৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:১৫:৩২ অপরাহ্ন


টেক্সাসে মুসলিম ‘এপিক সিটি’ নিয়ে বিচার বিভাগের তদন্ত শুরু
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৫-২০২৫
টেক্সাসে মুসলিম ‘এপিক সিটি’ নিয়ে বিচার বিভাগের তদন্ত শুরু প্রস্তাবিত এপিক সিটি


টেক্সাসের কোলিন কাউন্টিতে মুসলিম নেতৃত্বাধীন একটি আবাসিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘এপিক সিটি’ নিয়ে ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস (ডিওজে) তদন্ত শুরু করেছে। টেক্সাস রিপাবলিকান সিনেটর জন করনিন প্রকল্পটির পেছনে ‘ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব’ বা ‘শরিয়া আইন’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বানের পর ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এ প্রকল্প নিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত হলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো উদ্যোগকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক, ভ্রান্ত তথ্য ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। টেক্সাসের কোলিন কাউন্টিতে ইস্ট প্লানো ইসলামিক সেন্টার (এপিক) কর্তৃক পরিকল্পিত ‘এপিক সিটি’ প্রকল্পটি এই দ্বন্দ্বের সাম্প্রতিক এবং জটিল উদাহরণ। এটি একটি বহুমুখী আবাসিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প হলেও এর বিরুদ্ধে ‘শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা’ এবং ‘ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব’-এর মতো অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ফলে প্রকল্পটি রাজনৈতিক বিতর্ক, ধর্মীয় বৈষম্য এবং সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকারের প্রশ্নে একটি অনন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিচার বিভাগের তদন্ত কেবল একটি প্রকল্পের বৈধতা নির্ধারণে নয়, বরং বৃহত্তর ধর্মীয় সহনশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মাপকাঠি হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

প্রকল্পটি পরিকল্পনা করেছে ইস্ট প্লানো ইসলামিক সেন্টার (এপিক)। তাদের লক্ষ্য, ডালাস শহরের উত্তর-পূর্বে জোসেফিন এলাকার ৪০০ একর জমিতে একটি পরিকল্পিত বহুমুখী কমিউনিটি গড়ে তোলা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই এপিক সিটিতে প্রকল্পের পরিকল্পনায় রয়েছে এক হাজারের বেশি আবাসিক ইউনিট, একটি স্কুল, খুচরা ব্যবসার এলাকা, পার্ক এবং একটি কেন্দ্রীয় মসজিদ। উদ্যোক্তারা জানান, এটি মূলত মুসলিম পরিবারগুলোর জন্য পরিকল্পিত হলেও প্রকল্পটি সকল ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তাদের লক্ষ্য একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ বহুসাংস্কৃতিকও অন্তর্ভুক্তিমূলক কমিউনিটি গড়ে তোলা। তবে টেক্সাসের রক্ষণশীল রাজনৈতিক মহলে এ প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। সিনেটর করনিন, গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট এবং অ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটনসহ একাধিক রিপাবলিকান নেতা দাবি করছেন, এপিক সিটি প্রকল্পের মাধ্যমে একটি মুসলিম শুধু সম্প্রদায় গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে শরিয়া আইন কার্যকর হতে পারে। যদিও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করা হয়নি।

প্রকল্পটির পক্ষে আইনজীবী ড্যান কগডেল এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, প্রথমদিন থেকেই আমার মক্কেলরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা আইন মেনেই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। তারা কোনো গোপন কিছু করছে না। কিন্তু বারবার অপবাদ ও রাজনীতিক আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ২০২৫ সালে এসেও মসজিদ, ইসলাম, মুসলিম শব্দগুলো অনেকের কাছে এখনো ভয়ের প্রতীক হয়ে আছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আইনজীবী কগডেল বলেন, তারা আইন মেনে সবকিছু করতে চায়, কিন্তু এখন এতো বেশি আইনজীবীদের পেছনে খরচ হচ্ছে, যা তারা কল্পনাও করেনি। তবু তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে এই প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করবেই।

এদিকে গত মার্চের শেষ থেকে এপিক সিটির বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত শুরু হয়। গভর্নর অ্যাবট তিনটি তদন্তের নির্দেশ দেন, যার মধ্যে রয়েছে সম্ভাব্য অপরাধমূলক কার্যকলাপ, ফেয়ার হাউজিং আইনের লঙ্ঘন এবং টেক্সাসের ভোক্তা সুরক্ষা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ। এপ্রিল মাসে গভর্নর আরো দাবি করেন, প্রকল্পটি প্রয়োজনীয় নির্মাণ অনুমতি না নিয়েই কাজ শুরু করেছে। যদিও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা এখনো ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ পর্যায়ে রয়েছে এবং পারমিট প্রক্রিয়াধীন।

সিনেটর করনিন ১১ এপ্রিল বিচার বিভাগের সিভিল রাইটস ডিভিশনে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলেন, এপিক সিটি একটি ‘ধর্মীয় সম্প্রদায় যা ইসলামি আইন দ্বারা পরিচালিত হতে পারে’ এবং এটি ফেডারেল আইন লঙ্ঘন করতে পারে। এই চিঠির জবাবে আমেরিকান-ইসলামিক সম্পর্ক কাউন্সিল (কেয়ার) একটি পাল্টা চিঠিতে জানায়, এই দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং ধর্মীয় বৈষম্যমূলক। তারা আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টান প্রবীণ কেন্দ্র বা ইহুদিপাড়াগুলো যেভাবে স্বাধীনভাবে গড়ে উঠছে, মুসলিম-নেতৃত্বাধীন কমিউনিটিগুলোরও একই অধিকার থাকা উচিত। এপিক সিটি এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে, প্রকল্পটির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, নির্বাচিত কর্মকর্তারাই প্রকল্পটিকে বিচ্ছিন্নতা ও একচেটিয়ার রূপে তুলে ধরছেন, যা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এদিকে মার্কিন মুসলিম অধিকার সংগঠন কেয়ার সিনেটর করনিনের দাবিকে ভিত্তিহীন ও ইসলামোফোবিয়ামূলক বলে আখ্যায়িত করেছে। কেয়ারের গভর্নমেন্ট বিষয়ক পরিচালক রবার্ট এস ম্যাকাও বলেন, এই প্রকল্পকে শুধু মুসলিম নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ায় সন্দেহজনক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এটি ধর্মীয় বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। তিনি আরো বলেন, বিচার বিভাগ বরং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যারা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করছে। প্রকল্পটির পরিকল্পনাকারী ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি ক্যাপিটাল পার্টনার্স জানিয়েছে, তারা বারবার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আক্রমণের শিকার হচ্ছে, যা প্রকল্পটির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বিকৃত করছে। এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, আমরা চাই সব ধর্ম, সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে একটি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারুক। আমাদের প্রকল্প সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগসহ একাধিক সংস্থা এপিক সিটি প্রকল্প নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এই তদন্তের ফলাফলই নির্ধারণ করবে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ, যা এখন রাজনীতি, ধর্মীয় বৈষম্য ও সংবিধানিক অধিকার রক্ষার জটিল এক চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

এই মুহূর্তে ‘এপিক সিটি’ প্রকল্পটি কেবল একটি নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা নয়, বরং এটি ধর্মীয় স্বাধীনতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ সম্পর্কিত বৃহত্তর বিতর্কের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। বিচার বিভাগের তদন্ত কেবল আইনগত বৈধতা নির্ধারণ করবে না, বরং তা যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচিত হবে। ফলে তদন্তের ফলাফল এ প্রকল্পের ভবিষ্যত নির্ধারণের পাশাপাশি, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের অবস্থান নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

শেয়ার করুন