৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৮:০১:০৫ অপরাহ্ন


দিল্লির আচমকা অবস্থানে বেকায়দায় আওয়ামী লীগ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১২-২০২৪
দিল্লির আচমকা অবস্থানে বেকায়দায় আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব


ভারতের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনা করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন বিবৃতিতে ভারতের সায় নেই বলে অভিমত জানান পর থেকে তাদের মধ্যে এধরনের হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশিদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অর্থ পাচার রুখতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক তল্লাশি অভিযানের হতভম্ব হয়ে পড়েছে সেখানে ও বাংলাদেশ অবস্থাকানকারী আওয়ামী লীগ নেতাকমীরা। সারাদেশের মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। 

ভারতের সায় নেই

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনা করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন বিবৃতিতে ভারতের সায় নেই। হাসিনা সরকারের পতনের পর গত সপ্তাহে এই প্রথম ভারতের কোনো কূটনৈতিক বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার এমন সফর নিয়ে নানান ধরনের জল্পনা কল্পনা চলে। ধারণা করা হয় যে, ঢাকায় এই কূটনীতিক এসেছিলেন দু’দেশের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর লক্ষ্যে। এটি ছিল ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। বৈঠকে ঢাকার পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। অন্যদিকে দিল্লির পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির এই পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। পররাষ্ট্র সচিব হওয়ার পর মিশ্রির প্রথম ঢাকা সফরও এটি। একটি সূত্র জানায়, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সচিব পর্যায়ের বৈঠক শুরুর বিশাল পর্বে যাওয়ার আগে এই দুই কূটনীতিক কিছু সময় একেবারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেন। সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়। এদিকে সচিব পর্যায়ের বৈঠক নিয়ে যখন ঢাকা-দিল্লী ব্যস্ত, ঠিক তখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে আয়োজন করেন এক ভার্চুয়াল সমাবেশ। যা নিয়ে দেশের ভেতরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচন্ড অস্বস্তি দেখা যায়। এর পাশাপাশি এটি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকারীদের মধ্যে একরকম ক্ষোভ দেখা দেয়। ক্ষোভের অন্যতম কারণ হচ্ছে একদিকে ভারত সম্পূর্ণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নতুন সরকারের সাথে কাজ করার আগ্রহ দেখাচ্ছে। আবার ঠিক বিপরীতে তাদেরই দেশের মাটিতে বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কলুষিত করছে, নানান ধরনের উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার মধ্য দিয়ে। পুরো ঢাকায় যখন এমন আলোচনা তুঙ্গে ঠিক তখনই বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর সফর করে গিয়ে দিল্লির উচ্চ পর্যায়ের সেই কর্মকর্তাই আচমকা একটি মন্তব্য করে ফেললেন। বললেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনা করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন বিবৃতিতে ভারতের সায় নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিল্লি ফিরে গিয়ে মিশ্রির দেয়ার এমন আচমকা বক্তব্যে বিমূর্ষ হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

আরো হতাশ করলো সৈয়দ রিজওয়ানা

মিশ্রির এমন মন্তব্যের পরপর বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরো যে বরফ গলছে তার ধারণা পাওয়া যায় যখন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কিছু মন্তব্য করেন। তিনি জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভালোর দিকেই যাচ্ছে। রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, উভয় দেশই সম্পর্ক স্বাভাবিক চায়। কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়, ভারতের সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের সঙ্গে। বাংলাদেশের মানুষ একজন শাসকের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। 

ভারত বুজেছে সবকিছুর নেপথ্যে ভয়াবহ গুজব

প্রশ্ন হচ্ছে ভারত কেনো নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে তাদের সবচেয়ে আস্থাভাজন শাসক আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে তাদের দেশে আশ্রয়ের পর সেই মাত্রায় রাজনৈতিক সহিসংতা হয়নি। অথচ শেখ হাসিনা বারবার ভারতকে বুঝিয়েছিল বাংলাদেশে তার শাসনামলে রাজনৈতিক মাঠে প্রধান বিরোধী দল ১৯৭১ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। তারাও একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সাম্প্রদায়িক শক্তির আশ্রয় ও প্রশ্রয় দাতা। ভারতকে বিভিন্নভাবে ধারণা দেয়া হয় বিএনপি একটি হিন্দুবিদ্বেষী রাজনৈতিক দল। তাই বিএনপি’কে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ পছন্দ করে না। কাজেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বিএনপি’র হাতে আওয়ামী লীগেরে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ও পড়বে মহা আক্রোশের শিকার। কিন্তু ভারত সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন চ্যানেল থেকে এমন ধারণা মিথ্যা বলে প্রমাণ পেয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতিক সফর করে যাওয়া ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি’কে বিভিন্ন তথ্য চিত্র দেখানো হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার কিভাবে ২০২৪ এ কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করে করে। বিভিন্ন ডকুমেন্টে দেখানো হয় যে বাংলাদেশে সাম্প্রদাযিক সম্প্রীতি রক্ষা করতে গিয়ে কিভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মন্দির-গীর্জায় হামলা প্রতিরোধে দিন-রাত পাহারা দিয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার অভিযোগের স্বীকৃতি নিয়ে যে ভারত উদ্বিগ্ন ছিল সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে তা-ও তুলে ধরা হয়। মিশ্রিকে জানানো হয় যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এ-সংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনায় জড়িত ৮৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জানা গেছে এমন খবরকে ভারত স্বাগত জানায়। গণমাধ্যমের খবরেই বলা হয় যে, বিক্রম মিশ্রি আরও জানিয়েছে যে, তার ঢাকা সফরের পর দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। সর্বশেষ একটি তথ্য পাওয়া গেছে- সেটি হলো ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যে সাম্প্রদায়িকতার আগুন উসকে দিয়েছে তার ব্যাপারেও দেশটির সরকার আঁচ করতে পেরেছে। বেশ কয়েকটি ‘অপতথ্য’ কে পুঁজি করেই যে একটি মহল কাজ করছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ইস্যুতে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও হতাশাজনক- তাও টের পেয়েছে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সরকার। আর একারণে অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ভুল বোঝাবুঝির পর্ব সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে, তা ভারতের জন্য উদ্বেগের একটি বিষয় বলে মন্তব্য করলেও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর একই সঙ্গে আস্থার কথাও বলেছেন। তিনি লোকসভায় প্রশ্নোত্তরে তিনিই দৃঢ়তার সাথেই বলেছেন, ঢাকা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করছে নয়াদিল্লি। অন্যদিকে প্রশ্নোত্তরে জয়শঙ্কর বলেন, ভারত আশা করে যে বাংলাদেশের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে উভয়ের জন্য লাভজনক একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক তৈরি করবে। আর বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এমন ইতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে খবরেও বিমর্ষ হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের থিংক ট্যাঙ্ক। 

অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভারতের এ্যাকশনে বেকায়দায় আ’লীগ

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতাকর্মীরা। যারা দেশে থাকছেন তারা বিভিন্ন কায়দা কানুন করে আছে। কিন্তু যারা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গেছেন তাদের ধরতে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডে ব্যাপক তল্লাশির খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় তল্লাশি করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের। বাংলাদেশিদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অর্থ পাচার রুখতে ঝাড়খন্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে। জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যমগ্রাম, বনগাঁ, ব্যারাকপুরসহ আরও একাধিক জেলায় চলছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তল্লাশি। এ ছাড়া বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে একাধিক জায়গায় তল্লাশি শুরু করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। বলা হচ্ছে নানা অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত চার মাসে শুধু উত্তরবঙ্গে অনুপ্রবেশের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে বলে দাবি করল বিএসএফ। আর সেই অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিরোধ করতে আরও কঠোর হচ্ছে প্রহরা। যে জায়গাগুলিতে ফেন্সিং ছিল না, সেখানে ফেন্সিংও দেওয়া হচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। আর এতে করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে হতাশা। যারা দেশে আছে এখনো পালাতে পারেনি তারা পড়েছেন একধরনের বিপদে। আর অন্যদিকে যারা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তারাও পড়েছেন বিপাকে। সবপক্ষই এখন হতাশায়। 

তবে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান?

এদিকে ভারতের সর্বশেষ অবস্থানেও সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আরও হতাশায় পড়েছে। কেননা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি বলেছেন, পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন। নয়াদিল্লিতে ‘ইন্ডিয়াস ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সাময়িকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। জয়শঙ্কর বলেন, ‘বিকশিত ভারতের’ জন্য অবশ্যই একটি পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিশ্লষকদের মতে, তা এই ধরনের বক্তব্য নতুন কিছুর আভাস দিচ্ছে, অর্থাৎ বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রাখার আভাস দিচ্ছে। কিন্তু সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি মন্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির এমন বক্তব্য প্রমাণ করে ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে ভারত আসলেই খুব একটা সন্তুষ্ট না। সেক্ষেত্রে চলতি বছরে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেতা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ভবিষ্যতে কোণঠাসা না আদর-যত্নে থাকবেন তা দেখতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

শেয়ার করুন