের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আর্ন্তজাতিক পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বলতর হচ্ছে অন্যদিকে পরিবর্তীত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে ভূমিকা পালনের সক্ষমতা হারাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, এই সরকার তার জনসম্মতিহীন অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড, গুম, হামলা-মামলাসহ ভীতির রাজ্য তৈরি করে যেভাবে জনগণ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন করছে তারই ফলশ্রুতিতে আজ আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইন শৃক্সক্ষলা বাহিনীর সদস্যরা। এর পরিণতিতে বর্তমান বিশয়িত বাস্তবতায়, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকসহ সমগ্র অর্থনীতি একটা বড় হুমকির মুখে পড়বে। যা বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে নিস্পেষিত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবে অর্থনৈতিক নিস্পেষনের নতুন মাত্রা। এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় দরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার কায়েম করা। গুম-খুনসহ সকল অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু সরকার সেই পথে হাঁটছে না, বরং বিষয়গুলোকে ধামাচাপা দিতে লবিস্ট নিয়োগের পথে যাচ্ছে। যাতে করে তাদের বর্তমান পরিস্থিতিকেই বহাল রাখার আর কিছু প্রলেপ দিয়ে বাস্তবতাকে ঢেকে রাখার আকাক্সক্ষাই স্পষ্ট হয়। 

নির্বাচন কমিশন নিয়ে আইনের ব্যপারে আপনাদের দলের বক্তব্য তি?

গণসংহতি আন্দোলন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, বর্তমানে আর্ন্তজাতিক চাপ থাকায় সবকিছু আইনী প্রক্রিয়ায় হচ্ছে এরকম একটা ধারণা দেবার জন্য তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশন আইন করে তাদের চলমান তৎপরতাকে বৈধতা দানের চেষ্টা চলছে। অথচ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা স্পষ্টতই বলে এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির এমন কোন বিকাশ ঘটেনি যে একটা দলীয় সরকারের অধীনে কোন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। অতীতের মতোই এই সরকারের অধীনেও গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন তার প্রমাণ। এই সরকার এমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী যে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন তৈরিতে যে আইনই বানানো হোক তা থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর হতে বাধ্য। যে সংসদ নিজেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় তা আইন করে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেবে এটা নিতান্তই কষ্টকল্পনা। সরকার আগামী নির্বাচনও তার ২০১৪, ২০১৮ নির্বাচনের ছকেই করতে চায়। কাজেই এই সরকারের পদত্যাগের মাধ্যমে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে গঠিত একটি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনেই কেবল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সক্ষম নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে পারে।

দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে আশু করণীয় নিয়ে দেশবাসীর কাছে আপনাদের পরামর্শ কি?

জোনায়েদ সাকি বলেন, বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের একটি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এই সরকারের কাজ হবে:। রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, একটি সুষ্ঠ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি এবং ইভিএম ব্যবস্থা বাতিল করে স্বচ্ছ ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর অর্থ্যাৎ জবাবদিহিতাপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরি করা যাতে পরবর্তী গ্রহণযোগ্য সংসদে এই সংস্কার সম্পন্ন করা যায়।

আর আগামী ৩টি জাতীয় নির্বাচন এইরকম অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরি যাতে করে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আস্থা থাকে এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার প্রয়োজনীয় সময় মেলে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো প্রশ্নে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমের সাবেকী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মডেল বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

আর এজন্য যেসব ন্যূনতম সংস্কার একটা কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় জরুরি। তা হলো মমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ হতে হবে সাংবিধানিক কমিশনের মাধ্যমে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গঠিত সংসদের সরকারীদল, বিরোধীদল ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের দ্বারা এই কমিশন গঠিত হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে দিতে হবে। সরকার ও দলের ক্ষমতাকে পৃথকীকরণ আইনী নির্দেশনা। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট বিধান প্রণয়ন। পরপর দুই বারের বেশি কেউ সরকার/রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না। সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন ও প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার।

সমস্ত গণবিরোধী, নাগরিক অধিকার খর্বকারী, উপনিবেশিক আইন বাতিল করে একটা গণতান্ত্রিক উপযোগী আইনকানুন ও আইনী কাঠামো তৈরি। আইন বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহীতা নিশ্চিতের জন্য আইন প্রণয়ন। দেশের সমস্ত অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনী বিধান। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আইনী সুরক্ষা। এরকম একটি রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনেই আমরা পারি জনগণের জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটাতে। 


শেয়ার করুন