সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সপ্তাহ তিনেকের মতো। যে বৈষম্য ও সংস্কারের জন্য ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে সে রক্ত এখনো বহমান। মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করছে অনেকেই। হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে আহতরা। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হচ্ছে আকাশ-বাতাস। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের কবরের পাশে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাবা-মা-স্বজনরা বিলাপরত। রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করার সাথীরা এখনো রাজপথেই। চারদিক থেকে প্রতিবিপ্লবের খবর আসছে তাদের কানে। এখনো প্রতিহত করতে ছুটে যান তারা, করছেন। রাষ্ট্রকে সেভ করেই চলছেন। এরই মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ ও স্মরণকালের বন্যা। এই ছাত্রসমাজ বন্যাকবলিতদের উদ্ধার, ত্রাণ সংগ্রহ, বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যেও ২৫ আগস্ট রাতে সচিবালয় ঘেরাও করে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা ছিল প্রশিক্ষিত আনসার বাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য। তাদেরও প্রতিহত করতে ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণ রেখে ছুটতে হয়েছে ছাত্র-জনতাকে। প্রচণ্ড মারও খেয়েছেন ছাত্ররা। ঢাকায় নিত্যনতুন আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এমন সব সংগঠন এসে আন্দোলন করে ঢাকার স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত করছে, যাদের আগে কখনো দেখা যায়নি। শাহবাগে রিকশা-শ্রমিকরা রিকশা নিয়ে এসে আন্দোলন করে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে আল্টিমেটাম। স্বাধীন দেশের নাগরিক। আন্দোলন করা, দাবি-দাওয়া আদায় করার জন্য রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার অধিকার সবারই আছে। সে নাগরিক অধিকার যেন সবাই ভোগ করছেন!
দেশের এমন চিত্র যখন বিরাজমান, সে সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে কবে নির্বাচন হবে বা উপদেষ্টা পরিষদের রোডম্যাপ কী, সেটা জানতে চেয়েছেন। এভাবে আরো অনেকেরই এমন জিজ্ঞাসা।
ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে বলার চেষ্টা করছেন, কবে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন? এসবের আলোকে ২৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গণঅভ্যুত্থানসহ যাবতীয় বিষয় ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, করণীয় ও বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে জাতির উদ্দেশে প্রথমবারের জন্য ভাষণ দিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘ বক্তব্যে উঠে এসেছে অনেক বিষয়, যার একটি ছিল কবে তারা বিদায় নেবেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, সেটাকে তিন পার্টে ভাগ করা যায়।
পার্ট ওয়ান : (নিজ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু করবে না)
সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তোলা হবে না, এমন নিশ্চয়তা প্রদানের কথা উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলবো না। যে ক’দিন আছি সময়টুকু উপদেষ্টাম-লীর প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্যমতো দেশের এ সংকটকালে, সংকট উত্তরণে নিজ নিজ মেধা সাধ্যমতো কাজে লাগাতে চায়।’
পার্ট টু : (জনগণের সিদ্ধান্ত)
নির্বাচন কখন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাবো, যাতে হঠাৎ করে আমরা কখন যাবো এ প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাবো।’
পার্ট থ্রি : (সতর্কতা)
তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি, এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাবো।
পার্ট ওয়ানে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস বলেছেন, ‘আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলবো না’-তাহলে কী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দেবেন অন্তর্বর্তী সরকার? না প্রেক্ষাপটটা অমন নয়। দীর্ঘ ১৬ বছরে এক স্বৈরাচার সরকার যেসব অপকর্ম করেছেন, যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, রাষ্ট্রের যে কাঠামোগুলো (নির্বাচনব্যবস্থাসহ) ভেঙে চুরমার সেগুলোর সুষ্ট তদন্ত দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে বিচার করাসহ সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার করার যে চ্যালেঞ্জ ছাত্র-জনতা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তুলে দিয়েছে, সেগুলো করতে সময়ের প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা বলছেনও। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে এ প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে কত দিন লাগবে সেটা কারো জানা নেই।
ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে বিএনপিও বলেছে, এসব সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দেবে তারা। সে সময় কত দিন এটা যেমন এখনো নিরূপণ করা সম্ভবপর হয়নি, তেমনি এতো দ্রুত এটা বলাও যায় না। যদিও এ নিয়ে লোকমুখে বহু কথা-কেউ বলছেন অন্তত তিন বছর, কেউ পাঁচ, কেউ ১০ অনেক জনে অনেক মত। তবে এটা ঠিক একটা দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনতে, বিশেষ করে যেখানে দীর্ঘ ১৬ বছর একটা স্বৈরাচারতন্ত্র কাজ করেছে, সে অবস্থা থেকে সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে আনা একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে অসম্ভব। ফলে এটা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষেই সম্ভব যদি তারা মনে করেন। আর এটাও ঠিক দেশে একটি সুষ্ঠু ধারায় উন্নতি করতে হলে রাজনৈতিক দলের শাসনব্যবস্থার বিকল্প নেই। এ দুইয়ের বিবেচনাতে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। অন্তর্বর্তী সরকার কী ৯০, না ততোধিক সময়ের জন্য। ততোধিক তো অবশ্যই, তবে সেটা কত দিনের? স্বল্প-না দীর্ঘ মেয়াদে। স্বল্পের সংজ্ঞা কি, আর দীর্ঘ সেটার সংজ্ঞাও-বা কি?
সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমান সংবিধানে নেই। ফলে সংবিধানে না থাকার পরও তেমন একটা প্রক্রিয়া যখন চলছে তার ব্যাখ্যা সাধারণ জনগণ। সংবিধান যেমন সাধারণ জনগণের জন্য, একটা স্বৈরাচার সরকারকে উৎখাত করে, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার বসিয়েছে জনগণ। ফলে এখানে সংবিধান সাংঘর্ষিক নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আর এমন প্রেক্ষাপটে এ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদও কিন্তু কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধ কিছু নয়। এজন্যই প্রফেসর ইউনূস বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই কথাটা বলেছেন যে, দেশবাসী ঠিক করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের এ পর্বের দ্বিতীয় পার্টে বলেছেন, ‘দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি।’ একজন যোগ্য উপদেষ্টার এটাই সঠিক বক্তব্য যে, আমরা রাজনীতি বা জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আসিনি। আমাদের এটা দায়িত্ব দিয়েছে ছাত্র-জনতা, যারা দেশের আপামর মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে স্বৈরাচার সরকারকে উৎখাত কওে, সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে এ অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন থাকবে, সেটা ছাত্র-জনতা, তথা দেশবাসী ঠিক করবেন।
এখানে যে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছেন দেশবাসীর কাছে, এটা একটি ম্যাসেজ। আপনারা চাইলে সরে যাবো, আপনারা চাইলে থাকবো। তাহলে এজন্য তো সাধারণ জনগণের ম্যান্ডেট প্রয়োজন। এটা যেহেতু একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাই এজন্য ছাত্র-জনতা যদি মনে করে যে, হ্যাঁ আপামর সাধারণ মানুষ যে ম্যান্ডেট দেবে, সেটাই হবে। তাহলে একটা গণভোট অনুষ্ঠিত হলে হতেও পারে। যেখানে ‘না’, ‘হ্যাঁ’। মানে বৈষম্য দূর করে রাষ্ট্র সংস্কারে জনগণ একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে এ সরকারকে ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’ দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতাপ্রদান করতে পারে। এর সাংবিধানিক কোনো বিধিনিষেধ আছে কি না-এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনা না করলেও যে প্রক্রিয়ায় সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান না থাকা সত্ত্বেও সেটা এখন যখন বিদ্যমান, সে প্রক্রিয়ায় অমন গণভোট হলে হতেও পারে!
পার্ট থ্রিতে প্রধান উপদেষ্টা ভীষণভাবে সতর্ক করেছেন দেশবাসীকে। যে ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি-এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে, আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাবো।’
যে শঙ্কা সাধারণ মানুষেরও। সাধারণ মানুষ বলতে শুরু করেছেন, বাংলাদেশে আর কখনো যেন কোনো স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারে। তবে ওয়ান-ইলেভেনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালিয়েছেন ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনরা সেটাতেও মানুষের সাপোর্ট প্রথমে থাকলেও শেষতক সাপোর্ট ছিল না। কারণ তারা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই এসেছিল, যা ছিল স্পষ্ট ‘মাইনাস টু ফরমুলা’ নিয়ে। রাজনীতি থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে শীর্ষ দুই নেতাকে সরিয়ে দিতে। আপাতদৃষ্টিতে সেটা থাকলেও অভ্যন্তরে ছিল বিএনপি নিধন, যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রমাণিত। সে প্রতিষ্ঠা এমনভাবেই চেপে বসেছিল, যাতে রূপ নেয় এক স্বৈরশাসকের, যা হটাতে হাজার হাজার মানুষ তাজা রক্ত দিলেন কদিন আগে। ফলে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীলনকশার কথা মনে করে মানুষ এখনো ভীত হয়ে যায়। প্রফেসর ইউনূসের ওপর মানুষের অগাধ আস্থা অমন কিছুতে সায় দেবেন না বা করবেন না। সাধারণ মানুষ অভিন্নভাবে বলছেন, এ দেশের অর্থনীতি, গণতন্ত্র প্রক্রিয়া এমন একটা ধারায় ফিরিয়ে আনা হোক, যেখানে মানুষ যেন শাসক কর্তৃক নিপীড়িত না হন।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের দুই রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা চেয়েছিলাম অন্তর্বর্তী সরকারের একটা রোডম্যাপ। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে সেটা তিনি না পেয়ে হতাশ। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে তার (প্রধান উপদেষ্টার) বক্তব্যে একধরনের ধোঁয়াশা অনুভূত হয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াত ইসলামীর আমির ড. শফিকুর রহমান প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং তার বক্তব্যে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে বলে জানান দিয়েছেন।
অবশ্য দুটি দলই অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সময় দিতে ইতিমধ্যে নিজেদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
জনগণের অর্থে ট্যাক্সে সরকার পরিচালিত। ফলে সরকার যেন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। আর এ ব্যাপারে দেশের আপামর মানুষের প্রয়োজন হবে ঐক্য। কারণ দেশের উন্নয়ন প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জসহ বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের চ্যালেঞ্জটা বড়।
বলার অপেক্ষা রাখে না এটা কার হাতে নিরাপদ, সেটা ভাবার সময় এখন।