০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ০৫:৫৫:৪৯ অপরাহ্ন


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিতর্ক চরমে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৪-২০২৩
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিতর্ক চরমে


বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে হঠাৎই তোলপাড়। দেশ ও বিদেশে এ নিয়ে  চলছে তুমুল বিতর্ক। এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা জানিয়েছন জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কঠোর সমালোচনা করেছে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের এ আইন নিয়ে সমালোচনা করেছে।    

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন দিয়ে সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে। সবারই অভিব্যক্তি এমন যে এ আইন দ্বারা স্বাধীনমত প্রকাশের বাধা তৈরি করা হয়েছে। ফলে এ আইন প্রত্যাহার ও সংশোধনের প্রস্তাবনা ও আহ্বান জানানো হয়েছে।  

ঘটনার সূত্রপাত মহান স্বাধীনতা দিবসের এক ঘটনায় প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে গ্রেফতার ও জেলহাজতে প্রেরণ। প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে একই আইনে মামলা। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মানবাধিকার কর্মীকে ভয়ভীতি দেখানো, আরো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা।  

সরকারও এ ব্যাপারে ভাবতে শুরু করেছে। যা ইতিমধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। হয়তো কিছুটা পরিমার্জন,পরিবর্তন আসলে আসতেও পারে। তবে এ আইনে রাজনৈতিক হয়রানিও রয়েছে বলে উল্লেখ করছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার 

বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক। ওই ঘটনার পরপর দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন। ভলকার টুর্ক বলেছেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশ জুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি পুনরায় কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিলম্বে এর প্রয়োগ স্থগিত এবং এই আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর ধারাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’ 

এই সংশোধনী আনতে সহযোগিতার লক্ষ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে বাংলাদেশকে ইতিমধ্যে বিস্তারিত পরামর্শ পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভলকার টুর্ক। তাঁর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এই আইনে দুই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। সর্বশেষ ২৯ মার্চ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সংবাদপত্র প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান এর শিকার হয়েছেন। বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাঁকে আটক করা হয়েছে। সঙ্গে তাঁর ল্যাপটপ, ফোন ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করে নেওয়া হয়েছে। তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আরেকটি মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং একজন আলোকচিত্রী সাংবাদিককেও আসামি করা হয়েছে। এই মামলা করা হয়েছে বাংলাদেশে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সৃষ্ট সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।

গত ফেব্রুয়ারিতে পরিতোষ সরকার নামের এক তরুণকে এই আইনের আওতায় পাঁচ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, একটি ফেসবুক পোস্টে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন তিনি। ভলকার টুর্ক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে তাঁর দপ্তর থেকে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ জানানো হচ্ছে। এসব ধারা অস্পষ্ট এবং বিস্তৃত পরিসরে সেগুলোর প্রয়োগ করা যায়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার এই আইনের যথেচ্ছ ও মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ বন্ধে সুরক্ষাকবচ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু যখন গ্রেপ্তার করা অব্যাহত রয়েছে, তখন তাদের এই প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। খোদ এই আইনেরই যথাযথ সংস্কার দরকার।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন মতপ্রকাশের অধিকারের ভয়ানক লঙ্ঘন আখ্যায়িত করেছে সংস্থাটি। ঘটনার পরপর দেয়া এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলে, গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত একটি সংবাদ লেখার জন্য শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনটি ছিল জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে। গত ২৯ মার্চ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একদল সদস্য সাদাপোশাকে বাড়িতে গিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে আসে। এরপর প্রায় ১০ ঘণ্টা তাঁর অবস্থান জানা যাচ্ছিল না। শামসুজ্জামান ছাড়াও একজন আলোকচিত্রীসহ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলেছে, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ভিন্নমত প্রকাশকারী ব্যক্তিদের দমন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে এটা ব্যবহার করছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারকর্মীদের পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়াররা বলছেন, শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে যেসব ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলোর মধ্য দিয়ে বিস্তৃত পরিসরের বক্তব্যকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়। তাঁরা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশ সরকারকে ব্যক্তিকে তাঁর ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের জন্য অন্যায্যভাবে শাস্তি দেওয়ার বড় সুযোগ করে দিয়েছে।

অ্যামনেস্টি বলেছে, বাংলাদেশে নাগরিকেরা নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে গুম, স্বেচ্ছাচারী আটক ও নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সরকারের সমালোচনার জন্যই তা হয়ে থাকে। 

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও এখানে সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজের জন্য শাস্তির মুখে পড়ছেন। এই প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সংগতি রেখে সংশোধন এবং এই আইনের আওতায় আটক অপর ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। 

বিএনপির দাবি

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘সত্যকে প্রকাশ করবার অপরাধে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এই সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে জনমত যাতে প্রকাশিত না হয় এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দমন করবার জন্যে তারা গত ১৪ বছর ধরে একই কায়দায় সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করছে, হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে, গ্রেফতার করেছে, মিথ্যা মামলা দিয়েছে। বিশেষ করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে ব্যবহারকে সংবাদপত্রের যে স্বাধীনতা, সংবাদ মাধ্যমের যে স্বাধীনতা তাকে তারা পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।” তিনি বলেন, ‘‘এই কালো আইন বাতিলের ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি। আপনারা জানেন, এই অ্যাক্টে সরকারের নির্যাতনের কারণে কয়েকজন সম্পাদক দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের বহু সাংবাদিক তারা নির্যাতিত হয়েছেন, তারা নিহত হয়েছেন, তারা গ্রেফতার হয়েছেন এই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলার কারণে।”

আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহাররোধে প্রয়োজন হলে তা সংশোধনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োজন রয়েছে। এই আইন কোনোমতেই বাতিল করা যায় না। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তিন দিন আগের ঘটনায় (প্রথম আলোর সাংবাদিক) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ভাবনার বিষয়ে নতুন করে বলার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এ বিষয়ে আমি আগেও যা বলেছি, এখনো তা বলছি। এটার কিছু অপব্যবহার হয়েছিল, সেটা স্বীকার করে এটার কী পরিবর্তন আনা যায়, সে জন্য আমরা প্রথমত জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সাথে আলোচনা করেছি। এখনো সে আলোচনা চলছে। সেখান থেকে একটা কারিগরি নোট এসেছে। সেটা আমরা পর্যালোচনা (এক্সামিন) করছি, খুঁটিয়ে দেখছি। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকদের অহেতুক যাতে হয়রানি করা না হয়, সে জন্য একটা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, গত ১৪ মার্চ ২০২০ সালে সুধী সমাজের সঙ্গে এ আইন নিয়ে আলোচনায় বসেছিলাম। সেখানে তাদের বক্তব্য শুনেছি। পরে আমি তাদের বলেছিলাম যে আমার কিছু বক্তব্য আছে। সেগুলো শোনার কথা ছিল ৩০ মার্চ। কিন্তু এর আগের দিন তা স্থগিত করা হয়েছে।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এই আলোচনা হয়তো এপ্রিল মাসের মধ্যসময়ে হবে এবং সে সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ডেটা প্রটেকশন আইন (উপাত্ত সুরক্ষা আইন) এবং এনজিওদের ভলান্টিয়ারি ফান্ড নিয়ে কথা হবে।’ আনিসুল হক বলেন, ‘এই সব আলোচনার শেষে আমরা যদি দেখি, এই যে আমি অপব্যবহারের কথা বললাম, এগুলো রোধে যদি কোনো বিধি দ্বারা সম্ভব হয়, সেগুলো আমরা করব। অথবা আইনের সংশোধন যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে সংশোধনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের মেনে নিতে হবে বা এটা বাস্তবসম্মত যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন আছে। পৃথিবীতে অনেক দেশেই এ ধরনের আইন আছে।’

দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাসহ বিশিষ্টজনের প্রতিবাদ 

এছাড়াও দেশ বিদেশের পত্র পত্রিকায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কঠোর সমালোচনা ও প্রথম আলোর সাংবাদিকের মুক্তির দাবি ও সরকারের কঠোর সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশে বিশিষ্ট নাগরিকরাসহ নানা পেশার লোকজন প্রতিবাদ ও বিবৃতি দিয়ে এ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বাতিলের দাবি করে আসছে। 

শেয়ার করুন