১৬ জানুয়ারী ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:৩৮:৫৬ পূর্বাহ্ন


ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০১-২০২৫
ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক প্রতিরোধমূলক স্তন ক্যানসার ভ্যাকসিন গবেষণায় হালনাগাদ ফলাফল ঘোষণা করেছে


২০২৪ সালে ক্যানসার চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিন গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ সাফল্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ক্যানসার প্রতিরোধ এবং চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপি ও ভ্যাকসিনের গুরুত্ব বেড়েছে এবং এ উদ্ভাবনগুলো রোগের প্রতিরোধ ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় একটি নতুন দিক খুলেছে। বিশেষত, ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার, নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার, ডিম্বাশয়ের ক্যানসার এবং অগ্নাশয়ের ক্যানসারের মতো অত্যন্ত আক্রমণাত্মক রোগের জন্য গবেষণাগুলো নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। 

ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার ভ্যাকসিন: এক বিপ্লবী অগ্রগতি

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের গবেষকরা ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার প্রতিরোধে একটি বিশেষ ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন, যা বর্তমানে ফেজ ১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করেছে। ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার ক্যানসারের একটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক প্রকার এবং এটি সাধারণত স্তন ক্যানসারের জিন ১ এবং স্তন ক্যানসারের জিন ২ মিউটেশনের কারণে ঘটে। ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার সাধারণত রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির মাধ্যমে প্রতিকারযোগ্য নয়, ফলে নতুন ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। এই ভ্যাকসিনটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে, যাতে লাসিতালবুমিন নামে একটি প্রোটিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা যায়। এটি স্তন ক্যানসার বা স্তন্যপান করানোর সময় সক্রিয় থাকে, কিন্তু ক্যানসার আক্রান্ত টিউমারে পুনরায় তৈরি হয়। প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল ইতিবাচক এবং এটি ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। গবেষকরা বিশ্বাস করেন, এই ভ্যাকসিনটি ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসারের চিকিৎসায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে, বিশেষত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য এটি একটি কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হতে পারে। 

প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ

এ ভ্যাকসিনটি মূলত ‘টাইপ ২ সেলুলার রেসপন্স’ তৈরি করে, যার মাধ্যমে টিউমার সেলগুলোকে লক্ষ্য করে ইমিউন সিস্টেমকে সচেতন করা হয়। এটি সেল সাইকেল নিয়ন্ত্রণকারী এবং ডিএনএ মেরামতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যালিং রাস্তা খোলার মাধ্যমে ক্যানসার কোষগুলোর বৃদ্ধিকে সীমিত করে। আনিক্সা বায়োসায়েন্সেস ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য ফেজ ২ গবেষণা পরিকল্পনা করছে। এটি ২০২৫ সালে শুরু হবে এবং দুই থেকে তিন বছর স্থায়ী হবে। এই ভ্যাকসিনটি একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। 

টেডোপি ভ্যাকসিন: ইমিউনোথেরাপির নতুন যুগ

টেডোপি একটি ইমিউনোথেরাপি ভিত্তিক ভ্যাকসিন, যা ক্যানসারের বিরুদ্ধে দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করতে সক্ষম। টেডোপি ভ্যাকসিনটি নিউক্লিওটাইড নিওপিটোপস ব্যবহার করে ইমিউন সিস্টেমের টি-সেলকে সক্রিয় করে, যা টিউমার কোষগুলোকে লক্ষ্য করে ধ্বংস করে। 

এ ভ্যাকসিনটি বিশেষ করে নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার, ডিম্বাশয়ের ক্যানসার এবং অগ্নাশয়ের ক্যানসারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। নন-স্মল সেল লাং ক্যানসারের জন্য ফেজ ৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, এবং ডিম্বাশয় ও অগ্নাশয়ের ক্যানসারের জন্য ফেজ ২ ট্রায়ালের ফলাফল ২০২৫ সালে প্রকাশিত হবে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ভ্যাকসিনটি এককভাবে বা কীট্রুদা এবং অপডিভো এর মতো ইমিউনোথেরাপির সঙ্গে ব্যবহৃত হলে ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারে। গবেষকরা মনে করেন, এ ভ্যাকসিন ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ এবং রোগীর দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। 

প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ

টেডোপি ভ্যাকসিনটি বিশেষভাবে নিওপিটোপস ব্যবহার করে ইমিউন সিস্টেমের টি-সেলের মাধ্যমে টিউমার কোষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। টিউমারের বিভিন্ন নিওপিটোপগুলো ইমিউন সিস্টেমকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে সাহায্য করে, যা ক্যানসারের দ্রুত বৃদ্ধি প্রতিরোধে সহায়ক। 

ইসিডিএনএ নির্ভর থেরাপি: ক্যানসারের নতুন চিকিৎসা 

বর্তমান একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ক্যানসার টিউমারের এক্সট্রাচরমোসোমাল ডিএনএ দ্রুত রোগের বৃদ্ধি ঘটায়। এ বিশেষ ডিএনএ টিউমারের জিনগত প্রকৃতি পরিবর্তন করে এবং ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এর ফলে ক্যানসারের চিকিৎসা আরো জটিল হয়ে পড়ে। তবে গবেষকরা এটাও আবিষ্কার করেছেন যে, এক্সট্র্যাচরমোসোমাল ডিএনএ নির্ভর টিউমারগুলোকে চেকপয়েন্ট কাইনেস ১ প্রোটিন টার্গেট করে ধ্বংস করা সম্ভব। 

এ পদ্ধতিটি এক্সট্র্যাচরমোসোমাল ডিএনএ নির্ভর টিউমারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের বৃদ্ধি ধীর করে দেয়, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি বিশেষ করে সেল সাইকেল নিয়ন্ত্রণকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, যা টিউমারের ডিএনএ মেরামতের প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে এবং কোষের বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করে। 

বিশ্বব্যাপী ক্যানসার ভ্যাকসিন গবেষণার গুরুত্ব

বিশ্বব্যাপী ক্যানসার ভ্যাকসিন গবেষণা বর্তমানে প্রতিরোধমূলক এবং থেরাপিউটিক চিকিৎসার মধ্যে একটি শক্তিশালী ভারসাম্য সৃষ্টি করছে। এই গবেষণাগুলো কেবল রোগ প্রতিরোধে নয়, রোগীর জীবনমান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। বিশেষত, বিশ্বব্যাপী ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের সুরক্ষা এবং ক্যানসার থেকে দীর্ঘমেয়াদি মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য ভ্যাকসিন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠছে। 

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানসহ উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং গবেষণা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এর ফলে চিকিৎসার ব্যয় কমানোর পাশাপাশি এ ভ্যাকসিনগুলোকে সহজলভ্য করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হতে পারে। 

লাদেশে ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক গবেষণার অগ্রগতি এবং উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ক্যানসার ভ্যাকসিন ও ইমিউনোথেরাপি প্রযুক্তি চালু করা সম্ভব। বিশেষভাবে, ব্রেস্ট ক্যানসার, লাং ক্যানসার এবং ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসায় এ ভ্যাকসিনগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এ প্রযুক্তিগুলো দেশে বাস্তবায়নের জন্য চিকিৎসা গবেষণায় অধিক তহবিল বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি। 

২০২৪ সালের ক্যানসার ভ্যাকসিন গবেষণার সাফল্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি মাইলফলক। গবেষণাগুলো দেখাচ্ছে, সঠিক টার্গেটিং এবং ইমিউন সিস্টেম সক্রিয়করণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব। এ ভ্যাকসিন এবং থেরাপিগুলো ভবিষ্যতে ক্যানসার চিকিৎসায় নিরাপদ এবং কার্যকর বিকল্প হিসেবে বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে এবং এটি চিকিৎসাব্যবস্থায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। 

শেয়ার করুন