৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:৪৩:৩৭ অপরাহ্ন


লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক বৈঠকে তাকিয়ে বাংলাদেশ
রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৬-২০২৫
রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমান


লন্ডনে প্রধান উপদেষ্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের খবরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত মিলেছে। ১৩ জুন এ দুই ব্যক্তিত্ব ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক করবেন। যার সময়কালেরও একটা ইঙ্গিত মিলেছে। বৈঠকটি হতে পারে প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী। বৈঠকের খবর ও বৈঠকের সময়ের পরিমাপে বলে দেয়া যায় এটা আর দশটা বৈঠকের মত সাদামাটা কোনো বৈঠক নয়। এর গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক যে প্রেক্ষাপট বিরাজমান, সে দৃষ্টিকোন থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করছেন, বৈঠকটি যেন সুন্দরভাবে ও সমঝোতার মাধ্যমে শেষ হয়। কদিন আগেও বাংলাদেশে একটা দাবি উঠেছিল। প্রফেসর ইউনূস রাষ্ট্রপতি ও তারেক রহমান হোক প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে রূপ নেক। গণমানুষের দাবির অনেক রূপ। তবে সবটা তো আর বাস্তবায়িত হয় না। তবে কিছু কিছু দাবি সেটা যেখান থেকেই উঠুক না কেন, সে দাবিতে দেশের ১৮ কোটি মানুষের অন্তত ১৭ কোটি হলেও একমত হতে পারেন। সদ্য শেষ হওয়া ঈদ উল আজহার জামাতের এক ফাঁকে সাধারণ মানুষকে বলতে শোনা গেছে, ‘আপনি (ড. ইউনূস) কারো কথা শুনবেন না। আপনি কন্টিনিউ করেন।’ আগামী এপ্রিলের যে কোনো দিন জাতীয় নির্বাচের রোডম্যাপ ঘোষণার পর ওই ঈদের জামাতে ইউনূসকে সাধারণ মানুষ উৎসাহ দেন। কিন্তু বাস্তবতা একটা দেশ, একটা গণতান্ত্রিক দেশ নির্বাচন বিহীন সরকার বেশিদিন থাকতে পারেন না। সে দৃষ্টিকোন থেকে ড. ইউনূস যত ভালই করুক না কেন তার দায়িত্ব আকড়িয়ে থাকা শোভনীয় না। নির্বাচন তাকে দিতেই হবে। দিয়েছেনও। বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন চেয়েছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। আর প্রফেসর ইউনূস দিতে চান এপ্রিলে। কারণ তার কিছু অসমাপ্ত কার্যাদি বাকি। সেগুলো সেরেই তিনি নির্বাচন দেবেন। এটা নিয়েই বিতর্ক এ মুহূর্তে।

তবে বিএনপি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে আসছে। শেষাব্দি তারেক রহমানও কঠোরভাবেই আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করেন। এরপর থেকেই উপদেষ্টাদের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণার অভ্যন্তরীণ আলোচনা। এবং ঈদ উল আজহার পূর্বে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে ওই রোডম্যাপের ঘোষণা প্রধান উপদেষ্টা দিলেন। যদিও এ তারিখ নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বিএনপি ইতিমধ্যে এ তারিখকে অনেকটাই প্রত্যাখান করে ডিসেম্বরেই নির্বাচনের দাবি করে। 

এমন প্রেক্ষাপটে লন্ডন গেলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখানেই ওই আনুষ্ঠানিকতার ফাঁকে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের সময়সূচি কনফার্ম হলো। যা ইতিমধ্যে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন। এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন একান্তে কথা বলতে চাইছেন তারেক রহমানের সঙ্গে এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তবে এ আলোচনায় যে বিষয়টার ইঙ্গিত করছে, তাহলো ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলেও সেখানে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরও প্রভাব বা সমর্থন থাকতে পারে। কেননা নির্বাচনের পর প্রধান উপদেষ্টার কাজ শেষ। এরপর শুরু রাজনৈতিক সরকারের। যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বহু পূর্বেই বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠের আন্দোলনে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে নিয়ে একটা ঐক্যমতের সরকার গঠন করবেন। বিএনপির সে চিন্তাধারা এখনও। ফলে সেখানে এনসিপির অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের দায়ে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলোর বিচারকার্য কন্টিনিউকরণ, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেগুলোর বিষয়ে তারেক রহমানকে ধারণা দান ও কিভাবে কোন পর্যায়ে প্রফেসর ইউনূস করে যেতে পারলেন পরবর্তিতে এসব ইস্যুর ভবিষ্যত কী নানা বিষয়ে আলোচনায় উঠে আসতে পারে। 

তাছাড়া বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার কোনো প্রতিপক্ষ নয় এটা তো ঠিক। যদিও বিএনপির অনেক নেতা রাজনীতির স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধাচারন করেছে নানা ইস্যুতে। কিন্তু দিন শেষে বিএনপির বড় এক সমর্থন নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনা করছেন ড. ইউনূস। বিএনপি আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপি বড় দল। এমন এক দলের সাপোর্ট থাকা অন্তর্বর্তী হোক আর তত্ত্বাবধায়কই হোক সরকার পরিচালনা কষ্টসাধ্য। বিএনপি এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। যদিও বিএনপি এটা স্বীকারও করছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া নানা সংস্কার, সিদ্ধান্ত এসব তো পার্লামেন্টে পাস হতে হবেসহ নির্বাচিত সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। নতুবা সেগুলো ভেস্তে যেতে পারে। সব মিলিয়ে দুই ঘন্টার ওয়ান টু ওয়ান অলোচনা ফলপ্রসু হবে বলে ধারণ করা হচ্ছে যেহেতু আমন্ত্রণটা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকেই এসেছে। 

এছাড়াও দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যেও অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যা আওয়ামী লীগকে পরবর্তিতে মোকাবেলাতেও মোটেও ভাল কিছু নয়। ড. ইউনূস এ ঐক্য ধরে রাখার জন্য বিএনপিকে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার বিষয়েও আলোচনা করতে পারেন। 

এমন বহু কিছুই উঠে আসবে আলোচনায়। বিদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত থেকে শুরু করে বহু ইস্যু। তবে আলোচনা যাই হোক, প্রফেসর ইউনূসকে পাশে নিয়ে তারেক রহমান ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করুক এর পক্ষে সমর্থন ব্যাপক। দেশটাকে একটা স্থিতিশীল ও পরোমুখাপেক্ষী না করে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা ইতিমধ্যে ড. ইউনূস কিছুটা হলেও নজির দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ চায় এটা কন্টিনিউ হোক। তাছাড়া ড. ইউনূসের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী। রোহিঙ্গা ইস্যু, ভূ-রাজনীতি নানা প্রেক্ষাপটে দেশের জন্য বড্ড প্রয়োজন ইউনূসকেও। তবে সব আলোচনা জনসম্মক্ষে আসবে না এটা ঠিক। ভবিষ্যতে বের হবে পর্যায়ক্রমে। বিভিন্ন কাজ কর্মের মাধ্যমে। সে অপেক্ষা করতেই হবে। 

ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক নিয়ে যা বললেন মির্জা ফখরুল 

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার (১০ জুন) ফেসবুকে করা এক পোস্টে এ মন্তব্য করেন তিনি।

পোস্টে মির্জা ফখরুল লিখেন, আমরা প্রত্যাশা করছি যে, বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংকটগুলো তা কাটিয়ে উঠতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে এই সাক্ষাৎ। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। তিনি লিখেন, প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এই বৈঠক একটি বড় ইভেন্ট, ‘মেজর পলিটিক্যাল ইভেন্ট’। এই সাক্ষাৎ হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে, নতুন ডায়মেনশন সৃষ্টি হতে পারে। ‘ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠক টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে’ সাক্ষাতের সুনির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা নেই। প্রধান উপদেষ্টা যে হোটেলে উঠেছেন, সেখানেই সাক্ষাৎ হবে। বিএনপি মহাসচিব লিখেন, আমাদের বর্তমান যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ মুহূর্তে এসে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরাই দায়িত্ব দিয়েছি। রাজনৈতিক দিক থেকে কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা সবাই অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ। পণ্ডিত লোক। পলিটিক্যাল উইশডম পুরোপুরি আছে সে কথা বলা যাবে না। তবে তাদের আন্তরিকতার অভাব আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। তারা কাজ করতে চান, কাজ করার চেষ্টা করছেন। দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে, তবে এখানে একটি ইউনিক ব্যাপার আছে- এখানে একটা চাপ আছে।

এখানে নতুন নতুন রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন নতুন রাজনৈতিক চিন্তা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করে একটা জায়গায় নিয়ে আসা, এটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জিং জব। সেখানে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, দুই নেতার আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান হয়ে যেতে পারে।

এ ছাড়া তিনি লিখেন, মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট শাসনে আওয়ামী লীগ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে গড়ে তোলা কিন্তু ছেলেখেলা নয়! এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ।

শেয়ার করুন