ক্যালিফোর্নিয়া সিটি ডিটেনশন ফ্যাসিলিটি
ক্যালিফোর্নিয়ার মোহাভে মরুভূমি এলাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অভিবাসী ডিটেনশন সেন্টার ক্যালিফোর্নিয়া সিটি ডিটেনশন ফ্যাসিলিটিতে বন্দিদের বিরুদ্ধে মানবিক ও আইনি অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে সাতজন বন্দি ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে ১২ নভেম্বর মামলা দায়ের করেছেন। অভিযোগ অনুযায়ী, কেন্দ্রটিতে বন্দিদের অমানবিক পরিস্থিতিতে রাখা হচ্ছে, যথাযথ-খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা প্রদান করা হয় না এবং ধর্মীয় ও আইনগত অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। মামলাটি গোমেজ রুইজ বনাম আইসিই নামে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে দায়ের করা হয়েছে এবং এটি আইসের বন্দিদের ওপর নিয়মিত নির্যাতন এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘনকে চ্যালেঞ্জ করছে।
মামলায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রটি মানবিক, স্বাস্থ্যগত এবং আইনি দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। বন্দিরা এখানে অমানবিক পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য, খাদ্য ও পানি অপ্রতুল, আবাসন অপরিষ্কার এবং তাপমাত্রা অত্যন্ত কম। পরিবারিক ভিজিট সীমিত এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধা রয়েছে। প্রায়শই বন্দিদের একাকী রাখা ও অতিরিক্ত পৃথকীকরণ করা হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। মামলার অভিযোগ অনুসারে, কেন্দ্রের স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত অপ্রতুল। ক্যানসার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য গুরুতর রোগের জন্য জরুরি চিকিৎসা প্রদান করা হয় না। প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যেমন-হুইলচেয়ার, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার এবং অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী সহায়তা দেওয়া হয়নি। ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। বন্দিদের প্রার্থনার মাদুর, মাথার কাপড়, পবিত্র গ্রন্থ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বাধা রয়েছে। ফোনকলের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়, এবং ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আইসের অধীনে কোর সিভিক, একটি লাভজনক সংস্থা, কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে। কেন্দ্রটি পুনরায় খোলার পর থেকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে। বন্দিরা এটিকে যন্ত্রণা কক্ষ বলে অভিহিত করেছেন। স্থানীয় কমিউনিটি এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো কেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বন্দিরা সিট-ইন ও হাঙ্গার স্ট্রাইকের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি শতাধিক বন্দি একযোগে কেন্দ্রে জড়ো হয়ে লঙ্ঘন বন্ধ করার দাবি জানান।
মামলার অভিযোগকারী সোখিয়ানকেও বলেন, আমি এ মামলা দায়ের করেছি যাতে আমরা এখানে যে কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করছি তা শেষ করা যায়। আইস মানুষকে বর্জ্যরে মতো আচরণ করছে। এখানে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা সাবানও পায় না এবং খাবারও যথেষ্ট নয়। অনেকেই ওজন কমাচ্ছে। এটি শুধু আমার জন্য নয়, বরং সবার জন্য আমরা সাহায্যের আবেদন করছি। অন্য অভিযোগকারী গুস্তাভো গুয়েভারা বলেন, কোনো মানুষ, অভিবাসী হোক বা না হোক, এই ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া উচিত নয়। সমাজকে সচেতন হতে হবে।
মামলার মাধ্যমে অভিযোগ করা হয়েছে যে, আইস কেন্দ্রটিতে বন্দিদের ওপর প্রতিদিন নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার ভঙ্গ করছে। ক্যালিফোর্নিয়া সিটি কেন্দ্রের মোট ২ হাজার ৫৬০টি বেড রয়েছে। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, মামলা দায়েরের সময় এখানে ৮০০-এর বেশি মানুষ বন্দি ছিলেন এবং আইস প্রতিদিন নতুন অভিবাসী স্থানান্তর করছে। কোর সিভিক আশা করছে ২০২৬ সালের শুরুতে কেন্দ্র সম্পূর্ণ ধারণক্ষমতা অর্জন করবে।
মামলায় বন্দিরা দাবি করেছেন যে, কেন্দ্রের পরিবেশ অত্যন্ত শাস্তিমূলক। এখানে খাদ্য, পানি এবং মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা যথাযথভাবে প্রদান করা হয় না। আইনগত সহায়তা ও পরিবারিক ভিজিটের সুযোগও সীমিত। বন্দিদের একাধিক অভিযোগ অনুযায়ী, কেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মীরা প্রায়ই বন্দিদের ধর্ষণ, শারীরিক এবং মানসিক হুমকি প্রদর্শন করছে। মানবাধিকার সংস্থা ডিসঅ্যাবিলিটি রাইটস ক্যালিফোর্নিয়া কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে বলেছে, ক্যালিফোর্নিয়া সিটি কেন্দ্র মানবিক প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ, জরুরি চিকিৎসা প্রদান করতে ব্যর্থ এবং বন্দিদের হয়রানি করছে।
মামলায় চূড়ান্তভাবে দাবি করা হয়েছে: বন্দিদের জন্য পরিষ্কার ও নিরাপদ আবাসন এবং পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা, চিকিৎসা এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিবারিক ভিজিটের সুযোগ নিশ্চিত করা, অতিরিক্ত একাকীত্ব এবং পৃথকীকরণ নিয়ন্ত্রণ করা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং প্রার্থনার সুযোগ রক্ষা করা, সংবিধান অনুযায়ী বন্দিদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। মামলার বাদীদের আইনজীবীরা বলছেন, এই মামলা শুধু বন্দিদের জন্য নয়, বরং পুরো অভিবাসী ডিটেনশন ব্যবস্থার শৃঙ্খলাবদ্ধ মনোভাব ও আইসের দায়িত্বহীন আচরণের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ। মার্কিন সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের সিনিয়র অ্যাটর্নি কাইল ভারজিয়েন বলেছেন, কেন্দ্রে বন্দিদের ওপর আইসের আচরণ মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদার সম্পূর্ণ অবহেলার উদাহরণ।
প্রিজন ল অফিসের টেস বর্ডেন বলেন, ৮০০ মানুষ মোহাভে মরুভূমিতে এমন অবস্থায় বন্দি। আমাদের ক্লায়েন্টরা এই মামলা দায়ের করেছেন যাতে ক্যালিফোর্নিয়া সিটি এবং বড় অভিবাসী ডিটেনশন ব্যবস্থায় সঠিক ও সংবিধানগত বন্দিত্ব নিশ্চিত করা যায়। কেকার, ভ্যান নেস্ট পিটারস এলএলপির স্টিভেন পি. র্যাগল্যান্ড বলেন, কেন্দ্রে যা হচ্ছে তা শাস্তিমূলক এবং সংবিধানবিরোধী। এখানে বন্দিদের মৌলিক মানবাধিকার, মর্যাদা এবং বিচার প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমরা এই পরিস্থিতি ঠিক করতে এবং প্রশাসনকে দায়ী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ক্যালিফোর্নিয়া কলাবোরেটিভ ফর ইমিগ্র্যান্ট জাস্টিসের প্রিয়া প্যাটেল বলেন, আমাদের ফোনে আসা ভিডিওতে দেখা যায় ফেডারেল এজেন্টরা প্রতিবেশীদের সহিংসতার মাধ্যমে গ্রেফতার করছে। এই মামলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নির্যাতন এখানেই শেষ হয় না, এটি ক্যালিফোর্নিয়া সিটি ডিটেনশন ফ্যাসিলিটির দেওয়ালের পেছনে আরো অব্যাহত থাকে। মামলায় আরো বলা হয়েছে, আইসের এ অভিজ্ঞতা প্রতিদিন নতুন উদ্বাস্তু ও অভিবাসীকে কেন্দ্রটিতে স্থানান্তর করছে, যার ফলে বন্দিদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে কেন্দ্রটি অতিরিক্ত ধারণক্ষমতার চাপের মধ্যে পড়েছে, যা স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।
বন্দিরা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। কিছু বন্দি জানান, সাবান বা পরিষ্কার কাপড়ের অভাব, অপ্রতুল খাদ্য ও পানির জোগান, এবং সাপ্তাহিক পারিবারিক ভিজিট বন্ধ থাকা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক। একাধিক বন্দি জানান, তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি, যা তাদের আইনগত অধিকার ভঙ্গ করছে। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, এ মামলা সংবিধান অনুযায়ী অভিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আইসের নীতি ও ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসী নীতি যে মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ তা মামলায় স্পষ্ট করা হয়েছে।
মোটকথা, ক্যালিফোর্নিয়া সিটি ডিটেনশন ফ্যাসিলিটি এবং আইসের কার্যক্রম মানবাধিকার, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবিক নীতির পরিপন্থী। মামলাটি কেবল একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রের বিষয় নয়, বরং সম্পূর্ণ অভিবাসী ডিটেনশন ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে। এ মামলা প্রত্যেক অভিবাসীর মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আইনি পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়। এটি প্রমাণ করে, অভিবাসী ডিটেনশন কেন্দ্রগুলোতে বন্দিদের পরিস্থিতি সম্পর্কে সমাজ ও প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।