জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের পথে এসেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকারপ্রধান ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শ নিয়ে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে কনস্টিটিউশনের অধীনে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শপথ গ্রহণ করায়। আন্দোলন বা বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটলে পতিত সরকারপ্রধান পদত্যাগ করেছে কি না, সেভাবে বিবেচনার সুযোগ থাকে না। এমন অবস্থায় সাধারণত কনস্টিটিউশন স্থগিত করে সেনা শাসন অথবা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সংগত সমাধান। বাংলাদেশের সর্বশেষ ঘটনা কিন্তু সেই পথে আগায়নি। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি হঠাৎ করে তার কাছে পতিত সরকার ওড়ার প্রমাণ তার কাছে না থাকার বিষয় পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তুলে ধরায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অথচ এই রাষ্ট্রপতি আগস্ট মাসে তিন বাহিনী প্রধানের উপস্থিতিতে নিজেই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, আমি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি।
ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পরেড়। দাবি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, ৭২-এর সংবিধান বাতিল এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা। সরকার ইতিমধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ৭২-এর সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয় আর এটি করতে হলে নির্বাচিত সংসদ আসতে হবে। তবে সব রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিকে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করা যেতে পাড়ে। দেশের বর্তমান সরকার সর্বদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। তদুপরি সরকার কনস্টিটিউশন রক্ষার শপথ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ন্যূনতম ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না কনস্টিটিউশন স্থগিত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, সেই বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। জাতি সে ক্ষেত্রে যেন কোনো কারণে বিভক্ত না হয়ে পরে সেই বিষয়ে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তরুণদের মনে রাখতে হবে আবেগ দিয়ে অর্জন, পরিবর্তন সম্ভব হলেও সংরক্ষণের জন্য কৌশল এবং ধৈর্যের প্রয়োজন। ক্ষণিকের ভুলে কিন্তু অর্জন ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ একটি যুদ্ধজয়ী দেশ। লক্ষ মানুষের জীবন এবং লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল কিন্তু আপামর জনসাধারণ ৫৩ বছর শেষেও ভোগ করতে পারেনি একশ্রেণির রাজনৈতিক টাউট, লুটেরা, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের অর্জনকে ক্ষুদ্র স্বার্থে হাইজ্যাক করায়। ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিচ্যুত হয়েছে দেশ। মুক্তিযোদ্ধারা বিভ্রান্ত হয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে সুযোগসন্ধানী লুটেরাদের সুযোগ করে দিয়েছে সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগে নিজেদের সম্পদশালী করে বাংলাদেশের ভাবাদর্শ বিচ্যুত হতে। সমতাভিত্তিক, শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। জেনারেশন জেড জানতেই পারেনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের বীরদের নিয়ে তরুণ মনে আজ যে বিভ্রান্তি তার আসল কারণ ৫৩ বছর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিচ্যুত দেশ শাসন। আর সব দুঃশাসনের পরিণতি ২০২৪ ছাত্র-জনতার আরো একটি রক্তক্ষয়ী গণবিস্ফোরণে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন..। অনেকের ভাবনায় আজ দেশ কি আসলেও ৭১ ভুলে মুক্তিযুদ্ধকে অবমূল্যায়ন করছে তাকে আমি সঠিক মনে করি না। ৭২ থেকে প্রতিটি সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি সম্মান জানিয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সমুন্নত রেখে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই বিপুল সম্ভাবনা নিয়েও দেশ কাক্সিক্ষত অবস্থানে পৌঁছতে পারেনি। সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠেনি। সর্বস্তরে বিভেদ-বৈষম্য। আর তাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে এসেছে পরবর্তন। এবার যে সুযোগ এসেছে অতীতের পাপ পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে পাক পবিত্র হওয়ার। মেধাভিত্তিক সমাজ গঠন করে বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট সুযোগ যেন অনৈকের কারণে বিনষ্ট না হয়, সেটি সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে।
সঠিক কারণেই সরকারকে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিজেদের আদর্শ বিচ্যুত হয়ে ছাত্রসংগঠনটি দখল, লুপ্ত সন্ত্রাসে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সাধারণ জনতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠা ছাত্রসংগঠনটিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে জাতির প্রতি ঘোরতর অবিচার করেছে ২০০৮-২০২৪ ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। তাই ছাত্রলীগ অথবা আওয়ামী লীগের প্রতি আপামর জনসাধারণের আদৌ সহানুভূতি আছে বলে সন্দেহ আছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু ভেঙে পড়া অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, বাণিজ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ সবক্ষেত্রে অনিয়ম, অরাজকতা নিয়ে সংকটে আছে। ন্যূনতম সংস্কার শেষে নিরপেক্ষ, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর মূল লক্ষ্য। এই মুহূর্তে কোনো কারো ক্ষণিকের ভুলের জন্য বিভেদ সৃষ্টি জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর আরো একটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত করুক সেটি কোনো সত্যিকারের দেশপ্রেমিক চাইবে না। আমি তরুণ সমাজের মধ্যে অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছি। স্মরণে রাখতে হবে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জাতীয় পর্যায়ে বিভেদ সৃষ্টির অবকাশ নেই। মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত কিছু মৌলিক পরিবর্তন করে নির্বাচিত সরকারের জন্য উন্নয়নের সুস্পষ্ট রূপরেখা রেখে যাওয়া। নিশ্চিত করতে হবে আগামীতে যেন আবারও কোনো স্বৈরশাসক জনগণের অধিকার কেড়ে না নেয়।
বৈশ্ববিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৯ দফায় বেশ কিছু সৃজনশীল দাবি ছিল। সেগুলোর কিছু অন্তত সরকার বাস্তবায়ন করে বাকিগুলো নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যেতে পারে। তবে সরকারকে অবশ্যই গণআন্দোলনে নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, আহতদের চিকিৎসার সঠিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, জুলাই আগস্টে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস, লুটপাটের, নির্মোহ, নিরপেক্ষ বিচার শুরু করতে হবে। কোন দল থাকবে, কারা নিষিদ্ধ হবে সেটি বিচারের ভার জনতার ওপর ছেড়ে দেওয়াই হবে বিচক্ষণতার কাজ। সরকার বৈধ, কী অবৈধ সেটি নিয়ে অবান্তর বিতর্ক এখন প্রাসঙ্গিক নয়। সময় সবকিছু নির্ধারণ করবে।