বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে আলোকিত, সবচেরে বেশি সময় ধরে বিশ্বমঞ্চে শীর্ষ চৌকস ক্রিকেটার হিসেবে মর্যাদার আসনে আসীন এবং একই সঙ্গে মাঠের ভেতরে এবং বাইরে আচরণের কারণে বিতর্কিত, কলঙ্কিত সাকিব আল হাসান ক্রিকেটের দীর্ঘতম এবং সংক্ষিপ্ততম আসর থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। ভারতের কানপুরে অনুষ্ঠানরত বাংলাদেশ-ভারত চলতি টেস্ট বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের হয়ে সাকিবের শেষ টেস্ট। সাকিবের ঘোষণা অনুযায়ী, ঢাকায় স্মৃতিময় শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিতব্য টেস্ট ক্রিকেটের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র সাকিবের বিদায়ী আসর হওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন।
সাকিব ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ওই জনপ্রতিনিধি সম্পৃক্ততার জন্য পতিত সরকারের দোসর হিসেবে সাকিবের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করা হয়েছে। সম্প্রতি শেয়ার মার্কেট কারসাজি নিয়ে অর্থদ- দেওয়া হয়েছে। সাকিব বাংলাদেশে আসা, খেলা এবং বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে বিদেশে যাওয়া বিষয়ে ঝামেলামুক্ত থাকার নিশ্চয়তা চেয়েছেন। বিসিবি বিষয়টি তাদের আওতার বাইরে বিবেচনা করে এ বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেছে। সরকার পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য প্রদান করা হয়নি। এমতাবস্থায় কানপুর টেস্ট বাংলাদেশের হয়ে সাকিবের শেষ টেস্ট ম্যাচ হতে পারে। গত বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরে সাকিব শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছে।
চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার থাকা অবস্থায় সাকিবের হঠাৎ করে রাজনীতিতে যোগদান এবং শাসক দলের হয়ে বিতর্কিত জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় থেকেই বাংলাদেশে ওর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। তদুপরি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সাকিবের নীরবতা বৃহত্তর সাকিবভক্তসহ সাধারণ জনতাদের আহত করেছে। নানা কারণে মাঠের বাইরে সাকিবের নানা কর্মকা- বিভিন্ন সময়ে বিসিবিকেও বিব্রত করেছে। বেশ কয়েকবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে সাকিব সাময়িক বহিষ্কারসহ অর্থদ- পেয়েছে বিসিবি-এমনকি আইসিসি থেকেও। কিন্তু প্রতিবার দ-ের মেয়াদ শেষে পারফরম্যান্স দিয়ে দারুণভাবে ফিরেছে সাকিব। দেশের মাটিতে খেলা একটি সিরিজ চলাকালে তামিমের অবাক করা নাটকীয় অবসর ঘোষণা ঘিরে সাকিব তামিমের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই নানা গুজব প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ডালপালা মেলতে থাকে। সাকিবের বেপরোয়া মনোভাব। নানা কারণে খেলা চলাকালে আসর ছেড়ে এসে বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ, কাউকে না মানার মতো উগ্রতা সত্ত্বেও দলে পারফরম্যান্স দিয়ে একের ভেতর তিন হওয়ায় দলে স্থান নির্ধারিত থাকে। কিন্তু সম্প্রতি মাঠের বাইরের নানা ঘটনার প্রভাবে সাকিব সাকিবময় করতে পারছে না কোনো ক্রিকেট আসর। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং সবক্ষেত্রেই পতনের আওয়াজ অনুভব করা যাচ্ছে। হয়তো ক্রিকেট থেকেই মনোসংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। তাই মনে হয় নিজে থেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাকিব।
দুনিয়ায় কেউ চিরদিন কোনো কিছুর জন্য অপরিহার্য থাকে না। সবাইকেই একসময় সরে যেতে হয়। ক্রিকেটেও অনেক রথী মহারথী ফর্মের শীর্ষে থাকা অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেছে। সাকিব ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। নিজ দলের পাশাপাশি বিশ্বের সব দেশের ফ্রাঞ্চাইজি আসরে খেলে বিশ্বক্রিকেটে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেছে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চৌকস ক্রিকেটার হিসেবে সাকিবের নাম স্যার গারফিল্ড সোবার্স, জ্যাক কালিস, স্যার ইয়ান বোথাম, ইমরান খান, কপিল দেব, স্যার রিচার্ড হ্যাডলির কুলিন ক্লাবে আলোচিত হতে থাকবে। বেশ কিছু রেকর্ড দীর্ঘদিন অম্লান থাকবে। এখনো সাকিব হয়তো আরো দুই বছর শীর্ষ পর্যায়ে খেলতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান পরিবেশ এবং পরিস্থিতি সাকিবের অনুকূলে নেই বলাই বাহুল্য। এর কারণটাও কারো অজানা নয়।
আইন সবার জন্য সমান এবং নিজস্ব গতিতে চলে। আমি নিজেও মাঠের বাইরে সাকিবের আচরণের কঠোর সমালোচনা করেছি। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে অবদানের জন্য সাকিবকে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টেস্ট খেলে ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ দেওয়া উচিত। আর সাকিবের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগটিও রাজনৈতিক মামলা। সাকিব এখনো প্রমাণিত দোষী বলে বিবেচিত হননি। একজন চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার কোনো মামলায় দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিসিবির উচিত তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।