২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৪:৩১:৫৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


ঘুরেফিরে সেই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৮-২০২৩
ঘুরেফিরে সেই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি দুই কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক


একের পর এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ এ জোটের প্রতিনিধিরা সফর করছেন বাংলাদেশে। খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন বিভিন্ন স্তরে। বাংলাদেশে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অবতারণা ঘটবে কি না সে নিয়ে রাজ্যের উৎকণ্ঠা। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এ দুই পক্ষ যখন মুখোমুখি এদের একটি সম্ভব্য সংঘাত এড়াতে সমাধান কী। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার এক চুল পরিমাণ ছাড় দিতেও নারাজ। বিগত দুই নির্বাচনে মানুষ ভোটই দিতে পারেনি, ভোটের পরিবেশও ছিল না-এ সরকারের অধীনের নির্বাচন সেটা শুধু রেফারেন্স হিসেবে তুলে ধরে বসে আছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছে-একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সে সমঝোতার টেবিলে বসতে চান না কেউই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল বলেই দিয়েছে, সংবিধানের অধীন অর্থাৎ বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যেমনটা গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো।

সর্বশেষ দুই কংগ্রেসম্যান যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের জর্জিয়ার কংগ্রেসম্যান রিচার্ড ম্যাককোরমিক এবং হাওয়াইয়ের ডেমোক্র্যাট দলের কংগ্রেসম্যান এডওয়ার্ড কেইস এসেও বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করে গেছেন। তারা বারবার জানতে চেয়েছেন, সমঝোতার কোনো পথ আছে কি না। বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-বৈঠক করে তিন প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির সঙ্গেও এক টেবিলে বসেছিলেন তারা চা চক্রে। কিন্তু সেটার রেজাল্টও জিরো। অর্থাৎ শূন্য রেজাল্ট নিয়েই ফিরে গেছেন। যার অর্থ, অনাগত দিনে বাংলাদেশে একটি অনাকাক্সিক্ষত পলিটিক্যাল ক্রাইসিসের অবতারণা ঘটলেও ঘটতে পারে। আর সেটা হলো- বিরোধী দল রাজপথ উত্তপ্ত করবে আর ক্ষমতাসীনরা করবেন দমন, পীড়ন। 

তবু মার্কিনি ও পশ্চিমাজোটের উদ্বেগ অন্যখানে 

মার্কিনিরা যেটা ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছেন, তাদের দুশ্চিন্তা অন্যখানে। ইন্দো-প্যাসিফিক জোনকে কেন্দ্র করে যে ভূরাজনীতি, সেটাই তাদের অত্র অঞ্চলে বারবার স্মরণের মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা এ জোনে চীনের উত্থান বা প্রভাব খাটো করতে যা যা দরকার সেটাই তারা করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাজোটের একটাই উদ্দেশ্য ইন্দো-প্যাসিফিক জোন ওপেন ও ফ্রি মুভমেন্ট। 

ঢাকায় সফর করা মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা হলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনর সঙ্গে ওই বিষয়টাই উল্লেখ করে জানতে চেয়েছেন সরাসরি। বিষয়টা সাংবাদিকদের জানান দেন স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বাংলাদেশ চীনের বলয়ে চলে যাচ্ছে, এমন বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে শুনতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বৈঠকে আলোচনায় ওঠে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “চীন নিয়ে বলেছে যে, ‘তোমরা চীনের ভেতরে চলে যাচ্ছো’। মোমেন বলেন, ‘আমরা বলেছি, জি না। আমরা বলেছি, আমরা চীনের ঋণের ফাঁদেও যাচ্ছি না। চীন থেকে আমরা যে ঋণ নিয়েছি, এটা এক শতাংশ, এটা বড় কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘বলেছি যে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অবাধ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। প্রাইভাইটেজশন আমাদের দেশের যত অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, কৃষি-এগুলো সব বেসরকারি খাতে। এগুলো সরকারি সেক্টর নয়, কমান্ড সিস্টেমের মতো না।’ বাংলাদেশ চীনের ‘গোলাম’ হয়ে গেছে, এমন ধারণা কংগ্রেস সদস্যদের দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন মোমেন। তিনি বলেন, ‘তাদের কাছে বিভিন্ন লোকজন বলেছেন, এরা (বাংলাদেশ) চায়নার খপ্পড়ে পড়ে গেছে, চায়নার গোলাম হয়ে গেছে। আর এটা একটা ভয়ঙ্কর জায়গা, এখানে অশান্তি, পুলিশ সব লোককে ধরে ফেলতেছে, যখন-তখন রাস্তাঘাটে লোক মরতেছে। এই ধরনের একটা ধারণা হয়েছে। ভয় আর কী।’

প্রসঙ্গত, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছর ধরে আলোচিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ গ্রহণ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে জোট। এ সংক্রান্ত গঠিত কোয়াডে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। মূলত এটা চীন বিরোধী। আর এ ‘চীনবিরোধী’ জোট কোয়াডে বাংলাদেশকে বারবার আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা। বাংলাদেশ এস্থানে নিরপেক্ষ। বাংলাদেশের যে নীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয় সে নীতিতে এখনও। কিন্তু বাংলাদেশকে চীনের কাছ থেকে সতর্কবাণীও শুনতে হচ্ছে।  বাংলাদেশ সেই জোটে গেলে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের ‘ক্ষতি’ হবে।

এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইন্দো-প্যাসিফিক জোনে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি-আইপিএস) তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। জো বাইডেন সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওই কৌশলে পরিবর্তনও আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটাজি পথ ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপানসহ বিভিন্ন দেশ এর আগে তাদের কৌশল প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই চায় বাংলাদেশ অন্যান্য আঞ্চলিক দেশের মতো তাদের কৌশলগত জোটে শামিল হয়ে যাক। আর এ আমন্ত্রণ নতুন নয়। সেই ২০১৮ সাল থেকেই বাংলাদেশের প্রতি সাদর আমন্ত্রণ। কারণ আর কিছু নয়, ক্ষুদ্র দেশ, দরিদ্র দেশ হলেও এ অঞ্চল বাংলাদেশের কোলঘেঁষে। তাই বাংলাদেশকে তাদের দরকার। বাংলাদেশকে নিয়ে বড় একটা ভয়ও আছে। ধরা যাক, ওই জোটে বাংলাদেশ যোগ দিল না। এতে সমস্যা নেই।

কিন্তু বাংলাদেশ যদি সে ফাঁকে চীনের সঙ্গে যোগ দেয়? তাছাড়া ইদানীং বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়নের পেছনে চীনের বড় বড় ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে। বলা যেতে পারে চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছে ঋণের ফাঁদে। অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা মন্দা ভাব যখন বাংলাদেশের তখন ঋণের কিস্তি গুণতেও গলদঘর্ম হওয়ার কথা। বাংলাদেশের টেনশন সেখানেও। আজ যারা কোয়াডে ডাকছেন, তারা তো বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নতিতে ঋণ বা সহায়তা নিয়ে আসেনি। উল্টা পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপারে অ্যালার্জিও ছিল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থেই চীনের ঋণের দিকে ঝুঁকেছিল। আর এতেই এখন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে টানতে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানসহ বিভিন্ন দেশের প্রচেষ্টা বা তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। 

এদিকে চারদিক থেকে এমন আমন্ত্রণের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গত ২৪ এপ্রিল ১৫টি লক্ষ্য ধরে ইন্দো-প্যাসিফিক ‘রূপরেখা’ ঘোষণা করে। ইন্দো-প্যাসিফিক, অর্থাৎ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে সে নীতি বা রূপরেখা এটা। এই অঞ্চলকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে, সেটাই মূলত তুলে ধরা হয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ নামের ওই নীতিতে। 

উদ্বেগ কমেনি

ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে পদ্মার ওই বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা উল্লেখ করে এক প্রশ্নে ড. মোমেন বলেন, রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা ইন্দো-প্যাফিসিক নিয়ে বলেছে। হ্যাঁ, আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে একটা আউটলুক তৈরি করেছি এবং আমরা চাই, এটা অত্যন্ত অবাধ, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিরাপদ, সবার সমৃদ্ধির জন্য নিয়মনীতিভিত্তিক নৌযান চলাচল।’ 

সবশেষ... 

বাংলাদেশ সফরে নির্বাচন ইস্যুতে আরো বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেছেন তারা। জানতে চেয়েছেন অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সকল রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে কি না তারা। কিন্তু এখানে স্পষ্ট দ্বিধাবিভক্ত দেখে গেছেন তারা। তবে মার্কিনিদের নজর আটকা বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিকোণের পানে। 

তবে এ সফরে তাদের মূল ইস্যু অনুসারে এ মাসের শেষের দিকে প্রতিরক্ষা সংলাপে যোগ দিতে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো প্যাসিফিক কমান্ডের কৌশলগত পরিকল্পনা ও নীতিবিষয়ক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টমাস জেমস। এছাড়াও অক্টোবরে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে একটি ‘নিরাপত্তা সংলাপ’ আয়োজনের চেষ্টা চলছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

শেয়ার করুন