দীর্ঘদিন পর জনসম্মুখে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামের আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া। দেড়যুগ পর তার মুখে এক চিলতে হাসির আভা! বাংলাদেশে বিশেষ করে খালেদা জিয়াকে পছন্দ করেন আর নাই করেন, সদ্য সমাপ্ত সশস্ত্র বাহিনী দিবসে আয়োজিত সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার ওই হাসিমাখা মুখে মুগ্ধ। ফেলেছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। এক কথায় খালেদা জিয়ার হাসিতে হাসলো বাংলাদেশ।
প্রশ্ন আসতেই পারে, তাকে তো বিএনপি সমর্থিত লোকজন ও সাধারণ মানুষদের অধিকাংশ হয়তো পছন্দ করেন। তার বাইরেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত বা ভিন্নমতেরও তো মানুষ রয়েছে! তারা কেন হাসবেন, তারা কেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন।
বাংলাদেশে আপসহীন নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার অনেক সুনাম। তিনি যখনই যা করেছেন, সেটা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য করেছেন এটা সবার সরল বিশ্বাস। নিজের জীবনের চেয়েও দেশকে যে ভালবেসেছেন তিনিই খালেদা জিয়া। নিজের জীবন বিপন্ন। মৃত্যুর হাতছানি প্রতিমুহূর্ত, কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি কখনই। বলেছেন, এদেশই আমার সব। এদেশের মাটি আমার। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, স্থান নেই, ঠাঁই নেই, ঠিকানা নেই। বাস্তবেও সেটাই তিনি প্রমাণ দিলেন। প্রমাণ করলেন তিনি যা বিশ্বাস করেন, লালন করেন কেবল সেটাই বলেন।
নিজের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে অশ্রুসজল চোখে এক কাপড়ে বের হয়ে যেতে হয়। বের করে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘদিন ভাড়া বাসায়। এরপর জেলজুলুম। বহু জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েও দীর্ঘদিন পুরান ঢাকার বসবাসের অযোগ্য এক রুমে কারাবাস। যা আর্দ্রতাযুক্ত, পুরোনো (মেয়াদোত্তীর্ণ) দেওয়াল প্রতিনিয়ত খসেপড়া চুন-বালুতে তার জটিল রোগ, চোখের সমস্যা থেকে শুরু করে নানা রোগ আরো জটিল আকার ধারণ করেছিল।
আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের এ নেত্রীকে নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (নাম না উচ্চারণ করে) একবার তার বক্তব্যের এক স্থানে বলেছিলেন, ‘তার তো মরে যাওয়ার কথা।’ নিজের পছন্দের হাসপাতালেও যিনি চিকিৎসা নিতে পারেননি। বহু চিকিৎসকের পরামর্শে যার বিদেশ গিয়ে সম্মিলিত তার প্রতিটা রোগের এক্সপার্ট চিকিৎসকদের নিয়ে বোর্ড বসিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন, সেখানে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি পাননি।
সেই খালেদা জিয়া জনসম্মুখে, যে সেনানিবাস থেকে তাকে টেনেহিঁচড়ে বের করা হয়েছিল, সে সেনানিবাসে আবার যাওয়া, সবার সঙ্গে কথা বলা তার যেমন ভালো লেগেছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও ভালো লেগেছে। সেটা তার চিরশত্রুরও সম্ভবত। কেন চিরশত্রুর কথা উল্লেখ হলো তারও অনেক ব্যাখ্যা। কারণ এ মুহূর্তে বিএনপির অনেক নেতা অভিযোগ করছেন, দেশের রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস টু’ (আওয়ামী লীগ-বিএনপি) চিন্তা বা প্ল্যান করছে কেউ কেউ। এ অভিযোগের কোনো ভিত্তি খুঁজে না পাওয়া গেলেও ‘যা রটে তার কিছু না কিছু বটে’ ধরে নিলেও শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর তারেক রহমানের দেশে না ফেরার এমনি মুহূর্তে দেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে খালেদা জিয়ার শত্রুও তার নিজের ও তার দলবলের ভবিষ্যৎ স্বার্থে খালেদা জিয়ার মুখে হাসি ও তার এ মুহূর্তে দেশে অবস্থান ভীষণভাবেই চাইবেন বইকি! দেশে তো বটেই। বিদেশে যারা এ মুহূর্তে আরাম-আয়েশে, সবার ভরসা একটাই-দেশে খালেদা জিয়া তো আছেন! তিনি তো আপসহীন, গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন।
খালেদা জিয়ার অবস্থান নিয়ে অনেক খবর পরিবেশন ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। তাকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে উপদেষ্টা পরিষদের প্রায় সবাই, রাজনীতিবিদগণ, সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের অনেকেই এসে কুশলবিনিময় করেছেন, যা ছিল একরকম অলৌকিক ঘটনার মতো। এমন স্থানে খালেদা জিয়ার আর কোনোদিন আসতে পারবেন এমনটাই ভাবা যায়নি। তবে সেনাকুঞ্জে তার অবস্থান অন্যভাবে মনিটরিং করেছেন একজন চিকিৎসক। তার মেডিক্যাল সায়েন্সের সে চিন্তাভাবনা তিনি তার টাইমলাইনে দিয়েছেন। তিনি রুমি আহমেদ, অধ্যাপক, ডেল মেডিকেল স্কুল ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন।
দেশের পাঠকদের জন্য তুলে দেওয়া গেল হুবহু-কারণ এর মাধ্যমে মেডিকেল সায়েন্সের কিছু তত্ত্ব কিছুটা হলেও অনুধাবনে সম্ভব। ‘বেগম খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জ সফরের অনেক ভিডিও দেখলাম! আমি যেহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র, আমি ওনার ভিডিওগুলো দেখেছি অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে! প্রথমত কাল দেখলাম, হাসছেন এবং শ্বাস নেওয়ার জন্য না থেমে এবং না হাঁপিয়ে গিয়ে মোটামুটি লম্বা সময় কথা বলতে পারছেন। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, ওনার অক্সিজেন লাগছে না!
এই পুরো ব্যাপারটা একটা মিরাকল ছাড়া আর কিছু নয়। এই কিছুদিন আগে ৮০ বছর বয়েসী ৬-৭ মাস টানা আইসিইউতে কাটালেন। ওনার কিডনি ফেইল করেছিল; হার্ট ফেইলিউর ছিল; লিভার পুরো ফেইল করেছে। লিভার ফেইলিউরের জীবনঘাতী কমপ্লিকেশন যা যা হতে পারে, সবই তার ছিল। সারা শরীরে পানি, পায়ে পানি, পেটে পানি, ফুসফুসে পানি! প্রতিদিন পেট আর ফুসফুসের পাশ থেকে সুঁই ঢুকিয়ে লিটারকে লিটার পানি ড্রেন করতে হতো। ওনার দুই চেষ্টা-এক টেস্টটিউব ঢোকানো ছিল কন্টিনিউয়াস পানি ড্রেই করানোর জন্য। ঘাড়ের মধ্যে বিশাল মোটা ডায়ালাইসিস লাইন ছিল।
আরো কিছু কঠিন সমস্যা ছিল যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস তার কথায় পরে আসছি। পৃথিবীর সবচেয়ে অ্যাডভান্সড আইসিইউগুলোতে আমি কাজ করছি গত ২০ বছর ধরে। ৮০ বছর বয়েসী একজন মানুষ অ্যাডভান্সড রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস যার লিভার ফেইল করেছে, কিডনি ফেইল করেছে; সিভিয়ার পালমোনারি হাইপারটেনশন আছে, এ দেশে আমরা আশা ছেড়ে দিতাম! বলে দিতাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার নাও-হসপিসে চলে যাও। ৮০ বছর বয়েসী একজন মানুষের লিভার ফেইলিউর একটা ওয়ানওয়ে জার্নি। বাকি সব অর্গান ডোমিনোর মতো ফেইল করা শুরু করে। রোগী বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
বেগম খালেদা জিয়া যে সাত মাস আইসিইউ থেকে কাল সেনাকুঞ্জে এসে সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন, আবারও বলছি এটা মেডিকেল মিরাকল। উপরওয়ালা কোথাও কেউ নিশ্চয় আছেন; যিনি সম্ভব-অসম্ভবের কারিগর-উনিই হয়তো চেয়েছেন অসম্ভবের ঘড়ির কাঁটাটাকে হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে। কেউ ওনাকে এই দিনটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন! কারো কোনো পুণ্য আছে কোথাও এই সম্ভব-অসম্ভবের উল্টোচালে।
আপনারা কেউ কি ওনার হাত দুটো খেয়াল করেছেন? কীভাবে বেঁকে গিয়েছে? কনট্রাকটেড হয়ে গিয়েছে? আমরা মেডিকেল কলেজে পড়েছি সোয়ান নেক ডিফর্মিটি; বাটোনেআর ডিফর্মিটি। গত শতব্দীর টার্ম! এই শতাব্দীর মেডিকেল স্টুডেন্টরা এগুলো খুব একটা দেখে না এখন। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা না হলে বার্ন্ট আউট হয়ে যায়। অ্যাডভান্সড রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের শেষ পর্যায়ে গিয়ে হাতগুলো এভাবে শক্ত হয়ে কুঁকড়ে যায়। দুটো হাতই শুধু অচল হয় না-অবর্ণনীয় যন্ত্রণা হয়, হাইডোজ ইমিউনিটি সাপ্রেস করা মেডিসিনে না থাকলে।
আপনি কি খেয়াল করেছেন উনি পা লম্বা করে হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন? উনি পা ভাঁজ করতে পারেন না! ওনাকে স্ট্যার্প দিয়ে হুইলচেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল। যাতে পড়ে না যান। আমি খেয়াল করছিলাম ওনার ছোট পুত্রবধূ প্রতিটা মুহূর্ত শাশুড়ির দিকে চোখ রাখছেন, কখন কি হয়ে যায়! একটা জীবন চিন্তা করুন তো? অবর্ণনীয় ব্যথার কারণে পা ভাঁজ করা যায় না, স্টিফ হয়ে গিয়েছে-হাত দুটো অচল! পুরো পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে ওনাকে! হ্যাঁ, আমি বলছি-‘দেওয়া হয়েছে।’
এমনি এমনি হয়নি!
আগে ওনাকে যখন টিভিতে দেখেছি, তখন তো এতো খারাপ অবস্থা ছিল না। উনি এই হাত দিয়ে করমর্দন করতেন, সারাদিন ফাইল স্বাক্ষর করতেন! একটু খুঁড়িয়ে হলে হাঁটতে পারতেন। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৯ ঘণ্টা ক্যাম্পেইন করেছেন। সারারাত পথসভা করেছেন। আজকাল আমরা এই ধরনের রিউমাটয়েড ডিফর্মিটি খুব কম দেখি। কারণ আজকাল রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের অনেক ডিজিজ মোডিফাইয়িং ওষুধ আছে। এ ওষুধটা কন্ট্রোল করে রাখা যায়! একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান রিউমাটয়েড আর্থ্রাটিস কি এখন আর ওই পর্যায়ে পৌঁছতে দেয় না। কিন্তু উনি যেই চার-পাঁচ বছর জেলে ছিলেন, তখন তার ওপর গরুর চিকিৎসা হয়েছে, মানুষের চিকিৎসা হয়নি। উনি আধুনিক কোনো চিকিৎসা পাননি! যেই ওষুধ দেওয়া হয়েছে, তাতে ওনার ডিজিজ কন্ট্রোল তো হয়ইনি লিভার-কিডনি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে।
২০০৭-এর পর থেকে ওনার পরিবারের ওপর যা গিয়েছে, যা ট্রাজিক মহাকাব্য। বড় ছেলেকে মেরে তার কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তার ১০ বছর লেগেছে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে! আরেক ছেলের ওপর (যে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না) তার ওপর কি ঝড় গিয়েছে আল্লাহই জানে। ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর ৪৫ বছরের তরুণ ক্রিকেট প্লেয়ার মানুষটা ধুম করে মরে গেলেন।
এ কাজগুলো যারা করেছে, যাদের সিদ্ধান্তে হয়েছে, যারা এক্সিকিউট করছেন, তাদেরকে জিয়া পরিবার ক্ষমা করলেও এ দেশের একটা বিশাল অংশ মানুষ কোনোদিনই ক্ষমা করবে না!
আরেকটা কথা-
বেগম খালেদা জিয়ার এখন কি উচ্চও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া উচিত? আমার মতে, এখন এটা পলিটিক্যাল ও পারিবারিক ডিসিশন; মেডিকেল ডিসিশন নয়। ওনার যে মেডিকেল টিম, তাদের অনেককে আমি চিনি! ওদের ওপর আমার ১০০ ভাগ আস্থা আছে। আমি মনে করি, ওনারাই যথেষ্ট। ওনাকে টেনেহিঁচড়ে বিদেশে নেওয়ার কোনো যুক্তি বা মেডিকেল নেসিসিটি আমি দেখি না। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। ওনার পরিবার আরো ভালো বুঝবেন।
আশা করি, ‘বেগম জিয়া দীর্ঘজীবী হোন! আরো অনেক দিন বেঁচে থাকুন এবং টানাহিঁচড়া, ধাক্কাধাক্কি ছাড়া নিজের বাড়িতে একটু শান্তিতে থাকুন।’