১৭ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:০০:৩০ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
গোপালগঞ্জ এখন মুজিববাদী সন্ত্রাসীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে- নাহিদ এনসিপি’র মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষ চারজন নিহত নিউইয়র্কে ২০ লাখ মানুষ মেডিকেইড ও ৩ লাখ পরিবার স্ন্যাপ সুবিধা হারাবে নতুন ভিসা ফিতে বাংলাদেশিদের খরচ বাড়বে আড়াই গুণ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি মাহমুদ খলিলের টেক্সাসের অভিবাসন আইন এসবি ৪ অসাংবিধানিক ঘোষণা ফ্লোরিডার ‘সিনেট বিল ৪-সির কার্যকারিতা বন্ধ করলো যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট নতুন নীতি ঘোষণা : ৯ কারণে নাগরিকত্ব হারাতে পারেন জঙ্গিবাদে সতর্ক থাকার মার্কিনী পরামর্শে নানা প্রশ্ন এনসিপিসহ ১৪৪ নিবন্ধন প্রত্যাশী দলের তথ্যে ঘাটতি


নিউইয়র্কের শ‍্যাম চাচা
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৬-২০২৫
নিউইয়র্কের শ‍্যাম চাচা হাবিব রহমান


শর্ঢু চেহারার এক দীর্ঘদেহী ব‍্যক্তি, পরনে আমেরিকার পতাকা দিয়ে তৈরি স‍্যুট, মাথায় দীর্ঘ কালো সাহেবি হ‍্যাট, হ‍্যাটের সামনে জ্বলজ্বল করছে একটি তারকা। এই হলো আমাদের শ‍্যাম চাচা। আংকেল শ‍্যাম। নিউইয়র্কসহ সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে এক নামে তার পরিচয়। এক ডাকে তাকে চেনেন সবাই। আমেরিকার সৈন‍্য সংগ্রহের বিজ্ঞাপনে আংকেল শ‍্যামের ছবি চোখে পড়ে। বড় পোস্টারে আংকেল শ‍্যাম তর্জনী উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে প্রথম লাইনে বড় অক্ষরে লেখা-আই ওয়ান্ট ইউ। পরের লাইনে ছোট হরফে-ফর ইউএস আর্মি। পত্রপত্রিকায় আংকেল শ‍্যামের কার্টুনও চোখে পড়ে। অনেকেই আংকেল শ‍্যামকে একটি কাল্পনিক চরিত্র বলে মনে করেন। আসলে তা কিন্তু নয়। তিনি ছিলেন আমাদের নিউইয়র্ক শহরেরই রক্তমাংসের একজন মানুষ। আসুন, তার সঙ্গে পরিচিত হই।

আংকেল শ‍্যামের পুরো নাম শ‍্যামুয়েল উইলসন। জন্ম ১৭৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আর্লিংটনে। বড় হয়েছেন নিউ হ‍্যাম্পশায়ারে। প্রথম জীবনে পেশা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন কাঠমিস্ত্রির কাজ। পরে ১৭৮৯ সালে বড় ভাইয়ের সঙ্গে নিউইয়র্কে চলে এসে পাকাপাকিভাবে বসতি গাড়েন। ১৮২২ সালে গৃহযুদ্ধের সময় শ‍্যামুয়েল আমেরিকান সৈন‍্যদের মাংস সরবরাহ করতেন। তার সরবরাহ করা মাংসের প‍্যাকেটের ওপর লেখা থাকতো ‘ইউএস’-এ দুটি অক্ষর। সৈন‍্যরা তখন জোক করে বলতে শুরু করে-আংকেল শ‍্যাম। আর এভাবেই সেনাবাহিনীতে ‘আংকেল শ‍্যাম’ নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শ‍্যামুয়েল উইলসন ১৮৫৪ সালে নিউইয়র্কেই মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ট্রয়ের ওকউড সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়।

১৯৬১ সনের ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৮৭তম কংগ্রেসে শ‍্যাম উইলসনকে ‘আংকেল শ‍্যাম’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় আংকেল শ‍্যামের ছবি দিয়ে সৈন‍্য সংগ্রহের জন‍্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। আর এভাবেই তিনি সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের আংকেল শ‍্যাম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

আংকেল শ‍্যামের যে ছবিটি সাধারণত আমরা কার্টুনে বা পোস্টারে দেখি, এটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। প্রত‍্যক্ষদর্শীরা বর্ণনা করেছেন, শ‍্যামুয়েল উইলসনের দাড়ি ছিল না। তিনি ছিলেন ক্লিন শেভড। ১৯ শতকের একজন বিখ‍্যাত পলিটিক‍্যাল কার্টুনিস্ট টমাস নেস্ট কার্টুনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার মুখে দাড়ি লাগিয়ে ছবিটি প্রচার করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আংকেল শ‍্যামকে নিয়ে সৈন‍্য সংগ্রহের পোস্টারটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তার আবক্ষ ছবির নিচে বড় করে-‘আই ওয়ান্ট ইউ’ এবং ছোট করে লেখা-‘ইউএস আর্মি’ কার্টুনটি আংকেল জেমস মন্টোগোমারীর ১৯১৭ সালে।

পরবর্তী সময়ে আংকেল শ‍্যাম কমিক বুকেও স্থান করে নেন। ১৯৮০ সালে ‘আংকেল শ‍্যামস অ্যাডভেঞ্চার’ নামে একটি কমিক বই প্রকাশিত হয় এবং এটি খুব জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৯৭ সালে ‘আংকেল শ‍্যাম‍’ নামে একটি ছবিও তৈরি হয়। শুধু তাই নয় আংকেল শ‍্যামকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ফোক রক গ্রুপ জনপ্রিয় সংগীতও রচনা করেছে। সর্বশেষ আংকেল শ‍্যাম নিউইয়র্ক ইয়াংকিদের লোগো হিসেবে স্থান করে নিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছেন।

পটেটো চিপসের জন্ম শহর নিউইয়র্ক

ছেলেমেয়ে, পরিবার নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবেন আর সঙ্গে পটেটো চিপস রাখবেন না-এটা কি হয়! পটেটো চিপস সারা বিশ্বে সবার কাছে সমান আদরনীয়। এই যে বিশ্ব জয় করা পটেটো চিপস। এজন‍্য আমরা নিউইয়র্কাররা গর্ব করতেই পারি। কারণ এই পটেটো চিপসের জন্ম আমাদের এই নিউইয়র্ক শহরেই।

১৮৫৩ সালে নিউইয়র্কের সারাতোগা কাউন্টির একটি শহর সারাতোগা স্প্রিংয়ে মুনস লেক হাউস নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল। সেই বছর ২৪ আগস্ট জর্জ ক্রাম নামে রেস্তোরাঁটির একজন রাঁধুনি এক খদ্দেরের জন্য রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। সে সময় মুনস লেক হাউসের ফ্রাইড পটেটো বেশ জনপ্রিয় ছিল। সেই খদ্দেরও এই আইটেম অর্ডার করেন। ক্রাম সেই অনুযায়ী খাবার তৈরি করে পরিবেশন করেন। কিন্তু সেই কাস্টমার ক্রামকে ডেকে অভিযোগ করেন, আলুগুলোর আকার বেশ বড় রয়ে গেছে। খাবারটি আবার তার চাহিদানুযায়ী তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। ক্রাম আলুগুলো পাতলা বা ছোট করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারও আলুর পুরুত্ব তার পছন্দমতো হয়নি বলে অভিযোগ করেন সেই খদ্দের। তাই তিনি খাবারটি আবারও ফিরিয়ে দিয়ে নতুন করে তৈরি করে আনতে বলেন।

ক্রামের মনে হয়েছিল, তার তৈরিকৃত খাবারকে সম্ভবত অবমাননার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি অবশ্য সেই রাগের বহিঃপ্রকাশও ঘটান তার রান্নার মাধ্যমে। কাগজের মতো পাতলা করে কেটে ফেলেন আলুগুলোকে, ফেলে দেন তেলভর্তি কড়াইয়ে। অনেকটা সময় নিয়ে আলুগুলোকে তিনি তেলে ভাজতে থাকেন যাতে এটি শক্ত এবং মচমচে হয়ে ওঠে। তারপর আলুগুলোর ওপর বেশি করে লবণ ছিটিয়ে দেন। ক্রাম ভেবেছিলেন, এবার ব্যাটার শিক্ষা হবে। খেতে চেয়েছিল ফ্রাইড পটোটো, এবার তাকে খেতে হবে আলুর এক অখাদ্য। 

যখন আইটেমটি পরিবেশন করা হলো, তখন সেই খদ্দের খাবারটি কেমন হয়েছে, সেটি নিয়ে কিছু বলার সুযোগই পেলেন না প্রথমে, একের পর এক শুধু মুখে পুরতে লাগলেন। খাওয়া শেষে তিনি রায় দিলেন-এটি ছিল বেশ সুস্বাদু। পরে আইটেমটি ‘সারাতোগা চিপস’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায়। 

জানা যায়, এই খদ্দের ছিলেন আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট। কারো মতে, খদ্দের ছিলেন আলবিট হুইনি নামে এক কৃষক, যিনি সারাদিন মাঠে পরিশ্রম করে বেশ ক্লান্ত হয়েই এসেছিলেন মুনস লেক হাউসে ডিনার করতে।

সারাতোগা চিপসের স্বাদ নিতে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষের নিয়মিত ভিড় লেগেই থাকতো মুনস লেক হাউসে। সে সময় চিপসটি বক্সে প্যাকিং করেও বিক্রি করা হতো।

পটেটো চিপসের জন্মদাতা জর্জ ক্রামের জন্ম সারাতোগা স্প্রিংয়েই, ১৮২৪ সালের ১৫ জুলাই। পেশাজীবনে কখনো শিকারি, কখনো বা পাহাড়ি পর্যটকদের গাইড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেষে থিতু হতে চেষ্টা করেছেন শেফের কাজে। ১৮৫০ সালে মুনস লেক হাউসে যোগ দেন ক্রাম। বছর দশেক সেখানে কাজ করে চিপস আবিষ্কারের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ১৮৬০ সালে নিউইয়র্কেই নিজেই একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন। কথিত আছে, রেস্টুরেন্টের প্রত্যেকটি টেবিলে তার বিখ্যাত পাতলা পটেটো ফ্রাই অ্যাপেটাইজার হিসেবে রাখা থাকতো। তখনো ক্রাম চিপসের জন্য কোনো ধরনের পেটেন্টের আবেদন করেননি। তার চিপসের প্রসার সীমাবদ্ধ ছিল নিউইয়র্কের আশপাশেই। কোনো এক অজানা কারণে ক্রামের রেস্টুরেন্টটি ১৮৯০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৪ সালে মারা যান তিনি।

ক্রাম তার উদ্ভাবিত পটেটো চিপসের জন্য পেটেন্ট করেননি। আর এই সুযোগটাই নিয়েছে অনেকে। তখন অনেকেই ক্রামের উদ্ভাবিত চিপস বানিয়ে আশপাশের মুদি দোকানগুলোয় বিক্রি শুরু করে। ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত ওহাইয়োর ক্লিভল্যান্ডে চিপস তৈরি ও বাজারজাত করতেন উইলিয়াম ট্যাপেনডন। ১৯২০ সালের দিকে দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রে গাড়িতে করে চিপস বিক্রি করতেন হারমান লে। ১৯২৬ সালে প্রথম বাডুজ্যিকভাবে চিপস তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার মনাটেরি পার্কে ওই কারখানা স্থাপন করেন লরা স্কাডার। উৎপাদিত চিপস সতেজ ও মুড়মুড়ে রাখার জন্য মোম-কাগজের চিপস ব্যাগও উদ্ভাবন করেন লরা। ফলে যত দূরেই পাঠানো হোক না কেন, চিপসের স্বাদ ও মজার ঘাটতি আর রইল না। আরো জনপ্রিয়তা পেলো চিপস। একসময় চিপসের জনপ্রিয়তা যুক্তরাষ্ট্র ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়লো দুনিয়াব্যাপী।

১৯৫৪ সালে আইরিশ ব্যবসায়ী জয় স্টুড মারফি ‘টাইটো’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেন, সেখানে তিনি চিপসে সিজনিং যুক্ত করা শুরু করেন। এভাবেই পটেটো চিপস শিল্প এগিয়ে গেছে। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে কোম্পানিগুলো একের পর এক নিত্য নতুন রং, আকার এবং স্বাদের চিপস বাজারে এনেছে এবং আনছে এখনো। স্ন্যাক্স ফুড হিসেবে এখন সারা বিশ্বেই সমান জনপ্রিয় নানান স্বাদের পটেটো চিপস। 

জর্জ ক্রামের আবিষ্কৃৃত এই পটেটো চিপস এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারই নয়, দুনিয়ার জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় প্রথম সারিতেই আছে। আর যেজন‍্য নিউইয়র্কার হিসেবে আমরা গর্ব করতেই পারি।

নিউইয়র্ক ২০ জুন ২০২৫ 

শেয়ার করুন