৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৪২:২৬ অপরাহ্ন


ভারতের কাছে বিকল্প কি বিএনপি
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৩-২০২৫
ভারতের কাছে বিকল্প কি বিএনপি জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি


বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আস্থাহীনতার সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের প্রবল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি যেন কোনোপ্রকার জাতীয়তাবাদী চেতনা কিংবা বিপ্লবী চেতনা কোনোটিই ধারণ করে না। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপর যদিও জাতীয়তাবাদী চেতনার হয়ে বিএনপি লড়াই করার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল, সেগুলো কোনো সময় হঠকারিতা আবার কোনো সময় নির্জীব পদচারণায় বিএনপি নষ্ট করে ফেলেছে।

বাংলাদেশ ১৯৫২ সালের আগে ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ধারাবাহিকতা- কৃষক বিদ্রোহ, উপজাতি বিদ্রোহ যেমন- সাঁওতাল বিদ্রোহসহ বিভিন্ন বিদ্রোহের সঙ্গে নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ পর্যন্ত সম্পৃক্ত ছিল, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের সংগ্রামের ভূমি উর্বর থাকলেও ১৯৫৪ সালের ক্ষণস্থায়ী নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে আইয়ুবি শাসনামলের মাধ্যমে তা স্তব্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের কথা উঠলেও তা আর স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতার দাবিতে দুর্বার হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাধীনতা-সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা থাকলেও আওয়ামী নামধারী সুবিধাবাদী জাতীয়তাবাদীরাই ক্ষমতায় বসে। আর সমাজবিপ্লবের ধারাকে নির্যাতনের মাধ্যমে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।

এরপর জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি পুনরায় জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করলেও তা বেশিদূর এগোয়নি। এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতারোহণ সেই ধারাকে নষ্ট করে। অন্যদিকে এরশাদের উৎখাতের মাধ্যমে দেশে আরেক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও তার থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনৈর সূচনা করা যেত। কিন্তু গদি দখলের রাজনীতি আর জাতীয়তাবাদ রচনার রাজনীতি এক নয়। সমাজতন্ত্রের কথা তো বহু দূরে।

এরশাদ পতনের আন্দোলনে যদিও দেশের জাতীয়তাবাদী চেতাকে এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা বিএনপির চাতুর্যহীন রাজনীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তী নির্বাচন বিএনপি ক্ষমতায় এলেও তারা এক ও অভিন্ন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পদরচনা করতে পারেনি। কাজেই দেখা যায়, সুবিধাবাদী বুর্জোয়া রাজনীতির ধারক আওয়ামী লীগ ও মৌলবাদী রাজনীতির চক্রে বাংলাদেশের রাজনীতি আরেক দফা হোঁচট খায়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় এলে তারা আওয়ামী লীগের ‘ডালপালা ছাঁটাই করে শেকড়ে পানি দিতে থাকে।’

এর মধ্যে বিএনপির নেত্রীকে ভুয়া মামলা দিয়ে কারান্তরীণ রাখে আওয়ামী লীগ, তাতে বিএনপি কোনো আন্দোলন রচনা করতে পারেনি। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন হয়, বিএনপি কোনো আন্দোলন রচনা করতে পারেনি। ২০১৫ সালে বেগম জিয়া এককভাবে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি দিলো তখনো বিএনপি কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারেনি। ২০১৮ সালে রাতে ভোট ডাকাতি করে দিনে ভোটের মহড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রহসন করে। বিএনপি কোনো আন্দোলন করতে পারেনি। এরপর আসে ২০২৪ সাল আবার নির্বাচনের পালা, আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনকে পুকুর চুরির মতো সারা বিশ্বকে দেখিয়ে মনের সুখে নির্বাচনী ডালি সাজায়। কিন্তু বিএনপি তাতে কোনো আন্দোলন রচনা করতে পারেনি। তার কারণ কি? আসলে বিএনপি চেতনাহীন এক নির্বোধ দলে পরিণত হয়েছে। এই ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগের কবর রচনার কথা ছিল। সকল বিরোধীদল বিএনপির নেতৃত্বের দিকে চেয়েছিল। কিন্তু না বিএনপি নির্বাচনের পসরা ব্যতিরেকে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। তারপর আসে কোটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি। যেখানে বিএনপির সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। বলাবাহুল্য, আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে বিএনপির কেউ ছিল বলে মনে হয় না। তারপরও আন্দোলনের ডাকের জন্য মুখিয়ে থাকা বিএনপি ও ছাত্রদলের কর্মীরা কোনো নির্দেশনা ছাড়া কোটাবিরোধী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেন। তীব্রগতিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তেপান্তরে। আন্দোলন শুরু হয় কোটা বৈষম্য নিরসনে। কিন্তু সেখানে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট নেতৃত্বের ভ্রুকুটিতে আন্দোলনে নতুন করে উদ্দীপনা আসে। বিশ্ববাসী সে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দেয়। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য এমনকি চীন সরকার সরাসরিভাবে আন্দোলনে সমর্থন দেয়। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দু’ভাগ হয়ে যায়। একদিকে অজিত দোভালের নেতৃত্বে ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) ও অন্যদিকে রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইটিকেল উইং (র)। ‘র’ শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি ও তার আর্থিক দোসর আদানির দহরম মহরমকে সহ্য করেনি। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি চেয়েছিল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। 

আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতন ও জনগণের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য, আন্দোলনকারীদের নির্বিচারে হত্যা করে গণহত্যার মহোৎসবের মাধ্যমে স্বৈরসরকারের পতন হয়। এই আগস্ট। বিএনপি আওয়ামী সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সূর মিলিয়ে বলতে থাকে তারা আন্দোলনে ছিল। মূলত তারাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী দল। কিন্তু বিষয়টা আন্দোলনের রচয়িতা কিংবা আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসানো ড. ইউনূসের সরকারের কেউই প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে স্বীকার করে না। 

উল্লেখ্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আলটিমেটাম হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু ইতিমধ্যে যারা সরকারে আছেন বা সরকারকে সমর্থন করেন তাদের কেউই নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন না। বলছেন নির্বাচনের আগে সংস্কার চাই। কিন্তু এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ইস্যু। আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকার যদিও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক কিছুর সংস্কারে হাত দিয়েছেন। তারপরও দেখা যায় সেখানে ‘দইয়ের হাঁড়িতে নেপো’র হাত। উপদেষ্টাদের মধ্যে আসিফ নজরুল ছাড়া কেউ স্পষ্ট করে নির্বাচনের কথা বলেন না। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে বলা হলেও সবাই চেয়ে থাকেন ড. ইউনূসের নির্বাচন নিয়ে বক্তব্যের দিকে। সেখানে বিএনপি জোর চিৎকার করে বলেন, নির্বাচন চাই। কিন্তু এই দাবি যতটুকু নিজ দলের লোকদের সামাল দেওয়ার জন্য তার চেয়ে সত্যিকার নির্বাচন চাওয়া অনেক কম। 

ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের পতনের পর শেখ হাসিনাকে ভারত নিলেও বাংলাদেশে আওয়ামী পরিবারে তার বিকল্প চাচ্ছে। তাহলে ভারতের কাছে বিকল্প কি বিএনপি। 

সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের বাংলাদেশ সফরের সময় বিদেশি কূটনীতিক মহল সূত্রে জানা যায়, ভারত বিএনপিকে ভরসার আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু তারেক জিয়ার ব্যাপারে তাদের আপত্তি রয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা মির্জা ফখরুল ইসলামের কাঁধে বন্দুক রাখতে চায়। কারণ ভারতের কাছে তারেকের স্থলে ফখরুল গ্রহণযোগ্য। সে কারণে তারেক জিয়া বাংলাদেশে আসতে ভয় পাচ্ছেন। ২০১৪ সালের পর আন্দোলন যখন চাঙ্গা, তখন ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অন্তত তিনবার তারেক জিয়ার বাংলাদেশে আসার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তিনি কোনোরূপ দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরতে চাননি। এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে দল হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা চীন বা ভারত, আমেরিকার মিত্রতা নেই। তা আরেকদিন আলোচনাসাপেক্ষ। এখনো তারেক জিয়াকে আমেরিকার ভিসা দেওয়া হয় না। কাজেই এখনো বিএনপির ওপর বিদেশের আস্থার সংকট প্রচণ্ড। এই সংকট নিয়ে বিএনপি কি পরবর্তী সরকার গঠন করতে পারবে? বিএনপির অভ্যন্তরে স্যাবোটাজ বা ষড়যন্ত্র করার পাকা হাতের কমতি নেই। এখন থেকে অনেকে স্লোগান তুলছে ইউনূস সরকারকে হুমকি দিয়ে। সে হুমকির জের যা হোক বিএনপির জন্য শুভ নয়। আর বিএনপি তো ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় বসায়নি। তাকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে তা বুঝতে বিএনপির চোখে চশমা দিতে হবে না। অতএব বর্তমানে বিএনপির প্রধান সমস্যা দল ও ব্যক্তির ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা।

শেয়ার করুন