ফেরদৌস আরা। দেশের জনপ্রিয় নজরুল সংগীতশিল্পী। ক্যারিয়ারে অসংখ্য গান উপহার দিয়েছেন তিনি। তবে হঠাৎ করেই ১৫ বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারে পারফর্ম করতে নিষিদ্ধ হন তিনি। এমনকি কালো তালিকায় নাম থাকায় কোনো অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে পারেননি এই গায়িকা। এ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: উইকিপিডিয়াতে আপনার জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কিস্তু গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা নেই। এই বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করবেন?
ফেরদৌস আরা: এরকম প্রশ্ন উঠার মূল কারণ হলো আমার বাবার সরকারি চাকরি। ওনার চাকরির সূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। তাই আমার গ্রামের বাড়ি নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়েন। আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালি। তবে আমার জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আর এখানে জন্ম নিয়ে আমি অনেক গর্ববোধ করি। কারণ আমাদের এ উপমহাদেশের গুণীশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’রও জন্ম এখানে। আমার বাবা (এ এ কে এম আব্দুল হাই) এর চাকরি সূত্রে আমার ব্রাহ্মণাবড়িয়ায় জন্ম। বাবাও সুশিল্পী ছিলেন। উচ্চাঙ্গসংগীত বিশারদ ছিলেন। তবে বাবা অনেক বড় মাপের প্রকৌশলী ছিলেন। তাই বাবার চাকরি সূত্রে আমি ময়মনসিংহ, রাজশাহী , চট্টগ্রাম ও সবশেষে ঢাকায় থেকেছি।
প্রশ্ন: গানের সাথে আপনার সখ্যতা তৈরি কিভাবে?
ফেরদৌস আরা: আমি তখন চট্টগ্রামে। প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। সেসময় গান শেখার জন্য আমার বড় তিন বোন সংগীত পরিষদে যেতেন। তারা গান করতে গেলেও আমি যেতাম খেলতে। কিন্তু খেলাটাকে পণ্ড করে আমি একমনে জানালার গ্রিল ধরে তাদের নাচ দেখতাম ও গান শুনতাম। খেলার ছলে কি প্রচণ্ড একটা আকর্ষণ বা টানে আমি সেসময় এটা করতাম , সেটা এখন বুঝি। এরপর আরও দিন কেটে গেল। আস্তে আস্তে গান শেখা শুরু হল। ওস্তাদরা যা যা গান শেখাতেন সব মুখস্থ করে ফেলতাম। তাছাড়া স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম হতাম। এরপর চলে আসলাম রাজশাহী। আমার কিশোরী কাল, সবচেয়ে সুন্দর সময়। রাজশাহীর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অসম্ভব সংগীতের পরিবেশ আমাকে আজও মুগ্ধ করে। আমরা বড় আপুদের সহযোগিতায় আমি নানারকম খেলাধুলা, নাচ ও গানে অংশগ্রহণ করতাম। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম হতাম। আমি অনেক দুষ্টু ছিলাম এজন্য আপুরা গান শিখতেন। আর আমাকে বেশির ভাগ সময়ই নাচে ব্যস্ত রাখতেন। আর নাচে আমি কখনই দ্বিতীয় হইনি। এভাবেই বড় হওয়া।
প্রশ্ন: তারপর আপনার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের কথা সবারই জানা। কিন্তু দীর্ঘদিন আপনি বিটিবি এবং বাংলাদেশ বেতারে নিষিদ্ধ ছিলেন। এর কারণ কি?
ফেরদৌস আরা: একসময় বিটিভি ও বেতারে নিয়মিত গাইতাম। হঠাৎ করেই আমাকে ডাকা বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম প্রথম ভাবতাম, নতুন শিল্পীরা আসছে, তাদেরও সুযোগ দিতে হবে। আমাকেও হয়তো ডাকা হবে। কিন্তু আমাকে ডাকে না। অনুষ্ঠানে নাম থাকলেও শেষ পর্যন্ত কেটে দেওয়া হয়। একদিন বিটিভির প্রধানকে বললাম, ‘আমাকে নিতে হবে না। শুধু জানতে চাই, কে আমাকে ডাকতে নিষেধ করেছে, আর কারণটা কী?’ তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনাকে কেন বাদ দেওয়া হবে?’ তিনি বিষয়টা এড়িয়ে যান। একসময় জানতে পারি, নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ আমি নই, আমার স্বামী। আমার স্বামী ড. রফিকুল মোহামেদ কোনো এক সময়ে কোনো জেলার ডিসি ছিলেন। তাই মনে করা হতো, তিনি বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সরকারি চাকরি করে তিনি যদি কোনো অন্যায় করেন, তাহলে সে শাস্তি তিনি পাবেন। শিল্পীকে কেন শাস্তি দেওয়া হলো।
প্রশ্ন: সরকারি অনুষ্ঠান থেকেও নাকি আপনার নাম কেটে দেওয়া হয়েছিল?
ফেরদৌস আরা: বাংলাদেশ থেকে সাংস্কৃতিক দল প্যারিসে যাবে অনুষ্ঠান করতে। আমাকে জানানো হলো, আমার নাম আছে। প্যারিসের রাষ্ট্রদূত ও তাঁর স্ত্রীও আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আপনাকে কিন্তু আসতে হবে।’ পুরো প্রস্তুতি নেওয়ার পর দেখি, আমার কাছে আর ফোন আসে না। পরে আমাকে জানানো হয়, আপনার নাম কাটা গেছে। দৃবাইয়ে এক সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে বলার দুদিন পর আমাকে জানানো হলো, অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে। পরে দেখি অনেকেই সেই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে এসেছে। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে।
প্রশ্ন: শিল্পকলায়ও আপনার যাতায়াত অনেক কম ছিল। এর কারণ কি?
ফেরদৌস আরা: শিল্পকলা নিয়েও বাজে অভিজ্ঞতা আছে আমার। অনেক বছর আগে আর্মি স্টেডিয়ামে শিল্পকলার একটি অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অনুষ্ঠানের আগের দিন রিহার্সালের সময় দেখি, শিল্পকলার শীর্ষস্থানীয়রা তাদের কাছের মানুষদের প্রথম সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমাকে আর আবিদা সুলতানাকে দিলেন ১০০ জনের পেছনে এক কোনায়। পরের দিন আমি শিল্পকলার প্রধান ও তাঁর সঙ্গীদের হাসতে হাসতে বললাম, ‘মাঝখানে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা কারা? এত দিন আমরা কি তাহলে ঘাস কাটলাম?’ এরপর আমাকে তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলেন। তাঁদের ব্যবহারে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সেই অবস্থায় সোহরাব নামের একজন আমার চোখের সামনে আঙুল তাক করে চিৎকার করে বলে, ‘অত বড় চোখ দিয়ে আমাকে খেয়ে ফেলবেন নাকি?’ এমন অবস্থায় (রেজওয়ানা চৌধুরী) বন্যা আপার একজন শিক্ষার্থী এসে বলে, ‘ভেরি গুড, একদম উচিত শিক্ষা দিয়েছেন।’ সেদিন আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। এরপর আমাকে বলে, ‘চলে যান।’ কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, প্রোগ্রাম শেষ করে না গেলে আমার আরও ক্ষতি হতে পারে। আমাকে উল্টো দোষ দেওয়া হবে। তাই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শেষ সারিতে কোনায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গানে ঠোঁট মেলালাম। এর পর থেকে আর কোনো দিন শিল্পকলার পথে পা দিইনি। আমাকেও কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনার বিটিভি ও বেতারে গান গাওয়া নিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। কতদিন পরে এই গান গাওয়া?
ফেরদৌস আরা: দীর্ঘ ১৫ বছর পর আবার বিটিভি ও বেতারে গাইলাম। শিল্পী তৈরিতে এ প্রতিষ্ঠান দুটির ভূমিকা অনেক। আমাদের সংগীতের আঁতুড়ঘর বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার। এখানে অনুষ্ঠান করেই আমাদের পরিচিতি এসেছে। এখানে আবার গাইতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে।
প্রশ্ন: জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রাধান্য পায় কোন বিষয়গুলো?
ফেরদৌস আরা: সব সময় গানকেই প্রাধান্য দিয়েছি। গানের চর্চা ছাড়া আর কিছু করিনি। ওপরে ওঠার লোভে কখনো ছুটিনি। পরিবার থেকে আমরা এভাবেই বড় হয়েছি। আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট। তাই এত নিগ্রহের পরেও আমাকে দমাতে পারেনি। গানটাকে সাধনা করেছি বলেই কখনো অন্য প্রস্তাবের দিকে তাকাইনি। রাজনীতিতে জড়াইনি। সিনেমার নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল, রাজি হইনি। এখনও আমার কাছে গানই সবচেয়ে অগ্রাধিকার পায়। সম্ভবত জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গানই আমার ভালো লাগার অগ্রাধিকারের জায়গায় থাকবে।
প্রশ্ন: প্রশাসন থেকে আপনার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তার থেকে আপনার উপলব্ধি কি হয়েছে?
ফেরদৌস আরা: শিল্পীদের কোনো কিছু দিয়ে ভাগ করতে নেই। অনেক দেশেই দেখবেন, তারা শিল্পীদের লালনপালন করে, কারণ, শিল্পীদের যেন পেটের চিন্তা করতে না হয়, কাজের জন্য ছুটতে না হয়। শিল্পীরা যেন সাধনায় সময় দিতে পারে, শিল্প ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে।