২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ১১:১২:২৯ পূর্বাহ্ন


মুখোমুখি অবস্থানে দেশের রাজনীতি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৫-২০২৩
মুখোমুখি অবস্থানে দেশের রাজনীতি


বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমেই মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকে তা কেউ আচও করতে পারছে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল যে সামনের দিনে কি কি করতে পারে তার কিছু আভাস মিলছে। আর এতে রাজনৈতিক সঙ্কট যে আরো গভীরে চলে যাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।  মাঠের বিরোধী দলসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলি একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে।


এর আগে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছিল। বিএনপি মুখে কিছু না বললেও তাদের আন্দোলন যে অহিংস পথেই ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এর আগে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপি’র বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়। দেশে- বিদেশে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে বিএনপি অগ্নি সন্ত্রাস করে ক্ষমতায় যেতে চায়। এসব কারণে দেশে- বিদেশে বিএনপি’র বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উঠে।


অন্যদিকে বিএনপি’র বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামী দলের গভীর সম্পর্ক নিয়েও দেশে বিদেশে অনেক দুর্নাম রটে। এই জামায়াতের কারণেই প্রতিবেশী একটি দেশ বিএনপি’র সাথে সব ধরনের দুরুত্ব বজায় রাখে। আর বিএনপি’র ইমেজের ক্ষেত্রে এরই প্রভাব পড়ে বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশেরও অনেক বিরোধী দল বিএনপি’র সাথে দূরত্ব বজায় রাখে জামায়াতের সাথে সর্ম্পক থাকার কারণে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি অহিংস এবং এককভাবে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করতে থাকে। এভাবে এককভাবে আন্দোলন করে বিএনপি মূলত জানান দেয় যে তারা আর জামায়াতে ইসলামী দলের মতো স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে নিয়ে কোনো আন্দোলন করবে না। তবে প্রতিটি আন্দোলনে বিএনপি তাদের অহিংস আন্দোলন নীতি বজায় রাখে কঠোরভাবে। এর মাসুলও দিতে হয় বিএনপিকে। অনেক গ্রেফতার ও হত্যাকান্ডের শিকার হন বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। এতে দেশের বাম প্রগতিশীল উদার রাজনৈতিক দলগুলি একধরনের সহানুভুতি আস্থা তৈরি হয় বিএনপি’র ব্যাপারে।


১০ ডিসেম্বর থেকে সরকারের টনক নড়ে..

এভাবে একের পর অহিংস নীতিতেবিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে গত বছর বিএনপি একটি বড়ো কর্মসূচিতে নেমে পড়ে। তা ছিল ১০ ডিসেম্বরে রাজধানীতে মহাসমাবেশ।  এর আগে বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ করে। এসব বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপি’কে সরকার প্রথম অবস্থায় প্রশাসনিকভাবেই মোকাবেলা করতে থাকে। কারণ সরকার ভেবেছিলো বিএনপি জনগণকে তাদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে পারবে না। জনগণও বিএনপি’র ব্যাপারে নেতিবাচকই আছে। ফলে ক্ষমতাসীনরা প্রশাসনিকভাবেই বিএনপি’কে মোকাবেলা করতে থাকে। কিন্তু এনিয়ে ভেতরে বাইরে সমালোচনার ঝড় উঠে যে সরকারের রাজনৈতিকি দল কী করছে? তারা কি রাজনৈতিকভাবে বিএনপি’কে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ। নানান আলোচনা সমালোচনার পর সরকার নড়ে চড়ে বসে। তারা গত বছরের বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা সমাবেশকে বেশ গুরুত্ব সহকারে নেয়। অবশ্য এর পেছনেও কারণও ছিল। কেননা ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশকে বিএনপি নেতাদের কয়েকজন বলে বসেন, সেদিনের (১০ ডিসেম্বর) পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরবেন, এমন কথাও বলছেন তাদের কেউ কেউ। কেউ আবার বলছেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত হয়ে ঘরে থাকা খালেদা জিয়াও ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে উপস্থিত হবেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ৯০ এর গণআন্দোলনের সময়ে ডাকসুর ভিপি আমানউল্লাহ আমান গত ৮ অক্টোবর প্রথমে ১০ ডিসেম্বর সরকার পতনের কথা বলেন। এরপর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ আরও কয়েকজন নেতাও একই কথা বলেন। আর এরপর ক্ষমতাসীন সরকার শুরু করে প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া। তারা শান্তি সমাবেশের ডাক দেয় এবং এর পাশাপাশি ১০ ডিসেম্বরে মোকাবেলায় বলা যায় শক্তভাবে প্রশাসনিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। আর এরপর থেকেই শুরু হয় বলা চলে বিএনপি- আওয়ামী লীগরে মধ্যে সমাবেশ পাল্টা সমাবেশ বা পাল্টি কর্মসূচি। যেদিনই বিএনপি একটু বড়ো সমাবেশের ডাক দিচ্ছে সাথে সাথে মাঠে আওয়ামী লীগও শান্তি সমাবেশের ব্যানারে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেঁ।

বর্তমানে আরো কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত..

তবে বর্তমানে এমন অবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন পরিস্থিতি চরম উক্তেজনাকর অবস্থার দিকেই যাচ্ছে। আর এমন পরিস্থিতির আভাস মিলেছে সম্প্রতি একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। তা হচ্ছে নির্বাচন সংক্রান্ত। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অতি সম্প্রতি কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন না দিলে, সে নির্বাচন রুখে দিতে নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি অভিযোগ করেন, যেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, দেশে বিদেশে সবখানে-যে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। বিএনপির মহাসচিবর এমন বক্তব্যের পরপরই সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর কঠোর জবাব দিয়েছেন।  তিনি বিএনপির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বলছেন নির্বাচন রুখে দেবেন। আমরাও প্রস্তুত আছি। দেখে নেবো কে রুখতে আসে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজ দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা প্রস্তুত হয়ে যান। সময়ে সময়ে ডাক দেওয়া হবে।’ অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে যুবলীগ আয়োজিত সমাবেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপি আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য করলে যুবলীগ তা প্রতিহত করবে। তিনি বলেন, বিএনপির জনগণের ওপর ভরসা নেই।

হচ্ছে না সংলাপও

এদিকে দেশের রাজনীতিতে এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি’র সংলাপেরও আভাস মিলছে না। বরং সংলাপের বিরুদ্ধে উভয়েরই তীর্ষক মন্তব্য লক্ষ্যণীয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভয়েস অব আমেরিকা’য় এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করতে চান না বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা তো তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইনি। তিনি বলেন, ‘সংলাপ আমরাও চাই না, ফয়সালা হবে রাজপথে। এর আগেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ না করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কার সঙ্গে সংলাপ করবেন, সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংলাপ করেছিলেন। কিন্তু তার ফল নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।

আসলে কি হতে যাচ্ছে..

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন নির্বাচন আসতে এখনো অনেক দেরি। নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিএনপি’র জবাবে আওয়ামী লীগের এখনই দেয়া প্রতিক্রিয়া বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগ একটি মাঠের পরীক্ষিত রাজনৈতিক দল। অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষা ফলশ্রুতিতে এদের দল অনেক শক্ত আবস্থানেই আছে। মাঠে দলটি কিভাবে রাজনীতি করতে হয় তা ভালোভাবেই জানে। সেক্ষেত্রে তারা যে বিএনপি’কে খালি মাঠে ছেড়ে দেবে না তা প্রতিদিনই স্পস্ট হয়ে উঠছে। তবে সেক্ষেত্রে দেশ কোন দিকে যাবে তা হয়তো সময়ে বলে দেবে। তবে এটা ঠিক যে সম্প্রতি সরকারের একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের বক্তব্যে স্পস্ট হয়ে উঠেছে তারা মাঠে তেমন সুযোগ বিএনপি’কে আর না-ও দিতে পারে। তারা প্রশাসনিকভাবে আরো শক্ত হয়ে উঠে পারে। আর একারণে বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে তাদের রাজধানীসহ সারাদেশে গ্রেপ্তার হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন মামলায় আসামি করা হচ্ছে তাদের। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। পুরোনো মামলায় আটকের ঘটনাও  ঘটছে। গভীর রাতে কারো বাসাবাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তল্লাশির ঘটনাও ঘটছে বলে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করছে। সব মিলিয়ে বলা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন পরিস্থিতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানের দিকেই যাচ্ছে বলেই পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।

শেয়ার করুন