রাজনৈতিক অঙ্গনে কখনো লম্বা সময় ধরে সংস্কারের জোড়ালো দাবি আবার কখনো জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তোড়জোরে রহস্য খুঁজে পেয়েছে বিএনপি। দলটির হাইকমান্ড মনে করেন, এসবের অন্যতম কারণ বিএনপি’কে রাজনৈতিকভাবে নার্ভাস করে ফেলা। এসব ইস্যুতে বিতর্কের মধ্যে ফেলে বিএনপি’কে কোনঠাসা করে ফেলা। এর পাশাপাশি বিএনপি’র সাথে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলিকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে দূরে সরিয়ে দেয়া। বিএনপি’র নেতারা মনে করেন, সামনে নির্বাচনে জেতার জন্য বিএনপির যত বেশি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তত বেশি এই দলকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করার চক্রান্ত হচ্ছে। আর এসবের নেপথ্যে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধীতাকারী একটি মহল। যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোমলমতি নেতাকর্মীদের ইমেজকে কৌশলে ব্যবহার করে যাচ্ছে। তাদের দিয়ে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে রাজনৈতিক অঙ্গন ব্যতিব্যস্ত চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপি’র নেতারা মনে করেন, ওই মহলটি দেশ নয় নিজেদের স্বার্থেই এসব ইস্যুক উসকে দিচ্ছে। এসব খবর মিলেছে রাজনৈতিক মাঠ ঘুরে।
নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করার নানান কৌশল
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠে সক্রিয় একটি মহল চায় না ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি হউক। তাদের টার্গেট জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি আরও দেরিতে আয়োজন করা হোক। আর এরই মধ্যে মাঠকে সাংগঠনিকভাবে তাদের মতো করে সাজিয়ে নিতে চায়। অন্যদিকে সংস্কারের নামে নির্বাচনকে আর দেরিতে আয়োজনের ফাঁকে প্রশাসনকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আনা। এতে করে তারা আওয়ামী লীগের মতো একটি সাজানো নির্বাচন করে ফেলার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে। এজন্য তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কারের দাবিতে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনপি’র হাই কমান্ড মনে করেন। বিএনপি নেতারা মনে করেন, দেশে বিদেশে এমন-কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে যে, ‘ব্যাপক সংস্কারের আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেনো কোনোভাবেই আয়োজন করা না হয়।’এর পাশাপাশি অতিসম্প্রতি ওই রাজনৈতিক মহলটি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি নিয়ে মাঠ গরমের কাজ শুরু করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবিকে জনপ্রিয় করতে ওই মহলটি নানান কায়দা কানুন করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রেও তাদের আস্থাভাজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজে তৈরি হওয়া নতুন রাজনৈতিক দরকি ব্যবহার করতে চাইছে। অন্যদিকে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবির পাশাপাশি শুরু করেছে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ব্যাপারেও তোড়জোর। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের দাবিকে জনপ্রিয় করতে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে ইমেজে গড়ে উঠা দলটিকে কাজে লাগাতে চাইছে। এর পাশাপাশি এসব দাবি জানিয়ে রাজনৈতিক মাঠকে ধীরে ধীরে ঘোলাটে করে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে। যেনো বিএনপিসহ দলটির সাথে যুগপৎ আন্দোলনে শরিকরা বেকায়দা পড়ে যায়, দেখা দেয় হতাশা।
বিএনপি কি ভাবছে ও করে যাচ্ছে
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এবং পাশাপাশি বিএনপি’র বেশ কয়েকটি পদক্ষেপে বোঝা যাচ্ছে যে যারা রাজনৈতিক মাঠকে ঘোলাটে করতে চাইছে তাদের ব্যাপারে দলটি যথেষ্ট সজাগ রয়েছে। এই কারণে বিএনপি শুরুতেই যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগেই হতে হবে সে দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশে বিদেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। বলা যায় কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকেও কাজে লাগিয়েছে। এর পাশাপাশি বিএনপি’র এমন দাবির সঙ্গে চলা দলটির যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদেরও এখনো একসাথে রাখতে পেরেছে। দেশের ভেতরে অপরাপর রাজনৈতিক মহলকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, দেশে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হলে পরিস্থিতি বেকায়দায় চলে যাবে, চক্রান্ত বাড়বে। অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বিদেশীদেরও আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, ডিসেম্বরে মধ্যে নির্বাচন হলে দেশ সঠিক পথে থাকবে। সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলারের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত তাতে বিএনপি এভাবেই দলটির মতামত তুলে ধরেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ছাড়াও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ উপস্থিত ছিলেন। এতে কূটনীতিকদের যুক্তি দিয়ে বিএনপি নেতারা বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে-ও বিএনপি তাদের যে মতামত জানিয়েছে তাতে বোঝা যায় বিএনপি’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া চক্রটির ব্যাপারে বিএনপি যথেষ্ট সর্তক রয়েছে। আর এজন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অধিকাংশ সুপারিশে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা খর্বের সুপারিশ তারা মানে না। যদিও দলটি বিচার বিভাগ সংস্কারের ২৩ সুপারিশের সবকটিতে, দুদক সংস্কারের ২০ সুপারিশের ১৯টিতে একমত এবং আংশিক একমত। আর আরও গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হচ্ছে একটি মহল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের যে চেষ্টা করে যাচ্ছিল বিএনপি সেটিও রুখে দিয়েছে। এজন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পেশ করা দলটির মতামতে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে সংবিধানে প্রস্তবনা এককাতারে রাখা বিএনপি সমচীন মনে করে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। দলটি ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতি যেভাবে ছিল, তা পুনর্বহাল চায়।
পতিত শেখ হাসিনার নির্যাতন উপেক্ষা করে পল্টনে এক জনসমাবেশে বিএনপির নেতা কর্ীদের ঢল/ফাইল ছবি
কেনো টার্গেট বিএনপি
রাজনৈতিক সূত্রগুলি মনে করে একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে তাতে বিএনপি জয় পেতে পারে তা নিশ্চিত ওই স্বাধীনতা বিরোধী মহলটি। কিন্তু সম্প্রতি তারা তাদের রাজনৈতিক দলকে এমনভাবে উপস্থাপন করে ফেলেছে তারাই এখন বাংলাদেশে আগামী ভবিষ্যত। নিজেদের এমন কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হলে বর্তমানে মাঠে অন্যতম একক শক্তিশালি দল বিএনপি’কে ঠেকানো ছাড়া দলটি হাতে এখন আর কোনো এজেন্ডা নেই। কারো কারো মতে, বিএনপি’কে চাপে রেখে ওই মহলটি একটি শক্তিশালি সুবিধাজনক সমঝোতায় যেতে চেয়েছেল বেশ কয়েকবারই। কিন্তু বিএনপি’র একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী ওই শক্তিটির সাথে কোনো ধরনের আপোষ বা সমঝোতায় না যাওয়া তারা বিক্ষুদ্ধ। আর এমন বিক্ষুব্ধ হওয়া থেকেই দলটি বিএনপিকে টার্গেট করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। মাঠ ঘোলা করছে। তবে আরেকটি সূত্র জানায়, ওই মহলটি সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের জরিপ চালিয়ে জেনেছে যে, রাজনৈতিক মাঠে সুষ্ঠু ভোট হলে তারাই জয়লাভ কররে এবং সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে। আর সেকারণে বিএনপি’কে ঠেকাতে তারা বিভিন্ন নেতিবাচক কাজ করে বিএনপি’কে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।