শঙ্কা ছিল ২৮ অক্টোবর নিয়ে। কী হয় এ উৎকণ্ঠা ছিল সর্বত্র। বাস্তবেও তাই ঘটলো। বাংলাদেশের রাজনীতি ভিন্ন এক পর্বে এখন প্রবাহিত ওই দিনটির মাধ্যমে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বিএনপি বারবার বলছিল, অহিংস এক আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশের বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলটির নেতৃবৃন্দ গতানুগতিক ধারায় সেই মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে কেউ কারাগারে, কেউবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে যে মহাসমাবেশ করতে চেয়েছিল, সেখানে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ঘটলেও সে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। পুলিশের বেঁধে দেওয়া সময়ের (বেলা ২টায়) দেড় ঘণ্টা আগে সমাবেশ শুরু করলেও বিকাল তিনটা নাগাদ মির্জা ফখরুল তড়িঘড়ি করে প্রচন্ড টিয়ারশেলের ঝাঁঝালো ধোঁয়ার মধ্যে বসে সমাবেশ সম্পন্ন না করতে পারা ও সমাবেশে আগত বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পরের দিন ২৯ অক্টোবর সকাল সন্ধ্যা হরতাল আহ্বানের মাধ্যমে সমাবেশের ইতি টানেন।
এরপরের দিন ভোরে মির্জা ফখরুলকে তার গুলশানস্থ বাসা থেকে আটক করে পরবর্তী সময়ে কারাগারে পাঠানো, অন্য নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশের হানা, কোথাও কাঙ্ক্ষিত নেতা না পেলে তাদের পরিবারের অন্য কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া এভাবেই হরতালের দিন পার হয়েছে অনেকটাই অশান্তির মধ্যে। কারণ ২৮ অক্টোবর একজন পুলিশ ও একজন যুবদল কর্মীর মৃত্যু, পরে একজন সাংবাদিকের মৃত্যু ছাড়াও হরতালের দিন আরো দুই জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এরপর হরতাল শেষে সন্ধ্যায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী জুম লাইভে এসে ঘোষণা দেন মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার টানা তিনদিন রাজপথ, রেলপথ ও সড়কপথ অবরোধের। এ রিপোর্ট যখন পাঠকের হাতে তখন ওই কর্মসূচি চলমান।
লাভ কার বিএনপি, না আওয়ামী লীগের
দীর্ঘদিন বিএনপি অহিংস আন্দোলন করে আসছে। ২৮ অক্টোবরও তারা বারবার অহিংস থাকার নির্দেশনা দেয়। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের উসকানি উপেক্ষা করে সমাবেশ শেষ করেই যে যার এলাকায় যেন ফিরে যান এমন লিখিত নির্দেশনাও দেওয়া হয় রুহুল কবীর রিজভীর স্বাক্ষর করা প্রজ্ঞাপনে। কিন্তু বিএনপির সে অহিংস ধারা কী অব্যাহত থাকা গেছে। বিএনপিকে পরিকল্পিতভাবে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে চিরাচরিত বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনের যে রূপ তাতে। অভিযোগ শান্তিপূর্ণ এমন কর্মসূচিতে অতি উৎসাহী পুলিশ ও সরকার সমর্থিত দলের মধ্যে সংঘর্ষের জের থেকে। যদিও তার সূচনা ছিল কাকরাইল মসজিদের কাছাকাছি। সেখানকার ঘটনা কীভাবে মুহূর্তেই পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটলো ও তছনছ হলো সেটা নিয়ে।
বিএনপি এখানে পলিটিক্যালি জয়লাভ করেছে, লাভবান হয়েছে। ২০২৩ সাল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি রয়েছে বাংলাদেশ পানে। বিভিন্নভাবে এমন কর্মসূচি তারা কঠোর মনিটরিং করেছেন। সচিত্র ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছেন। সমাবেশ, মত প্রকাশ এটা গণতান্ত্রিক অধিকার। আবার সন্ত্রাস, সংঘর্ষ করে অশান্তি সৃষ্টি করা আইনসংগত নয়। এখন প্রশ্ন লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে ক’জনের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ ছিল। গণহারে গোটা সমাবেশ পণ্ড করে দেওয়া কী সংবিধান সম্মত? এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হচ্ছে। এ বিষয়টাই মনিটরিংয়ে চলে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
তবে বিএনপি এমন মহাসমাবেশের মাধ্যমে সরকারবিরোধী প্ল্যাটফর্মে সব বিরোধীদলকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের দাবির যৌক্তিকতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। গত ১৫ বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে সরকার বিরোধীদের দমিয়ে রেখেছে সেটার সর্বশেষ ২০২৩ এসেও প্রমাণটাও এখন তাদের (আন্তর্জাতিক মনিটরিং সেলের) হাতে। যা এতোদিন বিএনপিসহ বিরোধীদল বলে আসছিল, সেটা এখন তারা সরাসরি ডকুমেন্টসহ নিজেরাই প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়েছেন। এটা বিএনপিসহ বিরোধীপক্ষের বড় সফলতা।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যুক্তরাজ্য, ইউইসহ তাদের মিত্রদের। এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা ও প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়ে সতর্ক করার পরও তফসিলের প্রাক্কালে ২৮ অক্টোবরের ঘটনা গণতন্ত্রকামী দেশসমূহের কাছে ক্লিয়ার মেসেজ দিতে পেরেছে বিএনপি। যদিও এমন ঘটনার জন্য বিএনপি প্রস্তুত ছিল না, বারবার তারা অহিংস আন্দোলনের কথা বললেও যেভাবে তাদের ওপর চড়াও হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সমাবেশস্থল টিয়ার শেলে আচ্ছন্ন করে সমাবেশ বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেছে সেটা নজিরবিহীন। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহারের পুরোনো যে রূপ সেটাই ভেসে উঠেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও গণতন্ত্র প্রত্যাশী দেশসমূহের কাছে। এটাও বিএনপির বড় সফলতা।
বিএনপির এমন কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা দেখিয়ে শেষ পর্যস্ত মাঠে নেমে আসে জামায়াতে ইসলামীও। তাদের সমর্থক নেতাকর্মী নিয়ে বৃহত্তর সমাবেশ অনুষ্ঠান করে শাপলা চত্বরের অদূরে। এছাড়াও বাম রাজনৈতিক দলসমূহের যে ঐক্যমঞ্চসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহও বিভিন্ন স্থানে আলাদাভাবে ২৮ অক্টোবরে তাদের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে একত্রি করে কর্মসূচি পালন করে। সব মিলিয়ে এতো বিপুল মানুষের উপস্থিতি যার মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়, এটাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারবিরোধী শক্তির প্রদর্শনীটা বিএনপি নেতৃত্ব দিয়ে দারুণভাবে প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছে।
বিএনপি এ সমাবেশ ঘিরে তাদের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীদের মামলার হাজিরার দিন হিসেবেও প্রকাশ করে। ভাষ্য ছিল এমন যে, ঘরে থাকলেও আটক, নির্যাতনের শিকার, তাহলে সমাবেশে যেয়ে উপস্থিত হয়ে যদি আটক হতে হয় তাতে আর কী যায় আসে। এতে করে সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের কঠোর বাধাবিপত্তির ফাঁকফোকর ঘটিয়ে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটানো বিএনপি ও তার মিত্রদের বড় অর্জন। এর মাধ্যমে সরকারি দল যে বক্তব্য প্রচার করে আসছে যে, বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের দাবির সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই তার এক ধরনের জবাবও দেখলো আন্তর্জাতিক বিশ্ব।
ফলে বিএনপি সমাবেশ না করতে পারলেও তাদের যে মেসেজ দেশবাসী থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সেটা ঠিকই তারা দিতে সক্ষম হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গণতান্ত্রিক সম্মেলনে দুইবারই আমন্ত্রণ পায়নি। বারবার মার্কিন প্রশাসন তাড়া দিয়ে আসছে বাংলাদেশে পুরাপুরি গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের প্রাক্কালে যে মেসেজ এখন উন্নয়ন সহযোগী বা দাতাদেশসমূহের কাছে, সেটা আর বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের গলা ফাটিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন পড়বে না। এক ঘটনায় সবকিছুর প্রমাণাদি তারা নিয়ে রেখেছেন।
তবে শঙ্কার বিষয় যে ঘটনার অবতারণা ঘটলো এ ধারা অব্যাহত থাকলে আরো জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে মার্কিন প্রশাসন উভয় পক্ষকে সংযত আচরণ দেখাতে অনুরোধ করেছেন এবং ভিসানীতির আলোকে। এমন ঘটনা চলতে থাকলে ওই নির্দেশনা কঠোরতর পর্যায়েও চলে যেতে পারে।
অনেকেরই প্রশ্ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ কেন? যে দেশে নিজেদের সমস্যা নিজেরা না মিটিয়ে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধন করবে, সেখানে বিশ্বমানবতা তো বসে থাকবে না। তারা সরব হবেই এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তো ঐকমত্য শূন্যের কোঠায়। অথচ একটু সহনশীল হলেই এ ঐকমত্য অসম্ভব কিছু ছিল না।
পরিশেষে
দীর্ঘসময় থেকে যে শঙ্কার কথা জানান দেওয়া হচ্ছিল, সেটাই রূপ নিলো বাস্তবে। সমঝোতা না হলে সংঘাত অনিবার্য, সে সংঘাতের কবলে দেশ। দুই মেরুতে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীপক্ষ। ন্যূনতম অনুকম্পা নেই তাদের ভেতরে। ক্ষমতাসীনরা দীর্ঘ তিন টার্ম ক্ষমতার শেষলগ্নে। এরপর আবারও ক্ষমতায় যেতে পুরোনো রূপেই নিজেদের উপস্থাপন করেছেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পুলিশ বাহিনী ব্যবহার নির্মম অত্যাচার, মামলা হুমকিধমকি এগুলো সুষ্ঠু, গণতন্ত্রেও স্বরূপ নয়। কিন্তু সেটাই চলছে এখন বাংলাদেশে। অথচ নিয়মমাফিক একটি জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ উপনীত। তফসিল ঘোষণার জন্য ঘড়ির কাঁটার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন নির্বাচন কমিশন। তাদের তাড়া, জানুয়ারির মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন সম্পন্ন করার সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার।
এখন নির্বাচন করবেন তিনি কাদের নিয়ে। গলতন্ত্রের পরিভাষায় মানুষ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অংশ নিয়ে পছন্দের প্রার্থী খুঁজে নেবেন। কিন্তু দেশের প্রধান বিরোধীদলসমূহের নেতৃবৃন্দ তফসিল ঘোষণার প্রাক্কালে কেউ কারাগারে কেউ-বা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এ মুহূর্তে। তাহলে সবাইকে নিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচনটা কীভাবে? গণতন্ত্রটা কোথায়-এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের। কাকে ভোট দেবেন। পছন্দের সেই প্রার্থী তাদের কোথায়? ভোট কীভাবে হবে? কে তাদের প্রার্থী? এ জাতীয় প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
সন্দেহ নেই দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ দেশের অনেক কিছুতে উন্নতি করেছেন। মানুষ সেসব ভোগ করছেন। কিন্তু দেশের গণতন্ত্রের উন্নতিতে কতটা ভূমিকা তাদের এ মুহূর্তে সে প্রশ্ন উঠে এসেছে।