০৬ জুলাই ২০১২, শনিবার, ১০:১১:২০ পূর্বাহ্ন


দেশকে সুষমা সরকার
ভিউ আসলে শিল্পের মানদণ্ড হতে পারে না
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৭-২০২৪
ভিউ আসলে শিল্পের মানদণ্ড হতে পারে না সুষমা সরকার


সুষমা সরকার। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের একজন পরিশীলিত অভিনেত্রী। সবসময় একটু ভিন্ন পথেই এগিয়েছেন। তাই মঞ্চ, টেলিভিশন, ওয়েব কন্টেন্ট কিংবা চলচ্চিত্র- সবগুলো মাধ্যমেই তার অভিনয়, প্রশংসিত হয়েছে বহুবার। একইভাবে বিজ্ঞাপনেও সফল তিনি। তার এখন ব্যস্ততা মঞ্চ নাটক ‘পারো’ নিয়ে। এ সম্পর্কে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির 

প্রশ্ন: শোবিজ অঙ্গনে আপনার শুরুর গল্পটা বলবেন?

সুষমা সরকার: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগে পড়ার কারণে শোবিজের সঙ্গে যোগাযোগটা ঠিক কখন শুরু হয়েছে বলতে পারবো না। তবে জাহাঙ্গীর নগরে আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে দেশের নন্দিত নাট্যকার ও নির্দেশক মাসুম রেজার সঙ্গে। তারই উৎসাহে মঞ্চে যুক্ত হওয়া, দেশ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথম মঞ্চে উঠেছিলাম ‘জনমে জন্মান্তর’ নাটকে। ছোটপর্দায় যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘সাদা মেঘের বৃষ্টি’ ধারাবাহিক নাটক দিয়ে।

প্রশ্ন: এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আপনার কোনো অতৃপ্তি আছে?

সুষমা সরকার: আমার একটি ক্ষোভ আছে, যেটা অনেক সময় নিজের কাছেও বলি। আমরা যারা অভিনয় করি, ডিরেক্টর বা স্ক্রিপ্ট রাইটার, আমরাই তো দর্শক তৈরি করি। অনেকে বলেন যে, এটা খাচ্ছে বেশি। না, আসলে কী খাওয়াচ্ছেন আপনি। বাজারে যদি আলুই না পাওয়া যায়, শুধু বেগুনই পাওয়া যায়। তাহলে তো তারা বেগুনই খাবে। আপনি আলু দেন, তখন দেখবেন তারা আলুই খাবে, কিংবা পোলাও দেন সেটাই খাবে। তাই দর্শক রুচি তৈরি করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। সেখানে আসলে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি।

প্রশ্ন: কিন্তু নির্মাতারা বলেন জনপ্রিয় করার জন্য কোয়ালিটির বিষয়ে অনেক ছাড় দিতে হয়। আপনি কি এরসঙ্গে একমত? 

সুষমা সরকার: না। জনপ্রিয়তা বলি আর ভিউ যেটাই বলি, সেটা আসলে কোনো শিল্পের মানদণ্ড হতে পারে না। এমন অনেক নাটক বা ছবি আছে, যেটার ভিউ হয় নি, অনেক দর্শকের কাছে পৌঁছাতেই পারেনি। তার মানে তো এই না যে সেই নাটক বা ছবিটি খারাপ। আমরা যদি গুণগত মান চিন্তা করি, তাহলে সেটা কোনোভাবেই ভিউ দিয়ে চিন্তা করা যাবে না। আর আমরা ভালোবেসে অভিনয় করি, কাজ করি। তাই অবশ্যই আমরা চাই বেশি দর্শক আমাদের নাটক দেখুক। বর্তমানে একটা মোবাইল ফোনে শুধু টিকটক করে অনেকে জনপ্রিয়তা পেয়ে যাচ্ছেন, রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সময় আসলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই জায়গায় আসতে হয়েছে। আমি যখন মঞ্চে কাজ করেছি, তখন শুরুতেই কিন্তু ভাইটাল ক্যারেক্টার পাইনি। আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বছরের পর বছর থিয়েটার করতে হয়েছে। এই জায়গাটা বুঝতে হয়েছে। তারপরে ভাইটাল চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।

প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এবার ভিন্নভাবে মঞ্চে আপনি। ‘পারো’ নামের এই নাটকে কি আপনাকে চাপে ফেলেছে?

সুষমা সরকার: একটু প্রেশার তো আছেই। যেহেতু মঞ্চে একক অভিনয় করিনি আগে। এক ঘণ্টার বেশি সময়ের এ প্রযোজনায় ৭টি চরিত্র করতে হয় একই সঙ্গে। সাতটি চরিত্র সাত রকম করে করতে পারার একটি বিষয় আছে। সব মিলিয়ে ডেফিনেটলি এক্সাইটেড। আবার একটু নার্ভাসও। সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে আমার মধ্যে।

প্রশ্ন: এই নাটকের গল্প কী নিয়ে?

সুষমা সরকার: নারীর ভেতর ও বাইরের যে দ্বন্দ্ব, সেটাই পারো নাটকে বেশি করে এসেছে। মানুষের তো আসলে দুটি সত্তা থাকে- একটা ভেতরের, আরেকটা বাইরের। ভেতরের সত্তা তাকে সমাজের নানা নিয়মকানুনের মধ্যে বেঁধে রাখে। কিন্তু বাইরের যে ব্যক্তিমানুষটা, তার হয়তো অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে। সে সমাজের বাধাগুলো ভাঙতে চায়। প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু তার ভেতরই তাকে প্রতিবাদ করতে দেয় না। এ ধরনের দ্বন্দ্ব সবার মধ্যে চলতে থাকে। পুরুষশাসিত সমাজে একটা নারী ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠতে উঠতে শারীরিক ও মানসিক- নানাভাবে নির্যাতিত হয়। কিন্তু সে সব সময় তার প্রতিবাদটি করতে পারে না। নাটকটি দেখতে গিয়ে প্রত্যেক নারী কোথাও না কোথাও নিজেকে খুঁজে পাবেন।

প্রশ্ন: এই দীর্ঘ সময়ে অভিনেত্রী হিসেবে তো অবশ্যই সমৃদ্ধ হয়েছেন। ব্যক্তি হিসেবে কতটা সমৃদ্ধ হলেন?

সুষমা সরকার: অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমাকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে নাট্যতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা। অনেক বিষয় জেনেছি, টেকনিক্যাল সাইড, মেথড সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু দলে এসে যেটা হয়েছে, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার, ডিসিপ্লিন, পারস্পরিক সম্মানবোধ, কাকে কী বলা যাবে বা যাবে না-নানা ধরনের সামাজিকতার বিষয়গুলো আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। থিয়েটার তো একটা পরিবারের মতো। এই যে এত মানুষের সঙ্গে এত বছর ধরে জার্নি করা, সুখ-দুঃখে একসঙ্গে চলা; এটা তো নিশ্চয়ই অন্য রকম অভিজ্ঞতা।

প্রশ্ন: মঞ্চনাটকের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন মনে হয় আপনার কাছে?

সুষমা সরকার: মঞ্চে অনেক ধরনের কাজ হচ্ছে। দর্শকও বেড়েছে। কিন্তু নতুন দর্শক কি বেড়েছে? যাঁরা সব সময় মঞ্চনাটক দেখেন, তাঁরাই কিন্তু ঘুরেফিরে আসছেন। নতুন দর্শক তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। নতুন দর্শক তৈরি করা বা নতুন দর্শক যুক্ত হওয়া; সেই জায়গাটায় আমরা টাচ করতে পেরেছি কি না আমি জানি না। এখন ডিজিটাল যুগ, সবার হাতে মোবাইল, বিনোদনের অনেক পথ এখন দর্শকের সামনে খোলা। কিন্তু থিয়েটার দেখে বিনোদিত হওয়ার মতো মানুষের সংখ্যা আসলে কতটা? একজন দর্শক থিয়েটার দেখতে কেন যাবে বা ওই সময়টা সে কেন ব্যয় করবে? থিয়েটার চর্চার ধরন বা প্রেজেন্টেশনটা কি আগের মতোই থাকবে? এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তরুণদের নিয়েও ভাবতে হবে। তারা কী ধরনের কাজ দেখতে পছন্দ করে বা আমাদের কাজটিই এমনভাবে প্রেজেন্ট করা যায় কি না, যেটা দেখার জন্য তারা আগ্রহী হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার দরকার আছে।

প্রশ্ন: মঞ্চনাটকে আর্কাইভ নেই বললেই চলে। ভিডিও আকারে নাট্য প্রযোজনা সংরক্ষণ কতটা জরুরি?

সুষমা সরকার: আমার কাছে মনে হয়, আর্কাইভ থাকা উচিত। চ্যানেল আইয়ের আইস্ক্রিন মঞ্চনাটকের প্রচার শুরু করেছে। যদিও মঞ্চনাটক টেলিভিশনের মতো শুটিং করে দেখানো হলে আসল মঞ্চনাটকের স্বাদ পাওয়া যায় না। তবু নাটকের সঙ্গে যুুক্ত মানুষদের জন্য এই আর্কাইভের দরকার আছে। আমি হয়তো আলী যাকেরের প্রোডাকশন দেখতে চাইছি বা সেই সময়ে আসাদুজ্জামান নূর ভাই কেমন অভিনয় করতেন; সেই প্রোডাকশনটা আমি দেখতে চাইছি। কিন্তু সেটার কোনো সুযোগ নেই। এটার জন্য আমার মনে হয়, প্রতিটা দলেরই একটা নিজস্ব আর্কাইভ থাকা উচিত। এটা খুব কঠিন কিছু না। কিন্তু এটার ক্ষেত্রে কেন গড়িমসি করা হয় আমি জানি না।

শেয়ার করুন