২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ১১:০১:৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


২২ পরিবারের স্থলে ২২ হাজার লুটেরা-পাচারকারী
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৯-২০২৩
২২ পরিবারের স্থলে ২২ হাজার লুটেরা-পাচারকারী


ক্ষুদ্র সম্পদ কিন্তু সুবিশাল প্রতিক্রিয়া। অনুন্নত বা উন্নয়শীল দেশের দুর্বল দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি সংস্থাসমূহ, সরকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদী চক্রের আশীর্বাদপুষ্ট মহলের কারণে দেশের সম্পদ, মেধা পাচার হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে কৃষক, শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণে অর্থনৈতিক উন্নয়নসাধিত হলেও উন্নয়নের সুফল জনগণের দুয়ারে পৌঁছে না। সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ায় বিপুল সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে সীমিত থাকে। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ নানা কারণে নুন আন্তে পান্তা ফুরানো অবস্থায় দুঃসহ জীবন যাপন করে। দুনিয়ার অন্যতম উর্বর জমি, পরিশ্রমী কৃষক এবং বহুদর্শী শ্রমিক সমাজ, দেশের জন্য উপযোগী একজন সরকারপ্রধান থাকা সত্ত্বেও অবাধ পাচারের কারণে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হলেও দেশ এখন তীব্র আর্থিক সংকট এবং জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে। 

পাকিস্তান আমলে কোটিপতি ২২ পরিবারের স্থলে এখন প্রায় ২২ হাজার লুটেরা পরিবার দেশের বহু কষ্টার্জিত সম্পদ বিদেশে পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। সাধারণ মানুষ সীমিত আয় নিয়ে সৎভাবে জীবন যাপনে নিদারুণ কষ্টে আছে। সম্পদ পাচারের পাশাপাশি মেধা পাচার হয়েছে। সরকার তাই সৎ মানুষের অভাবে সুবিধাবাদী  সামরিক-বেসামরিক আমলা, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী মহলের অশুভ প্রভাবে দুষ্টের দমন করে শিষ্টের পালন করতে পারছে না।

সরকারপ্রধানের দৃঢ়তায় করোনা অতিমারি সামাল দেওয়া গেলেও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় দেশের অর্থনীতি এখন ধসেপড়ার অবস্থা। বাজারে নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না অশুভ সিন্ডিকেটদের। ডলার সংকটের কারণে আমদানি সংকুচিত, আমদানিকৃত জ্বালানির অভাবে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। কিন্তু একই সময়ে সরকার সমর্থিত কিছু অসৎ ব্যবসায়ী সংগঠনের কোটি কোটি টাকার সম্পদ পাচারের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। লুটেরা বাহিনীদের কাণ্ড-কাহিনী সবার জানা থাকায় কিছু বিদেশি শক্তি বাংলাদেশের ওপর অশুভ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। 

৩০ লাখ মানুষের রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের জন্মলগ্নে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র চোরাচালানের মাধ্যমে সম্পদ পাচার করে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার ওদের বলতেন চাটার দল। নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে লাল ঘোড়া ধাবিত করার সঙ্গে সঙ্গে জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫-১৯৯০ স্বৈরশাসকদের রাজত্বে দেশবিরোধী লুটেরা চক্র দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিসহায়ক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। দেশজুড়ে অসৎ মানুষগুলো সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে একসময় শিল্পী-সাহিত্যিক, সুধীজন ‘সৎ মানুষের খোঁজে’ সামাজিক আন্দোলন শুরু করে।

অবশেষে দুর্বার গণআন্দোলনে ১৯৯০ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলেও সুবিধাবাদী চক্র গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে লুকিয়ে থেকে গণতন্ত্রায়ন এবং সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে কাঁটা ঢেলে দেয়। ১৯৯১-৯৬  বিএনপি সরকারের সময়েও দেশ থেকে মেধা এবং সম্পদ পাচার অব্যাহত থাকে। ১৯৯৬-২০০১ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে স্বাধীনতার সপক্ষের দলগুলো ক্ষমতায় দেশে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত আবর্জনা পরিষ্কার করে উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করে। কিন্তু আবারও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সঙ্গী হয়ে দেশি-বিদেশি চক্রের সমর্থনে লুটেরা চক্র দেশশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ১৯৯৬-২০০১ সময়কালের অধিকাংশ অর্জন ব্যর্থ করে দেয়। ২০০১-২০০৬ হাওয়া ভবন নামের দুষ্টচক্রের অবাধ লুটপাটের কারণে দেশ দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। পাচার নামের দুষ্টগ্রহ দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে ফেলে। দেশজুড়ে তীব্র জ্বালানি সংকট, বিদ্যুৎ সংকটের সৃষ্টি হয়। সারা দেশে সন্ত্রাস সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে। ৬৫ জেলায় একসঙ্গে বোমা বিস্ফোরণ, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের দিনদুপুরে প্রকাশ্য সভায় হত্যা, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে প্রধান বিরোধী দলকে (২১ আগস্ট) নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রাণঘাতী গ্রেনেড আক্রমণ, সবকিছু হয়। ফলশ্রুতিতে ২০০৬-২০০৮ সেনাবাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসে। কিছুদিন উচ্চবিলাসী কিছু সেনা নায়কের পরিকল্পনায় বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র হলেও জনগণের সম্মিলিত আন্দোলনের চাপে ব্যর্থ হয়। 

২০০৯-২০২৩ ক্রমান্বয়ে দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকে আওয়ামী লীগ। স্বীকার করতেই হবে ২০০৯ বিদ্যমান বিদ্যুৎ-জ্বালানিসংকট, ভেঙেপড়া অর্থনীতি অনেকটাই সামাল দিয়ে দেশকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে গেছে সরকার। সন্ত্রাস দূর হয়েছে। কিন্তু সরকার সঠিক পেশাদারদের গুরুত্ব না দিয়ে অতিমাত্রায় সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। কিছু মানুষ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউএই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য দেশে পাচার করেছে। দেশব্যাপী যোগাযোগব্যবস্থা, বিপুল অর্থ বয়ে জ্বালানি-বিদ্যুৎ অবকাঠামো গড়ে তোলা হলেও কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেনি। দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ী মহল সরকারের কিছু মন্ত্রী সাংসদের প্রশ্রয়ে বিদেশি মুদ্রা পাচার করে সরকারের জন্য সংকট সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠান, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছু চুনোপুটিদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও রাঘব-বোয়ালরা ভিআইপি সমাদরে আছে। অনেক ক্ষেত্রে মহাদুর্নীতিবাজরা বহাল তবিয়তে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছে। 

সরকারপ্রধানকে বলতে হচ্ছে, কোনো মন্ত্রী বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হলে তাকেও ধরা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতি সহায়ক ভূমিকার কারণে সরকারপ্রধানের দুর্নীতিবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। 

এমনি যখন অবস্থা তখন ২০২৩ ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজপথে মুখোমুখি বিপরীতমুখী দুই রাজনৈতিক জোট, পাচার নামের দুষ্ট গ্রহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে দেশের ঝুড়ির তোলা সুরক্ষিত করাই হবে আগামী সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। না হলে ক্রমক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি ধসে পড়বে। আমদানি ব্যাহত হলে জ্বালানিসংকট অব্যাহত থাকবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া দুর্নীতি দমন করে সঠিক পেশাদারদের সঠিক স্থানে কাজ করার সুযোগ না দিলে বাংলাদেশকে ২০২৪-২০২৮ অনেক কঠিন সময় পার করতে হবে। ‘পাচার’ নামের বিষবৃক্ষটি উপড়ে ফেলতেই হবে।

শেয়ার করুন