১৬ জানুয়ারী ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৮:৩৪:৪৩ পূর্বাহ্ন


লুইজিয়ানায় বার্ড ফ্লুতে প্রথম মৃত্যু
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০১-২০২৫
লুইজিয়ানায় বার্ড ফ্লুতে প্রথম মৃত্যু মানব শরীরে বার্ড ফ্লু প্রবেশ ও সংক্রমণের প্রক্রিয়া চিত্র


যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো বার্ড ফ্লুতে গত ৬ জানুয়ারি সোমবার এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। লুইজিয়ানার স্বাস্থ্য বিভাগ এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। প্রয়াত ব্যক্তি ৬৫ বছরের বেশি বয়সী এবং পূর্বে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি পেছনের উঠানে পালন করা পাখি এবং বন্য পাখির সংস্পর্শে আসার পর গুরুতর বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হন। এ ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রে বার্ড ফ্লু সংক্রান্ত মানব সংক্রমণের ইতিহাসে প্রথম প্রাণঘাতী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এইচ৫এন১ বার্ড ফ্লু ভাইরাসটি অত্যন্ত মারাত্মক এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ভাগ সংক্রমণজনিত মৃত্যুর হার রয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মৃদু সংক্রমণ প্রায়ই রিপোর্ট করা হয় না, তাই প্রকৃত মৃত্যুর হার কম হতে পারে। লুইজিয়ানার এই ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ভাইরাসটির ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

২০০৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯০০ জনের মধ্যে বার্ড ফ্লু শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মারা গেছে। এই হিসাব অনুযায়ী, বার্ড ফ্লুর ক্ষেত্রে প্রায় ৫০% মৃত্যুর হার নির্দেশ করে, যা অত্যন্ত মারাত্মক। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মৃদু সংক্রমণের ঘটনা প্রায়শই রিপোর্ট করা হয় না, যার ফলে প্রকৃত মৃত্যুর হার কম হতে পারে। সিডিসি -এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর শনাক্ত হওয়া ৪৬টি মানব সংক্রমণের প্রায় সবই মৃদু ছিল এবং অধিকাংশই সংক্রমিত পশুর সংস্পর্শে আসার পর ঘটেছিল।

লুইজিয়ানার রোগীকে সংক্রমিত করা ভাইরাসের জিনগত বিশ্লেষণে এমন পরিবর্তন পাওয়া গেছে যা এটি মানুষের শ্বাসযন্ত্রের উপরের অংশে সংক্রমণ ঘটাতে আরও সক্ষম হতে পারে এবং সংক্রমণ সহজ করতে পারে। তবে এই পরিবর্তন পাখিদের মধ্যে শনাক্ত করা যায়নি, যা বোঝায় যে সংক্রমণের পর ভাইরাসটি রোগীর শরীরেই পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসের প্রতিটি ’স্পিলওভার’ সংক্রমণ প্রতিরোধ করা প্রয়োজন যাতে এটি অন্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, বার্ড ফ্লু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অসুস্থ বা মৃত প্রাণী এবং তাদের মল স্পর্শ না করা, গৃহপালিত পশুদের এসবের কাছ থেকে দূরে রাখা, এবং কাঁচা বা আধা-পাকা খাদ্য খাওয়া এড়িয়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ। পোলট্রি এবং ডিম যথাযথ তাপমাত্রায় রান্না করা, কাঁচা দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণ না করা উচিত। যারা পোলট্রি বা ডেইরি ফার্মে কাজ করেন, তাদের মৌসুমী ফ্লু ভ্যাকসিন গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যা সাধারণ ফ্লু ভাইরাসের সঙ্গে সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।

বার্ড ফ্লু নিয়ে এই ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রে একটি নতুন সতর্ক সংকেত হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সবাইকে সচেতন থাকতে এবং নির্ধারিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও, অসুস্থ বা মৃত পাখি দেখলে ইউএসডিএ-এর হটলাইনে (১-৮৬৬-৫৩৬-৭৫৯৩) রিপোর্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো বার্ড ফ্লুতে একজন মানুষের মৃত্যুর ঘটনাটি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নতুন একটি সতর্ক সংকেত হিসাবে দেখা দিচ্ছে। এইচ৫এন১ ভাইরাসের এই প্রাণঘাতী রূপ মানুষের জীবনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে, যদিও বিশেষজ্ঞরা এটিকে এখনও সীমিত ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করছেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বিশ্বব্যাপী সংক্রমণজনিত ভাইরাসগুলোর ক্রমবর্ধমান জটিলতা এবং পরিবর্তনশীল প্রকৃতি নিয়মিত নজরদারি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছে।

তাই, বার্ড ফ্লু বা অন্য কোনো প্রাণী থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং দ্রুত রিপোর্টিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় আরও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যা ভবিষ্যতে এই ধরনের সংক্রমণ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

এইচএমপিভি কতটা আতঙ্কের

করোনার পর এর মধ্যেই আবারো বিশ্বে হুমকি হয়ে উঠছে নতুন মহামারির। পুরনো হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) নতুন করে ছড়াচ্ছে দেশে দেশে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই ভাইরাস নতুন কিছু নয়। তবে মহামারি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগকে সক্ষমতা বাড়ানোর উপর জোর দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। অন্যদিকে নিউইয়র্ক সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ ভালভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা এবং ভালভাবে সব্জি রান্নার কথা বলেছে।

হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস কতোটুকুও আতঙ্কের- এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এই ভাইরাস নতুন কিছু নয়। তবে মহামারি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই সতর্ক দৃষ্টি আছে। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি আছে। তথ্য প্রকাশ করতে দ্বিধা করি। লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। বরং লুকিয়ে রাখলে মানুষ ভ্রান্তিতে ভোগে। অজানা আতঙ্কে থাকেন। তিনি বলেন, এখন দেশে বহু মানুষ শ্বাসনালির সমস্যায় আছেন। তাদের শনাক্ত করা কঠিন কিছুই না। করোনার সময় তো আমরা করেছি। এটা স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগ নিতে হবে। সার্ভিলেন্স চালু করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে বোঝা যাবে এই রোগী কোন ভাইরাসে ভুগছেন। ভাইরাসটি নিয়ে একটু উদ্বেগের মধ্যে আছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।

দেশের খ্যাতিমান ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে নানা ভাইরাস আছে। হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) করোনার মতোই ছড়ায়। এগুলো নাক, মুখ, হাত দিয়ে ছড়ায়। তাই আমাদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে। এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। এসব ভাইরাস চীনে যেভাবে ছড়ায় অন্যদেশে সেভাবে ছড়ায় না। কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম এই সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম পরামর্শ দিয়ে বলেন, করোনার মতোই আমাদেরকে মাস্ক পরতে হবে। 

করোনায় মৃত্যু-আক্রান্ত-আতঙ্ক ছড়িয়েছিল প্রায় সব দেশেই। সেই মহামারি কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়েছে বিশ্ব। এর মধ্যেই আবারো হুমকি হয়ে উঠছে নতুন মহামারি। সামনের দিনগুলোতে আবারো এমন মহামারি বা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ভাইরোলজিস্টরা। এ অবস্থায় চীন-জাপানে নতুন আতঙ্ক দ্য হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের (এইচএমপিভি) প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। চীন-জাপান ছাড়িয়ে মালয়েশিয়া ও ভারতেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটা নতুন কোনো রোগ নয়। এর ভয়াবহতার ঝুঁকিও কম। এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এটি পুরনো রোগ, নতুন কিছু না বলেও জানিয়েছেন তারা।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন এ ব্যাপারে বলেন, এইচএমপিভি ভাইরাস এর আগেও বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়। মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। 

দেশের ভাইরোলজিস্টরা বলেন, এ ভাইরাস নিয়ে অতিরিক্ত ভয়ের কিছু নেই। এতে বড় ধরনের হুমকি নেই। এর আগেও দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এই ভাইরাসে আক্রান্তদের ইনফ্লুয়েঞ্জা ও করোনা ভাইরাসের মতোই সিম্পটম (উপসর্গ) দেখা দিতে পারে। তবে এতে বড় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই রোগের আলাদা ভ্যাকসিন নেই। তবে প্রচলিত চিকিৎসায় এই রোগ ভালো হয়। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া চীনের কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, হাসপাতালগুলোতে করোনা ভাইরাসের সময়ের মতোই ভিড়। এ ছাড়া জাপানেও একই অবস্থা দেখা যায়। দেশগুলোতে এই রোগ নিয়ে সতর্ক অবস্থানেও যেতে দেখা যাচ্ছে। তবে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়লেও এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কিংবা দেশগুলোর সরকার সতর্কতা জারি করেনি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্যে জানা যায়, চীনে এই রোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। বিশেষ করে আগে যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল, তারা নতুন এই ভাইরাসের আক্রমণে নাজুক অবস্থায় আছেন। এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার জন্য বলেছে চীন।

প্রায় দুই দশক আগে প্রথমবারের মতো এইচএমপিভি’র উপস্থিতি জানান দিলেও এখন পর্যন্ত এর টিকা আবিষ্কার হয়নি। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় যেসব সতর্কতা নেয়া হয়েছিল, একই পদক্ষেপে এই ভাইরাসও প্রতিরোধ করা সম্ভব। টানা ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া, অপরিষ্কার হাতে নাক-মুখ স্পর্শ না করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার মধ্যদিয়ে এইচএমপিভি থেকে নিরাপদ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

শেয়ার করুন