২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০২:০৯:৫২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
বিদেশিদের কাছে অসম্মাজনক ধরনা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৫-২০২২
বিদেশিদের কাছে অসম্মাজনক ধরনা


র‌্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে গত বছরের শেষে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিভিন্ন দেশের ১৫ ব্যক্তি ও ১০ প্রতিষ্ঠানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭ জনই বাংলাদেশের। প্রথমে এবিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি, অন্যাদিকে পাত্তা দিচ্ছে না বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে বোঝানো হয়েছিল সরকারের একেবারে শীর্ষপর্যায় থেকে। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠে বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড় বইতে থাকে।  

এতে সরকার বুঝতে পারে র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবেই নেতাকর্মীরাসহ সর্বমহল বুঝে ফেলেছে। আর এমন ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে শুরু হয় দেনদরবার, অন্যদিকে মাঠে অন্দোলনরত বিএনপি ভেবেছে এমন সুযোগে রাজনীতির মাঠ তাদের হাতে। তারাও এ নিষেধাজ্ঞাকে তাদের পক্ষে গেছে বলে একদিকে যেমন বোঝাতে চেষ্টা করছে, অন্যদিকে দেশ-বিদেশে নানান ধরনের তদবিরে ব্যস্ত রেখেছে তাদের।  

কি পদক্ষেপ সরকারের?

র‌্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ওঠাতে সরকার শুরু করেছে প্রচণ্ড দৌড়ঝাঁপ। কারণ সরকার বুঝে ফেলেছে মার্কিনিদের এধরনের পদক্ষেপ ওঠাতে না পারলে রাজনীতির মাঠ, এমনকি অন্যসব সেক্টরের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর সেজন্য র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সরকার এক বছরের জন্যল্যান্স অ্যান্ড মুলিন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে লবিস্ট ফার্ম হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। 

আর এই লবিস্ট ফার্মের জন্য প্রতি মাসে ২০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এর আগে অবশ্য র‌্যাব কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে দেশটির পররাষ্ট্র দফতরকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সরকার। এতে যেসব বিষয় বিবেচনায় এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তার প্রতিটি বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়ে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছিলেন, র‌্যাবের কারণে সন্ত্রাস কমেছে, তাদের কারণে মাদকের বিস্তারও কমেছে।বাংলাদেশ যে মানবাধিকার রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে, সে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। 

তাতে মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডের‌্যাবের ভূমিকার কথাও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। আর দেশবাসীকে আশ্বস্ত করা হয় যে,গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বিবৃতির মাধ্যমে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ওই বিবৃতিতে এই নিষেধাজ্ঞার জন্য বারোটি এনজিওকে দায়ী করেন। অভিযোগ করেন ১২টি আন্তর্জাতিক এনজিও জাতিসংঘের পিসকিপিংয়ের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলকে একটি চিঠি লিখেছে।

তারা চিঠিতে বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা ও স্পেকুলেশন তুলে ধরে বলেছেন, র‌্যাব বিভিন্ন রকম হিউম্যান রাইটস ভঙ্গ করছে। তবে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, সঠিক তথ্য পৌঁছাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই র‌্যাবের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। তবে তার জন্য কিছু সময় লাগবে। তবে সরকার এখানেই থেমে থাকেনি, শুরু হয় আরো দৌড়ঝাঁপ। এসবের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে অনুরোধ করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ড. মোমেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এক প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র যায় এবং সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকও করেন। কিন্তু এখানে হতাশাজনক ঘটনা ঘটে। যদিও  ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের লেখা চিঠিও বেশ উৎসাহের জন্ম দেয় ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের একটি বক্তব্যে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।

কেউ কেউ মনে করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিস্টার মোমেনের নেতৃত্বে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে জল্পনা ছিল যে, মানবাধিকার প্রশ্নে র‌্যাব ও তার সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে হয়তো ইতিবাচক ফল মিলবে। যদিও এর আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটা ‘জটিল ও কঠিন’ বিষয়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ‘গর্হিত কাজ’। 

এমন মন্তব্য কূটনৈতিক চ্যানেলে আঘাত হেনেছে বলেও মনে করে থাকে। তবে এ বৈঠকের ফলাফল নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন শেষমেশ হতাশার কথাই বলেছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি আব্দুল মোমেনের পক্ষ থেকে কিছু বক্তব্য দেশে নানান বিতর্কের জন্ম দেয়। তা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী। কেননা যখন তিনি রাষ্ট্রহীন, গৃহহীন ও বেকার ছিলেন, তখন দেশটি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। আবার এটাও জানা যায় বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

এতে আলোচনার ঝড় ওঠে যে, তিনি কি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য বিদেশিদের উৎসাহিত করলেন না?  প্রশ্ন হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যখন বললেন তিনি রাষ্ট্রহীন, গৃহহীন ও বেকার ছিলেন, তখন দেশটি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। তখন তো রাজনীতিতেও ছিলেন না তিনি যে, রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হবেন। কবে ও কীভাবে তিনি রাষ্ট্রহীন হয়েছিলেন তা বলা হয়নি। কেন, কি কারণে তিনি এমন পরিস্থিতির শিকার হলেন? তিনি কি বাংলাদেশি ছিলেন না? 

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বশেষ পদক্ষেপ বিব্রত বাংলাদেশ

এদিকে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন,র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রতিবেশী ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন প্রকাশ্যে এ ধরনের মন্তব্যই দেশের জন্য ‘অসম্মানজনক’ এবং ভারত বা তৃতীয় কোনো দেশের এ বিষয়ে কিছু করারও নেই বলে মনে করেন তারা। কিন্তু তার এই শেষ অস্ত্রটি নিয়ে শেষমেশ রাজনীতি বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। আর বাংলাদেশ পড়েছে বিব্রতকর অবস্থায়। আর এতে বাংলাদেশে সংবাদকর্মীরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। ঘটনাটি ঘটে গত ২৮ এপ্রিল বৃহস্পপতিবার।

র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানিয়েছিলেন। সেই সহযোগিতা কীভাবে করবে ভারত-জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেই প্রশ্ন করার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, এই প্রশ্ন আপনি ড. মোমেনকেই করুন। আমাকে নয়। সাথে সাথে বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রশ্ন করেন ড. মোমেনকেই। এসময় ড. মোমেন বলেন, আমরা এনিয়ে কাজ করছি আর অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, তার বাংলাদেশে আসার প্রকৃত কারণ। তিনি জানান এবার ঢাকায় এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সুবিধাজনক সময়ে দিল্লি সফর করবেন।

তার সফরের সময়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিটির সভাও অনুষ্ঠিত হবে বলে খবর দেন। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বাণিজ্য সম্পর্কিত সহযোগিতার বিষয়টি বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল) ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। অর্থাৎ বোঝা গেলো র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টি আসলে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নজরে নেই। আর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এটি দু’দেশের আলোচনার এজেন্ডাতেও ছিল না। 

কি করছে বিএনপি?

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকে মারাত্মকভাবে অস্থির বিএনপি। সরকারে যেতে নানান ধরনের দেনদরবার করে যাচ্ছে, যা রাজনীতিতে স্পষ্ট। এব্যাপারে তারা ইফতার রাজনীতিকেও ব্যবহার করেছে। এতে দেখা গেছে,ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিল করেছে বিএনপি। আর এতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন, ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীসহ বিদেশি কূটনীতিকের উপস্থিতিকে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। এর পশাপাশি এই ইফতার রাজনীতিতে আরো আলোচনার জন্ম দেয় ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়া ও বক্তব্য দেয়া, কয়েক মাস আগেও ধারণার বাইরে ছিল। 

এছাড়া এতে খালেদা জিয়ার ওপর একটি ভিডিও দেখানো হয়। ইফতারের আগে কূটনীতিক ও মিশনপ্রধানদের উদ্দেশে দেয়া স্বাগত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আবেগপ্রবণ বক্তব্যে বলেছেন, আগে সবসময় আমাদের দলের চেয়ারম্যান খালেদা জিয়া আপনাদের সঙ্গে ইফতার করতেন। তিনি আজ গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আজ বিদেশে অবস্থান করছেন।এর বিপরীতে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ইফতারের আয়োজন করেছিল আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটি। 

এতে উপস্থিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে ইফতার পার্টি বলে এ সময় তিনি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। মাত্র এক মিনিটের কম সময়ে বক্তব্য শেষ করেন তিনি। কেন তিনিএতো কম কথায় বক্তব্য রাখলেন তা-ও রাজনীতিতে আলোচিত হতে থাকে।

 এদিকে বিএনপি যে কেবল এই এক ইফতার পার্টিতেই তাদের পক্ষ থেকে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়ার বিষয়টি ফুটে উঠেছে তা নয়। খোদ দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলে ফেলেছেন বিএনপির আন্দোলনে বিদেশিদেরও সমর্থন আছে। আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। বিদেশিদের সমর্থন আছে, দেশেও সমর্থন আছে। কিন্তু ফয়সালা হবে রাজপথে। ফয়সালা হতে হবে রাস্তায়। আলোচনায় সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়িস্থ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে মহানগর বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে যখন এসব কথা বলছিলেন তিনি, সেই ইফতার মাহফিলে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার ডা. রাজিব রঞ্জন।

বিএনপিও লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছিল

বিএনপি ও জামায়াত যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৮টি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছিল বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে দেয়া বিবৃতিতে বলেছিলেন। তিনি বলেন, বিএনপি ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪টি এবং ২০১৯ সালে একটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-বিএনপি তিনটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বিভিন্ন লবিস্ট ফার্মের অপপ্রচারের কারণে এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে শুধু মিথ্যা তথ্য কিংবা অসত্য ঘটনা প্রকাশ করেনি, সেই সঙ্গে ‘র‌্যাব খুব খারাপ প্রতিষ্ঠান’ উল্লেখ করে বিশ্বের বড় বড় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে নিয়মিত ফিডব্যাক দিয়েছে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিএনপি খুব জোরালো বক্তব্য দেয়নি। 

ক্ষতি কার?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলসহ দক্ষ কূটনীতিক মনে করেন, দেশে দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্ব বজায় থাকলে একটি স্বাধীন দেশকে অনেক মাশুল দিতে হয়। কারণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে। তাহলো  বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত আকসা ও জিসোমিয়া নামের দুটি চুক্তি সই করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আকসার (অ্যাকুজিশান অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট) অধীনে মার্কিন বাহিনী খাদ্য, জ্বালানি, গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি বিনিময় হয়ে থাকে। জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট) চুক্তির অধীনে হয় সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের বিনিময়। প্রশ্ন হচ্ছে র‌্যাব ও তার ছয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সরকারের বেশি মাথাব্যাথার সুযোগে দেশে অন্য কিছু না হাতাছাড়া হয়ে যায়। 

শেষ কথা 

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের মানুষের সাহায্য সহযোগিতা সমর্থন বাদ দিয়ে বিদেশিদের কাছে এমন ধরনাকে কেউ ভালোভাবে দেখেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ঝানু কূটনীতিবিদ এ প্রতিনিধিকে বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের পক্ষ থেকে র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রতিবেশী ভারতের সহায়তা চাওয়ার বিষয়টি দেশের জন্য অসম্মানজনক। তাছাড়া ভারত বা তৃতীয় কোনো দেশের এ বিষয়ে কিছু করারও নেই বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে তারা এ-ও বলেছেন যদিও ভারতের বা অন্য দেশের পক্ষ থেকে কিছু করার থাকে তা বাংলাদেশ সরকারে অত্যন্ত গোপনে বা কৌশল অবলম্বন করতে পারতেন। 

র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রতিবেশী ভারতের সহায়তা চাওয়ার বিষয়টি এভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে চলে আসা ঠিক হয়নি। অন্যদিকে ড. মোমেন যেভাবে যুক্তি দেখিয়েছেন তাহলো তিনি আশা করেন ভারত বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উত্থাপন করবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫ লাখ ভারতীয় বসবাস করে, তারা খুবই শক্তিশালী। তারাও সরকারকে বলেছে, এটি হয়েছে শুধু ভারত আমাদের বন্ধু বলে। কূটনীতিকরা মনে করেন, একজন দক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে এধরনের মন্তব্য কোনো কৌশলেই পড়ে না। 

আর সবচেয়ে লজ্জাজনক হচ্ছে র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানিয়েছিলেন। সেই সহযোগিতা কীভাবে করবে ভারত-তা সংবাদকর্মীদের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়াটা ছিল খুবই বিব্রতকর। আর উপস্থিত সাংবাদিকরাই এর উত্তর পেয়েছেন খুব ভালোভাবে না। কারণ এব্যাপারে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর প্রশ্নকারীকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেই প্রশ্ন করার পরামর্শ দেন। এটা আসলে খুবই বিব্রতকর অবস্থা। এধরনের পরিস্থিতি একটি স্বাধীন দেশের জন্য কূটা সম্মাজনক তা কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বোঝেন। কেননা একটি দেশের এধরনের সমস্যা অন্যদেশ কি করে সমাধান করতে পারে তা একজন সংবাদকর্মীর ভালোই জানা আছে। তারপরও প্রশ্ন করে একটা বিব্রতকর অবস্থায় দেশকে ফেলা হয়েছে। আর এমন প্রশ্ন করার সুযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রী তৈরি করে দিয়েছেন।

কেননা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনই বলেছিলেন, র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দলও বসে নেই। তারাও বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়েই যাচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়িস্থ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে মহানগর বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার ডা. রাজিব রঞ্জনের উপস্থিতিতেই আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন বিএনপির আন্দোলনে বিদেশিদেরও সমর্থন আছে। তার অর্থ কি দাঁড়ায়?

তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন ইফতার মাহফিলে চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার ডা. রাজিব রঞ্জনের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে সে দেশটির (ভারতের) সমর্থন তারা পেয়ে গেছেন? আবার তারা কি এটাও ভেবেছেন যে, র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এভাবে পাল্লা দিয়ে বিদেশি সমর্থন পেতে রাজনীতিবিদদের দৌড়ঝাঁপ দেশ ও জাতির জন্য খুবই মর্যাদাহানিকর।

এব্যাপারে জানতে চাইলে দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধিকে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল বলেছেন, র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন  নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের কাছে তদবির দেশের  জাতীয় মর্যাদা, সম্মান ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভূমিকা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদেরকে ডেকে আনার শামিল; এসব সরকারের বিদেশি তোষণ নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।এটা সাধারণ কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও বাইরে। 

তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কেন আমাদেরকে ভারতীয় সরকারের কাছে নির্লজ্জভাবে তদবির করতে হবে! তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে যেভাবে  মার্কিন কূটনীতিকদেরকে ভূমিকা রাখতে বলেন সেটা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদেরকে ডেকে আনার শামিল।তারা বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বহুদিন ধরেই নানা ইস্যুতে দেশের জন্য অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে আসছেন। এসব আচরণ সরকারের অনুগত বিদেশি তোষণ নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।


শেয়ার করুন