সেন্টমার্টিন! বাংলাদেশের যে কেউ এ প্রবাল দ্বীপটির কথা একটু অন্যভাবে শুনলেই আঁতকে ওঠেন। এটা নতুন কিছু না। এখনো বেশ ভালোভাবেই মানুষের মাছে ছড়ানো যে সেন্টমার্টিনে লোলুপ দৃষ্টি অনেকের। অনেক রাজনৈতিক বক্তব্যও রয়েছে এটা নিয়ে। খোদ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকেও একবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এ ভূমি প্রভাবশালী কেউ কেউ ঘাঁটি করার জন্য চায়। এটা তাদের দিলে সমস্যা নেই। সেই সেন্টমার্টিনে যেতে ট্রলার, স্পিডবোটে সীমান্তের ওপার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়, তখন উৎকণ্ঠা বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রকৃত ঘটনা এখনো অনেকেরই আজানা!
তাছাড়া রাজনৈতিক বক্তব্য এটা তো নিত্য ঘটনা। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করছে, বিএনপি সেন্টমার্টিন নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে, আবার বিএনপি বলছে দেশের ভূখণ্ড হুমকির মুখে সরকার, এ ব্যাপারে প্রতিকারের পদক্ষেপ না নিয়ে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।
কখন কী হয়
গত পহেলা জুন দুপুরের পরপর টেকনাফ পৌরসভার নৌকাঘাট থেকে একটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। ওই ট্রলারে নিত্যপ্রয়োজনীয় মালপত্র ও ১০ জন যাত্রী ছিলেন। আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৪টার সময় নাইক্ষ্যংদিয়া খাল এলাকা অতিক্রমের সময় আরাকান আর্মি ওই ট্রলার লক্ষ্য করে ৬-৭ রাউন্ড ভারী অস্ত্রের ফায়ার করে। তবে এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবং ট্রলারটি বিকাল ৫টা ৫৫ মিনিটে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছায়। এতে একটা আতঙ্ক তৈরি হলেও কেউ আর কিছু ঠাহর করতে পারেনি।
পরের ঘটনা ৫ জুন। এদিন সেন্টমার্টিন থেকে ৬টার দিকে মেটাল শার্ক ও কাঠের বোটে মোট ২৭ জন যাত্রী ফিরছিলেন। পথে নাফ নদে এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নাইক্ষ্যংদিয়া চর এলাকা অতিক্রম করার সময় মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং এলাকা থেকে আরাকান আর্মি গুলিবর্ষণ করে। এতে মেটাল শার্কে ২ রাউন্ড এবং কাঠের বোর্ডে ৪ রাউন্ড গুলি লাগে। পরে ওই বোট এবং মেটাল শার্ক দুটি নিরাপদে টেকনাফ কোস্ট গার্ডের বোটপুলে ফিরে আসে। পরেরটা ৮ জুন। ওইদিন দুপুরের দিকে নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদের মোহনায় দুটি কাঠের ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা দেয়। টেকনাফ পৌরসভার কাউকখালী ঘাট থেকে সিমেন্ট, রড ও ছয়জন যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাওয়ার পথে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার থেকে আরাকান আর্মি আনুমানিক ১৫-২০ রাউন্ড গুলি চালায়। পরে ট্রলার দুটি ১২টা ২৫ মিনিটের দিকে শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে ফিরে আসে। এতে একটি ট্রলারে ৭ রাউন্ড গুলি আঘাত হানে। এ ঘটনায়ও কেউ হতাহত হননি।
একের পর এক এমন ঘটনা চলার অব্যাহত রেখে ১১ জুন বেলা ১১টার দিকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের গোলারচরের বিপরীতে মায়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদের মোহনা হয়ে একটি স্পিডবোটে সেন্টমার্টিনের পাঁচজন স্থানীয় বাঙালি শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে সেন্টমার্টিনে যাচ্ছিলেন। পথে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং বিজিপি ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার এলাকা থেকে আরাকান আর্মি স্পিডবোট লক্ষ্য করে আনুমানিক ৪-৫ রাউন্ড গুলি করে। এতে স্পিডবোটে অবস্থানরত বাঙালিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। যদিও কেউ হতাহত হননি। পরে বেলা ১১টার দিকে স্পিডবোটটি সেন্টমার্টিনে পৌঁছে।
পরপর এমন ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে এ রুটে চলাচলকারীদের মধ্যে। এসব গুলিবর্ষণের ঘটনার কারণে বেশ কিছুদিন টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সরবরাহ ব্যাহত হয়। সেন্টমার্টিনে খাদ্যসংকট পর্যন্ত দেখা যায়। সবশেষ বার আউলিয়া নামক এ রুটে যাত্রী পরিবহনকারী একটি শিপ দিয়ে অনেক খাদ্য সেন্টমার্টিনে পৌঁয়ে সেখানকার খাদ্যসংকট দূর করে সরকার।
এর আগে সেন্টমার্টিনের অদূরে মায়ানমার নৌবাহিনীর যান নোঙর করা দেখতে পেয়ে মানুষ আরো বেশি আতঙ্কিত হয়। সেটা আবার ক’দিন পর উধাও হয়ে যায়। বর্তমানে সেন্টামার্টিনে বাংলাদেশের কোস্ট গার্ড পাহারা দিচ্ছে, টহল দিচ্ছে। মানুষের দুশ্চিন্তা লাঘব হয় এতে।
কেন এমনটা ঘটলো
জানা গেছে, আনুমানিক এক দশক পূর্বে সেন্টমার্টিন দ্বীপসংলগ্ন স্থানে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে দুটি স্থানে বালুচর জেগে ওঠে। এই দুটি বালুচরের কারণে ভাটার সময়ে সেন্টমার্টিনে চলাচল করা যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানগুলো সাগরের ভেতর মায়ানমারের একটি অংশ ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
মায়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সঙ্গে বাংলাদেশের বিজিবির সমন্বয়ের কারণে এই চলাচলে ইতিপূর্বে কখনোই কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। সাম্প্রতিক অতীতে আরাকান আর্মি মায়ানমারের এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার কারণে সৃষ্ট সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনগামী ট্রলার ও নৌযানগুলোকে লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি গুলি ছুড়ছে। ফলে কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিক ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল সাময়িক স্থগিত করার কারণে সেন্টমার্টিনে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে এবং বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
বর্ণিত চর দুটি ড্রেজিং করা হলে মায়ানমারের জলসীমা আর ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। তবে এ ঘটনায় মায়ানমার জান্তা নিয়ন্ত্রিত নৌবাহিনীর যান এসেছিল পরিস্থিতি অবজার্ভ করতে বা বড় কোনো কিছু ঘটে না যায়, সম্ভবত সে কারণেই। কেননা মায়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী, তাদের তারা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। ফলে এমন ঘটনার দায়ভার মায়ানমারের জান্তা সরকারও এড়াতে পারে না।
এ ব্যাপারে তৃতীয় কোনো দেশ জড়িত নয় বলেই প্রতীয়মান হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার বিষয়টা সুন্দর সমাধানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শান্তি বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে এবং এতে মোটামুটি সফলতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার শেল পড়ার ঘটনাও রয়েছে। সে দেশের সরকারি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে এসেছে শত শত। সেগুলোও ফেরত দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সব সময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ৮ হাজার ৪৯২ জন বাসিন্দা বসবাস করে।