হঠাৎ অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশে। আন্তঃকলেজ দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শতাধিক বাস ভাড়া করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অর্ধশিক্ষিত নিম্ন আয়ের সহজ সরল মানুষদের লোন দেয়ার নাম করে ঢাকা তথা শাহাবাগে নিয়ে আসা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা নিষিদ্ধকরণ নিয়ে নাটকীয়তা, সনাতনীদের নেতা আটক- ওই ঘটনায় এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা- তুমুল অরাজকতা ঢাকা-চট্টগ্রাম জুড়ে। মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা, কী হতে যাচ্ছে। কী হবে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, মাঠে সেনাবাহিনী ম্যাজেস্টিসি পাওয়ার নিয়ে, বিজিবি সহায়তা করছে, পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থা সজাগ। এরপরও এসব কিছু কিভাবে ঘটছে। তাহলে কী দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার দিকে যাচ্ছে। করেই বা কী লাভ। সেনাবাহিনী তো মাঠেই মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়েই। তবু থামানো যাচ্ছে না। মানুষের মাঝে ভয়ার্ত প্রশ্ন। তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি..।
গত এক সপ্তাহ ধরে এসব ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ এখন অতিষ্ঠ। শঙ্কায় দিন পার করছেন। উপদেষ্টা পরিষদ বার বার সতর্ক করছেন। আইনশৃংখলা বাহিনী স্পটে যাচ্ছেন, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে, লাঠিপেটা, টিয়ারসেল, সাউন্ড গ্রেনেড পর্যন্ত ছুড়তে হচ্ছে কোথাও কোথাও। তবে এসব অরাজকতার পেছনে পতিত আওয়ামী লীগের নগ্ন প্লান পরিকল্পনা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেক রাজনীতিবিদ। যাদের ধারণা দেশে একটা অরাজকতা তৈরি করে আবারও ফ্যাসিষ্ট যাতে পুনর্বাসিত হতে পারে সে চেষ্টা তারা করে যাচ্ছে অবিরাম। তবে সব ছাড়িয়ে গেছে চট্রগ্রামের ঘটনা।
ঘটনার সূত্রপাত
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গত২৫ নভেম্বর সোমবার ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী ছিলেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। ইসকন থেকে বহিস্কার হওয়া এ সনাতনী নেতাকে ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতে তুললে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জামিন নামঞ্জুর করা হয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হলে কারাগারে নেয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে উঠালে চিন্ময়ের অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে রাখেন কয়েকঘন্টা। তারা এ সময় বিক্ষোভ শুরু করেন।
তখন পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী চেষ্টা করেও প্রিজন ভ্যান আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের করে কারাগারে নিতে পারেনি। পরে দুপুরের পরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ এবং লাঠিপেটা শুরু করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এরপর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। পরে চিন্ময় কৃষ্ণকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান কারাগারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে চিন্ময় অনুসারীদের ব্যাপক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।
পরে বিকেলের দিকে চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় এক আইনজীবী কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বিক্ষোভকারীরা এক আইনজীবীকে চেম্বারের নিচ থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন।
নিহত আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ (৩৫)। তিনি সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি)। সাইফুল লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের পুত্র। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রামের নগর পুলিশের উপকমিশনার লিয়াকত আলী বলেন, সৃষ্ট ঘটনায় একজন মারা গেছেন। তবে কীভাবে মারা গেছেন, এখনো জানা যায়নি। পরে আদালত এলাকায় আইনজীবীরা হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছিলেন। একই সঙ্গে বুধবার কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন আইনজীবিরা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশ করে। চিন্ময় এই মঞ্চেরও মুখপাত্র। ওই সমাবেশের পর তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ এনে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন বিএনপির নেতা ফিরোজ খান। পরে বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট নামে দুটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের’ ব্যানারে কর্মসূচি পালন শুরু করে। নতুন এই জোটের মুখপাত্র করা হয় চিন্ময়কে। গত জুলাই মাসে চিন্ময়কে বহিষ্কার করে ইসকন (আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ) বাংলাদেশ।
শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বন্দর নগরী চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত এবং যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। বাসস জানায়, মঙ্গলবার চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় এক আইনজীবী নিহত হন। নিহত আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ (৩৫)। তিনি সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা মঙ্গলবার রাতে এক বার্তায় জনগণকে শান্ত থাকার এবং কোনো অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ডে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানান। পাশাপাশি, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চট্টগ্রাম শহরে বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন যে অন্তর্বর্তী সরকার যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত ও বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ইসকন ইস্যুতে দেশি-বিদেশি ইন্ধন থাকতে পারে। দেশের দু-একটি দল রয়েছে বা যাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে তারাও থাকতে পারে। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
ভারতকে কড়া জবাব
শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিকে ঢাকা ‘ভিত্তিহীন’ অভিহিত করে বলেছে, এটি ‘শুধু তথ্য বিভ্রান্তিকর নয়, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের চেতনা ও বোঝাপড়ার পরিপন্থীও।’ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে "(ভারতীয়) বিবৃতিতে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতি এবং সরকার ও জনগণের প্রতিশ্রুতি ও প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ সংক্রান্ত একটি বিষয়ে আজ (২৬ নভেম্বর ২০২৪) গণমাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ সরকারের কর্তব্য। গত মাসে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা পালনের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত হতাশা ও গভীর উদ্বেগের সাথে উল্লেখ করেছে যে দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর একটি মহল থেকে ভুল ধারণা দেয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার আবারো বলতে চায় যে দেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং বিচার বিভাগের কাজে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে না। বিষয়টি বর্তমানে আইন আদালতের মাধ্যমে বিচার করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে আজ (মঙ্গলবার) বিকেলে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে সরকার গভীর উদ্বিগ্ন এবং দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যে কোনো মূল্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ বন্দর নগরীতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিন্দা ও প্রতিবাদ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের নিহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে লিখেন,
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণের সমর্থকদের বর্বরোচিত হামলায় শহীদ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আমরা সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই, অনতিবিলম্বে যেন এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ঘাতকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
আমরা সকলেই অবগত আছি, একটি কুচক্রী মহল দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়তই নানান রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে চলেছে। এমতাবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এহেন দুষ্কৃতিকারীদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার জন্য জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সকল অংশীজনকে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
একইসাথে শহরের অলি-গলি থেকে শুরু করে পাড়ায়-মহল্লায় নিজ নিজ উদ্যোগে ‘নাইট ওয়াচ টিম’ গঠন করে আজ রাতে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে। দেশের অস্থিতিশীল অবস্থাকে পুঁজি করে কেউ যেন আমাদের সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের উপরে নাশকতামূলক হামলা করতে না পারে-এ ব্যাপারে দেশের সর্বসাধারণ জনগণের সহযোগিতা কামনা করছি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান রক্ষায় এবং আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ও দেশের সর্বসাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা সর্বদা সোচ্চার থাকব। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’