০১ মে ২০১২, বুধবার, ০৮:৪৯:১০ অপরাহ্ন


বসবাসের জন্য অনিরাপদ নগরী ঢাকা
খন্দকার সালেক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৩-২০২৪
বসবাসের জন্য অনিরাপদ নগরী ঢাকা (উপরে) বেইলি রোডে আগুন ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি এবং (নিচে) নিমতলী দুর্ঘটনা ও মগবাজার বিস্ফোরণ


ঢাকার অভিজাত এলাকা বেইলি রোডে অবৈধভাবে চালু রেস্টুরেন্টে প্রাণঘাতী অগ্নিকা-ের পর অনেকে বলছে ঢাকায় বহুতল ভবনের অনেকগুলো এখন লাইভ বোমার মতোই বিপজ্জনক। সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থা বলছে ভবনের কোনো ধরনের অনুমোদন নেই। একই ধরনের হাজারো অনুমোদনহীন রেস্টুরেন্ট ঢাকাজুড়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে কর্তপক্ষের নাকের ডগায়। কারো কোন জবাবদিহি নেই। 

সত্যি বলতে মহানগরী ঢাকায় এখন নিরাপদ জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা নেই। মাটির নিচে অংসংখ ছিদ্র যুক্ত প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন যেন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি, আবাসিক এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হোটেল, রেস্তোরাঁগুলোর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা নেই, সড়কে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বায়ুদূষণ করে চলছে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন, ট্রাফিক আইন না মানায় মহাসড়কগুলোয় নিয়মিত ঘটছে দুর্ঘটনা, নানা কারণে বায়ুদূষণ, জলদূষণ, শব্দ দূষণ। ঢাকা মহানগরী এখন বসবাসের জন্য বিশ্বের নিকৃষ্টতম শহরগুলোর অন্যতম। বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে সংক্ষণের জন্য প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা হয়েছে। এখনো একইভাবে রাসায়নিক দ্রব্যাদি আগের মতো আছে। চুড়িহাট্টা, নিমতলীতে কত পরিবারের স্বপ্ন গাছে। পুরোনো শতছিন্ন গ্যাস পাইপ থেকে নিয়মিত দুর্ঘটনা হচ্ছে। সবার হয়তো স্মরণে আছে অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎসংযোগজনিত দুর্ঘটনায় রোজার মাসে মসজিদে প্রাণহানি ঘটেছে মুসল্লিদের। মগবাজার, বঙ্গবাজার এমনি কত স্থানে গ্যাস লিকেজজনিত মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে। যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর জানা যাচ্ছে সবকিছুই নাকি অবৈধ। ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে, অনুমোদনপ্রাপ্ত শর্ত অনুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে কি না? ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা আদৌ আছে কি না? দুর্ঘটনা হলে নির্গমন ব্যবস্থা আছে কি না এগুলো পরিদর্শন করার কেউ নেই। জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো আয়োজন বা উদ্যোগ নেই। কোনো দুর্ঘটনা হলেই কয়েকদিন মিডিয়ায় তোড়জোড় হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। যেন মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। 

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কেউ কোনো কথা শুনে না। এতো সংস্থা, এতো কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রী, সচিব তাদের কেউ কি দায়িত্ব নিবে না। শুধু ঢাকা মহানগরীতে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনেকের চাকরিচ্যুতিসহ শাস্তি বিধান হওয়া উচিত ছিল। যেভাবে চলছে বৈপ্লবিক কিছু না হলে ঢাকা মহানগরীতে মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকবে। 

প্রকৃত অর্থেই ঢাকা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে, অসংখ্য জীবন্ত বোমা আছে ঢাকা জুড়ে। সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ, অননুমোদিত ভবনগুলো ভেঙে ফেলতে হবে, সব বহুতল ভবনে অগ্নি-নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত থাকতে হবে, নির্গমন পথ বাধাহীন রাখতে হবে, সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার পদ্ধতি, নিরাপদ সংরক্ষণ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে, গ্যাস লিকেজ চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে পুরোনো লাইনগুলো। এই বিষয়ে বিচ্ছুতি হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। না হলে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।

অকুপেশন হেলথ সেফটি ব্যবস্থাপনা উপেক্ষিত 

ঢাকা শহরে অলিগলিতে গড়ে ওঠা অগণিত হোটেল রেস্টুরেন্টে বিদ্যমান অসংখ্য নিরাপত্তা দারুণভাবে উপেক্ষিত। অনেক ক্ষেত্রেই আবাসিক এলাকায় যত্রতত্র গড়ে উঠেছে খাবার দোকানগুলো। এক্ষেত্রে নিয়মনীতির কোনো বলাই নেই। খাবারের মান নিয়ে কিছুই বলার নেই। যেসব ভবনে এগুলো নির্মিত সেগুলোতে অগ্নি-নিরাপত্তাব্যবস্থা বা দুর্ঘটনা হলে উদ্ধার করার ব্যবস্থা আছে কি না দেখার কেউ নেই। এবারের দুর্ঘটনা এই ধরনের প্রথম বা শেষ না। আগুন লাগার কারণ নিয়ে এখনো কিছুই বলার নেই। তবে আলামত থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইতিপূর্বে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কেমিক্যালজনিত কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনায় প্রাণহানি এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার পর কয়েকদিন মিডিয়া সক্রিয় থাকে, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিছু দিন পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। কেউ কিছু শিক্ষা নেয় না। বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে বিশেষত জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যবহার ক্ষেত্রে অকুপেশন হেলথ সেফটি ব্যবস্থাপনা উপেক্ষিত। দেশে অনেক সংস্থা থাকলেও এদের কাজ অনেকটাই গতানুগতিক, জনসচেতনতার অভাব। দায়িত্ববোধের অভাব। নিশ্চয় কারো না কারো ভুলে এই দুর্ঘটনা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাবে কারো কিছুই হবে না. শুধু হাহাকার থাকবে স্বজনহারাদের। আবারও কোনো অন্য কোনো স্থানে একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে। 

এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে অবিলম্বে আবাসিক এলাকায় এবং বাণিজ্য বিতানে হোটেল রেস্টুরেন্টে অগ্নি-নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শনের অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে আবাসিক এলাকায় এই ধরনের হোটেল রেস্টুরেন্ট অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সতর্ক থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব রয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস অথবা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনেক সতর্র্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে। লিপ ইয়ার আসে চার বছর পরপর। এবারের লিপ ইয়ারে বিশেষ দিনটি অনেকের জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে। 

অনুমোদনহীন রেন্টুরেন্ট 

অগ্নি-দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিরীহ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর জানা গেলো বেইলি রোডের ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট করার অনুমোদন ছিল না। অথচ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সবার চোখের সামনেই এমন ভবনে রেস্টুরেন্ট। যার পাশেই রাজারবাগ পুলিশলাইনসসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সচিবালয়ও খুব বেশি দূরত্বে নয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের পদভাবে মুখরিতই থাকে বেইলি রোড। এটা নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে। এমন এক স্থানে এভাবে অনুমতিহীন কাজকর্ম কীভাবে চলে এটা বড় প্রশ্ন। 

ভবনটির অগ্নি-নিরাপত্তার অনুমতি ছিল না। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্দেশ মানা হচ্ছে না। তাহলে একটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশে এতো সংস্থা থাকার কি প্রয়োজন? আইন অমান্য যেখানে আইন, সেখানে আইনসভার কি প্রয়োজন? দুনিয়ার অনেক দেশে এতো ঘন ঘন আগুন দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব লজ্জায় পদত্যাগ করতেন। কত ঘটনা ঘটেছে প্রাকৃতিক গ্যাস, রাসায়নিক পদার্থঘটিত দুর্ঘটনায়। কারো কি বিচার হয়েছে? কয়েকদিন অনেক হা-হুতাশ তোড়জোড় থাকবে। তারপর সব গতানুগতিক ধারায় ফিরে যাবে। ঢাকাসহ সারা দেশে এমন কত রেস্টুরেন্ট, হোটেল, স্থাপনা অনুমোদনহীন আছে? অধিকাংশ বহুতল ভবনে দুর্ঘটনার সময় এক্সিট ব্যবস্থা নেই, এভাবে একটি স্বাধীন দেশ চলছে। দায়িত্বে থাকা মানুষদের কখন লজ্জা হবে? এটি কেমন করে হয় যে প্রতিটি দুর্ঘটনার পর দেখা যায় অনুমোদনহীনভাবে চলছিল সবকিছু? এই দেশে স্বনামধন্য এক প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়-‘নির্দেশ মানছে না কেউ।’ সাধারণ মানুষের জন্য কতটা হতাশাজনক একবার চিন্তা কেউ করছেন কী?

শেয়ার করুন