যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ গত জুন মাসে নাগরিকত্ব বাতিলের প্রক্রিয়াকে একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করে একটি নতুন নির্দেশনা জারি করে। এই নীতির আওতায় এখন এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করা হচ্ছে যারা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেননি এবং যারা অপরাধে জড়িত কিংবা নাগরিকত্ব প্রাপ্তির সময় কোনো তথ্য গোপন করেছেন- তাদের টার্গেট করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই তাদের ব্যাপারে ব্যাপক পরিসরে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশেষ করে অভিবাসী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে উদ্বেগ ও নিন্দার ঝড় তুলেছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধ, প্রক্রিয়াগত ন্যায়বিচার এবং নাগরিক অধিকারের প্রতি এক গুরুতর হুমকি তৈরি করছে। বিচার বিভাগের এই পদক্ষেপ দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
নতুন মেমোটি ১১ জুন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, যেসব ন্যাচারালাইজড নাগরিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, বিশেষ করে যারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বা সরকারি সাহায্য ব্যবস্থায় প্রতারণা করেছেন, তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচার বিভাগের সিভিল ডিভিশনের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রেট এ. শুমেট তার মেমোতে উল্লেখ করেছেন, যেসব মামলায় আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব বাতিল সম্ভব এবং প্রমাণ রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এই নির্দেশনার বাস্তব প্রয়োগ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। ব্রিটেন থেকে আগত মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য এলিয়ট ডিউক, যিনি তারা/তাদের সর্বনাম ব্যবহার করেন, তার নাগরিকত্ব ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। ডিউক শিশু যৌন নিপীড়নের ছবি বিতরণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন এবং স্বীকার করেন যে তিনি নাগরিকত্ব গ্রহণের আগেই এ অপরাধে লিপ্ত ছিলেন। জুন মাসে লুইজিয়ানায় তার বিরুদ্ধে ন্যাচারালাইজেশন বাতিলের মামলা চলে এবং নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাবন্দি এবং নাগরিকত্ব হারানোর ফলে কার্যত রাষ্ট্রহীন অবস্থায় আছেন।
এই সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির আইন অধ্যাপক ক্যাসান্দ্রা রবার্টসন বলেন, “সিভিল প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব বাতিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবী পাওয়ার অধিকার থাকে না এবং সরকারের পক্ষে প্রমাণের মানদণ্ডও তুলনামূলকভাবে কম। এটি ১৪তম সংশোধনীতে প্রদত্ত ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া আইনে অধিকার লঙ্ঘন করে। নাগরিকত্ব বাতিলের এই উদ্যোগ অনেকটা ম্যাকারথি যুগের (১৯৪০-৫০ এর দশক) পুনরাবৃত্তি। সে সময় প্রায় ২২,০০০ মানুষের বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব বাতিলের মামলা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি শিথিল হলেও ওবামা প্রশাসন এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আবার সক্রিয় হয়।
বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন এই প্রক্রিয়াকে আরও বিস্তৃত করতে চায়। এখন কেবলমাত্র অপরাধ নয়, বরং সরকারি অনুদান বা স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থায় প্রতারণার অভিযোগেও নাগরিকত্ব বাতিল করা হতে পারে। যেমন, পে-চেক প্রোটেকশন প্রোগ্রাম (পিপিপি), মেডিকেয়ার ও মেডিকেইডের প্রতারণার ঘটনাও এখন এই তালিকায় পড়বে।
ইমিগ্রেশন লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের নীতিনির্ধারক সামিরা হাফিজ বলেন, এভাবে নাগরিকদের একটি অংশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। জন্মসূত্রে নাগরিক নন এমন অনেকেই এখন নাগরিকত্ব হারানোর ভয় নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। বিচার বিভাগের এই নির্দেশনায় একটি উদ্বেগজনক দিক হলো, নাগরিকত্ব বাতিলের জন্য নির্ধারিত অপরাধ ছাড়াও যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ মামলাও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংজ্ঞা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হচ্ছে, যা সরকারের হাতে অসীম ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভ লুবেট বলেন, এমন অস্পষ্ট ভাষা নাগরিকত্বের স্থায়িত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশেষ করে যাদের নাগরিকত্ব পিতামাতার মাধ্যমে অর্জিত, তারাও ঝুঁকিতে পড়বে।
এই নীতির পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন হারিটেজ ফাউন্ডেশনের হ্যান্স ফন স্পাকোভস্কি। তিনি বলেন, নাগরিকত্ব কোনো অধিকার নয়, বরং একটি সুযোগ। যাদের অতীতে মাদক বা মানব পাচারের ইতিহাস রয়েছে, তারা এর যোগ্য নন। তবে সমালোচকরা মনে করেন, একবার নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে তা ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন ও ব্যতিক্রমী হওয়া উচিত।
এই নীতির প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত নয়-এর প্রতিক্রিয়া গোটা পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। বিশেষত যেসব শিশু পিতামাতার মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেয়েছে, তাদের নাগরিকত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। ২০২৪ সালে জর্জিয়ার প্লেইন্স শহরে জিমি কার্টার ন্যাশনাল হিস্টোরিক্যাল পার্কে নাগরিকত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা যখন শপথ নিচ্ছিলেন, তখন তারা ভাবতেও পারেননি-একদিন সেই নাগরিকত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
টেম্পল ইউনিভার্সিটির লরা বিংহ্যাম এই পরিস্থিতিকে “স্লিপারি স্লোপ” বা পিচ্ছিল ঢাল বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, নাগরিকত্ব এমন একটি বিষয় যা স্থায়ী ও অনড় হওয়া উচিত। আপনি যদি একদল নাগরিককে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, আর অন্যদের নিরাপদ রাখেন-তাহলে বৈষম্যমূলক সমাজ গড়ে উঠবে। এই সিদ্ধান্ত অভিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়িয়েছে। যারা বহু বছর আগে পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করে নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন, তারাও এখন নতুন করে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
বর্তমানে অভিবাসী ও ন্যাচারালাইজড নাগরিকদের ওপর নানা ধরনের আইনি চাপ বাড়ছে। একদিকে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্যোগ, অন্যদিকে শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী কর্মসূচিতে কঠোরতা-সব মিলিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিকে আমূল পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিবর্তন শুধু অভিবাসন ব্যবস্থাকেই নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নাগরিকত্ব বাতিলের প্রক্রিয়া ব্যতিক্রমী এবং কঠিন হওয়া উচিত। না হলে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সরকার এই পদ্ধতির অপব্যবহার করে ভিন্নমত দমন কিংবা বিভাজনমূলক নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
যদি এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে, তাহলে নাগরিকত্বের ধারণা আর স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য থাকবে না। এটি হয়ে উঠবে এক ধরনের ‘সশর্ত নাগরিকত্ব’, যেখানে রাষ্ট্র চাইলে যেকোনো সময় তা কেড়ে নিতে পারবে। এটি শুধু একটি মানবিক ট্র্যাজেডি নয়, বরং আইন, সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধেরও চরম অবমাননা।
সুতরাং, এই নতুন নীতিমালার আলোকে শুধু কোনো একজন ব্যক্তি নয়, বরং গোটা সমাজ, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। এখন দেখার বিষয়-এই চ্যালেঞ্জের জবাবে জনগণ, আইনবিদ সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব কী পদক্ষেপ নেয়।