প্রথম আলো অফিসে অগ্নিসংযোগ
নিজস্ব উপায়ে সামাজিক অন্যায়, অবিচার, বৈষম্যবিরোধী চেতনা সৃষ্টির প্রয়াসে স্বল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বিপ্লবী কণ্ঠস্বর শরিফ উসমান হাদিকে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নির্মমভাবে হত্যা করলো। তার শহিদি মৃত্যু স্বাধীনতা প্রিয় সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একমঞ্চে সমবেত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে এমনি সুযোগ ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪ এসেছে। কিন্তু প্রতিবারই সেই সংগ্রামী চেতনা কিছু অতি বিপ্লবী, অদূরদর্শী কুচক্রীর ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়েছে। এবারেও কিন্তু দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টায় পত্রিকা অফিস, সাংস্কৃতিক স্থাপনা, প্রতিবেশী দেশের দূতাবাসের ওপর নিন্দনীয় মব সন্ত্রাস চালিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃউদ্ধারের জয়যাত্রাকে ব্যাহত করার কার্যক্রমে মত্ত হয়েছে।
বিপ্লবী ওসমান হাদির মরদেহ জাতীয় পতাকা জড়িয়ে এসেছে বাংলাদেশে। পরে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় মরহুমের জানাজা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। সবার দাবি হাদির খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে যেন আইনের আওতায় আনা হয়। তড়িঘড়ি করে নয়, নিরপেক্ষ তদন্ত করে যেন হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা মহলদের যেন চিহ্নিত করে প্রকৃত দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি বিধান করা হয়।
হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে কিছু চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী সোশ্যাল মিডিয়ায় উসকানি দিয়ে নিন্দনীয় মব সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। দুটি শীর্ষ স্থানীয় জাতীয় পত্রিকা ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো কার্যালয়ে মব সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, পুনরায় ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক ভবন ভাঙচুর করা হয়েছে, ছায়ানট এবং উদীচী ভবন ভাঙচুর করা হয়েছে। রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে ভারতীয় দূতাবাসের অফিস আক্রমণ করা হয়েছে। এগুলো কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। উস্কানিদাতা মহল চিহ্নিত। যারা মব সন্ত্রাস করেছে তাদের খুঁজে বের করাও দুরূহ নয়। সরকার ঘটনার সময় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনো সুযোগ আছে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের। এটা সুস্পষ্ট একটি মহল চায় না বাংলাদেশে গণতন্ত্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। নানাভাবে উসকানি দিয়ে হিংসা ছড়িয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত অথবা বেপথে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কারো দয়ার দানে স্বাধীনতা আসেনি। ১৯৭১ ও ২০২৪ যারা জীবন দিয়েছেন তাদের লালিত স্বপ্ন বাস্তাবায়ন করতে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক জনগণের ইস্পাত কঠিন ঐক্য। শহিদ ওসমান হাদির বিদেহী আত্মা তখনি শান্তি পাবে যখন বাংলাদেশে সৌহার্দ্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর পরমত সহিষ্ণুতার সামাজিকসহ অবস্থান গড়ে উঠবে। এবারের সুযোগ যেন ব্যর্থ না হয়। সামাজিক শক্তির রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়।
ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের সহিংস প্রতিবাদ কারো মঙ্গল আনবে না
জুলাই বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নেতা ওসমান হাদি স্বল্প সময়ে তার বলিষ্ঠ এবং সাহসী ভূমিকার জন্য স্বল্প সময়ে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। শহরের কেন্দ্রস্থলে ঢাকা রাজপথে দিনদুপুরে আঁততায়ীরা তাকে গুলিবিদ্ধ করে। মাথায় নাজুক স্থানে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় দেশে নিবিড় যত্নে চিকিৎসার পর বিশেষ ব্যবস্থায় সিঙ্গাপুর নেওয়া হয় আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হাদি মৃত্যুবরণ করেন। হাদির মর্মান্তিক মৃত্যুতে রাজনৈতিক সহকর্মী, জুলাই বিপ্লবের সহযাত্রী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী বাহিনীসহ সাধারণ জনতা তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সড়কে বিক্ষুব্ধ অবস্থানসহ ছাত্র-জনতা সারা দেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নিকাণ্ড, তাণ্ডব চালায়। হাদির মতো সাহসী উঠতি রাজনৈতিক নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডে জনগণ বিক্ষুব্ধ হবে এটি স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন জাগে হিংস্র প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে সরকার কেনো যথাসময়ে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলো? এই যে ভারতীয় দূতাবাসের কিছু কার্যালয়ে নাশকতা করার চেষ্টা, পত্রিকা অফিস নাশকতা দেশের ভাবমূর্তির জন্য আদর্শ সংকেত নয়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সব দেশপ্রেমী রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা। নাজুক সময়ে দেশ এবং বিদেশ থেকে কিছু দায়িত্বহীন বিতর্কিত ব্যক্তির উসকানিতে পরিস্থিতি জটিল হলে দেশবিরোধী শক্তি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ পাবে। বিঘ্নিত হবে নির্বাচন প্রক্রিয়া।
হাদি এবারে ঢাকার একটি আসন থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিল। একই আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী মির্জা আব্বাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি সাদেক কাইয়ুম প্রার্থী। হাদি বেশ কিছুদিন যাবৎ সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার পদ্ধতিতে জনসংযোগ চালাচ্ছিল। সুস্পষ্টভাবে তাকে দেওয়া নানা হুমকি বিষয়ে প্রাণহানির শঙ্কা প্রকাশ করছিল। সরকারের আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলো যথা সময়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দুঃখজনক ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। আরো লজ্জার বিষয় সব সংস্থার দৃষ্টি এড়িয়ে কিভাবে সন্দেহভাজন আঁততায়ী ঢাকা থেকে পালিয়ে সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে গেল? এখানে নিশ্চয় অশুভ চক্রের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে। জানি না আসল খুনিকে সহজে আইনের আওতায় নিয়ে আসা আদৌ সম্ভব হবে কি না। আর এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি। বিশেষ করে প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতির হুমকি দেওয়া বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।
আশা করি সরকার নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং হাদির হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। সেই সঙ্গে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকেও অনুরোধ করবো দায়িত্বশীল আচরণ করতে। এর বাইরে যারা নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠান না করার চিন্তাভাবনা করে ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে, তারা প্রকৃত অর্থের গণতন্ত্রের শত্রু। সময় এসেছে এসব মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। এবং সব ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার।
সরকার কেন সংবাদপত্র, উদীচী, ছায়ানটকে সুরক্ষা দিলো না?
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত কয়েকদিনে বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। পরিস্থিতি জটিল, সর্বত্র অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। নির্ভরযোগ্য তথ্য বলছে সরকারি সংস্থাগুলো সঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রতিটি ঘটনা এড়ানো যেত। কেন করলো না সরকার? জুলাই বিপ্লবের পর দৃশ্যপটে ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য নিয়ে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত তরুণ শরীফ উসমান হাদি সাধারণ মানুষের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। নানা ধরনের হুমকি থেকে নিজে নানাভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। হাদি ইনকিলাব মঞ্চ বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্মে ঢাকার একটি আসন থেকে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল। একই আসনে বিএনপির ডাকসাইটে নেতা মির্জা আব্বাস এবং জামায়াতের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতি সাদিক কায়েম প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো হাদিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলো না। খোদ রাজধানীর কেন্দ্রে দিনে দুপুরে আঁততায়ী হত্যার উদ্দেশে গুলি করে পালিয়ে গেলো। এখন বলা হচ্ছে আঁততায়ীকে কিছুদিন আগে গ্রেফতারের পর দ্রুত বেইল দেওয়া হয়েছে।
জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভ দেখে সরকার নড়ে চড়ে বসলো। গুরুতর আহত হাদিকে ঢাকা মেডিকেল, এভার কেয়ার হসপিটালে চিকিৎসার পর সিঙ্গাপুরে নেয়া হলেও বাঁচানো গেল না। গোটাদেশে বিস্ফোরণ ঘটলো। হাদির লাশ বাংলাদেশে আসলো। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিশাল জানাজার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের প্রাঙ্গণে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হলো। হাদির এই হত্যাকাণ্ডে কার লাভ কার ক্ষতি সেই আলোচনায় যাবো না। কিন্তু এই নির্মম হত্যাকাণ্ড যে আসন্ন নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার সাজানো পরিকল্পনা সেটি সহজেই অনুমেয়।
দেশ বিদেশ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় চেনা গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ঘোষণা দিয়ে ঢাকা সহ দেশজুড়ে ব্যাপক মব সন্ত্রাস সৃষ্টি করলো। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীসহ সব আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের ভূমিকা ছিল নিন্দনীয়। একই গোষ্ঠীর প্ররোচনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে ভারতীয় দূতাবাস আক্রমণের চেষ্টা করা হয়েছে, ঢাকার বাইরে একজন হিন্ধু ধর্মাবলম্বীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশ সরকার চাইলেই তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সামাল দিতে পারতো।
দেশ যখন নির্বাচনের পথে তখন সরকারকে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরো নিবিড় সুসমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে নিবিড় অভিযান চালিয়ে দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।
কিছু অপরিণামদর্শী মানুষ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি করে কিছুতেই স্বস্তিতে থাকতে পারবে না। কূটনৈতিকভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে পালিয়ে থাকা কিছু অর্বাচীন সোশ্যাল মিডিয়া ক্রিমিনাল এবং দেশে থাকা কিছু বেসামাল মানুষের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে মব সন্ত্রাস করলে আখেরে আম ছালা দুটোই হারানোর ভয়।
আশা করি, সরকার সঠিক কাজ সবার সঙ্গে আলাপ করে দ্রুত গ্রহণ করবে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের এখন কোনো বিকল্প নেই।